-মোহাম্মদ আসাদ আলী
ফ্রান্সে শার্লি হেবদো পত্রিকা অফিসে হামলার পর এবার দেশটির ইতিহাসের ভয়ংকরতম জঙ্গি হামলা সংঘটিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ১২৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত হয়েছে আরও ১৮০ জন। প্যারিসের অন্তত তিনটি জনবহুল স্থানে হামলা হয়েছে। তার মধ্যে এক কনসার্ট হলে জিম্মি করেই হত্যা করা হয়েছে ৮০ জনকে। সমস্ত ফ্রান্স জুড়ে সতর্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশের কাজে সহযোগিতার জন্য প্যারিসে দেড় হাজার সেনা মোতায়েনের খবরও পাওয়া গেছে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম দেশটিতে ‘কার্ফ্যু’ জারি করা হলো। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হামলাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে মতামত দিয়েছেন এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, আইএস জঙ্গিরা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফ্রাঁসোয়া অঁল্যাদের এই বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ফ্রান্স বিষয়টাকে কতটা গুরুত্বের সাথে দেখছে এবং এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। ফ্রান্স নেতৃত্বও সেটা বিশ্বাস করছে, তবে তাদের ধারণা শুধু বহিঃর্বিশ্বের উদ্যোগেই এত বড় হামলা ঘটে নি, এর সাথে সে দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসীদেরও সহযোগিতা আছে। বলতে বাধা নেই, তারা অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী বলতে দেশটিতে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকেই ইঙ্গিত করছেন। বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফ্রান্সে এখন ইউরোপের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে এবং একইসাথে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইহুদী জনগোষ্ঠীও ফ্রান্সে। গত কিছুদিন যাবত সেখানে আমরা এন্টি সেমিটিজম এবং ইসলামোফোবিয়া বাড়তে দেখেছি, সেইসাথে যোগ হয়েছে রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান এবং শরণার্থী সংকট। এই সব মিলিয়ে সেখানে একটি অস্থির মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।’
অধ্যাপক আলী রিয়াজ ফ্রান্সের যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র এঁকেছেন তার ভিত্তিতে বলা যায়, এ হামলার পরিণতিতে ফ্রান্সে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়তে পারে এবং দেশটিতে নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা শুরু হতে পারে। সব কিছুর জন্য ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে দোষারোপ করার যে প্রবণতা ইউরোপে আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে তার পালে হাওয়া লাগল এ ঘটনায়। এতে করে ইউরোপে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত শরণার্থীদের উপর নেমে আসতে পারে নতুন কোনো বিপর্যয়। সবচাইতে বড় বিষয় হলো- এখন দেখতে হবে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে যেভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ ভর করছে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা নতুন কোনো মাত্রা লাভ করে কিনা।
বাস্তবতা হলো- এই হামলার সাথে যতটা না ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্ক, তার চেয়েও বেশি সম্পর্ক সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের। কিন্তু সেটা কি ইউরোপের জনগণ উপলব্ধি করতে পারবে? অতীতে পারে নি, হয়তো এখনও পারবে না। তাদেরকে বুঝতে হবে যে, আইএস ইসলামের ধারক নয়, মুসলিম জাতির ‘প্রতিনিধিত্ব’ তারা করে না। তারা প্রতিনিধিত্ব করে সাম্রাজ্যবাদের। সাম্রাজ্যবাদের লীলাভূমি থেকেই আইএস নামক বিষবৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়ায়। আইএস কারা তৈরি করল? কারা প্রসার ঘটাল? আইএসের হাতে যে অস্ত্র, যে ট্যাংক-গোলাবারুদ আছে তা সরবারহ করেছিল কারা? কেন করেছিল? কী স্বার্থ ছিল তার পেছনে? কিছুদিন আগেই টনি ব্লেয়ার স্বীকার করেছেন যে, ‘যুক্তরাষ্টের ইরাক আক্রমণের কারণেই আজকে আইএসের উত্থান ঘটেছে।’ আসলে ‘ঘটেছে’ বললে সত্যের অপনোদন করা হয়, বলতে হবে ঘটানো হয়েছে। আইএসের উত্থান একসময় পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে যেভাবে আল কায়েদা ও তালেবানের উত্থান ঘটানো হয়েছিল। তারপর তাকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করে সাম্রাজ্যবাদকে লাভবান করার জন্য। আর এ কাজে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতির সঙ্গি হয়ে থেকেছে যে দেশটি তাহলো- ফ্রান্স। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত ও তৎপরবর্তী ‘আইএস’ নিয়ে যে ভাঙ্গা-গড়া শুরু হয় তাতে সব সময়ই ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের লেজ ধরে হেঁটেছে। ফ্রান্সকে কি আজ তারই পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে? এই হামলা কি তবে ফ্রান্সের ‘৯/১১’? এখান থেকে যাত্রা শুরু করবে নতুন কোনো ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’? ফ্যাঁসোয়া ওঁল্যাদ কিন্তু আইএসের এ হামলাকে ‘যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই।
জঙ্গি হামলার ব্যাপারে লিখতে বসলে একটি কমন প্রশ্ন করতেই হয় যে, কার লাভ হলো? জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড যারা করছে, ইসলামের দোহাই দিয়ে যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন- তাতে কার লাভ হয়? আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের কোনো লাভ হয়? মুসলিম জাতির কোনো লাভ হয়? ইসলামের কোনো লাভ হয়? বস্তুত এ ধরনের কর্মকাণ্ড দ্বারা লাভবান হয় একমাত্র সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ। আর দুনিয়াব্যাপী ইসলাম ও মুসলিম জাতির ভাগ্যে জোটে নতুন নতুন কলঙ্ক। এ কারণেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো তালেবান, আল কায়েদা ও আইএস জন্ম দেয়, লালন-পালন করে। তারপর তাদের লাভের অংশ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেয়। সাথে হতভাগা মুসলিম জাতির ক্ষতির ব্যাপারটাও নিশ্চিত করে। সুতরাং সম্প্রতি প্যারিস হামলার ঘটনায় যারা ইসলামের দিকে আঙ্গুল তুলতে চলেছেন তাদেরকে আগে এটা পরিমাপ করা প্রয়োজন যে, এ জঙ্গি হামলার সাথে ইসলাম ও মুসলিম জাতির সম্পর্ক কতখানি আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সম্পর্ক কতখানি।