মোহাম্মদ আসাদ আলী:
বর্তমান বস্তুবাদী পশ্চিমা সভ্যতার অনুগত পৃথিবীতে জমজমাট কয়েকটি ব্যবসার তালিকা করলে সর্বাগ্রে স্থান পাবে ধর্মব্যবসা ও অস্ত্রব্যবসা। রমরমা এ ব্যবসা দু’টির ফাঁদ থেকে কেউই মুক্ত নয়। পৃথিবীতে প্রচলিত সব কয়টি ধর্মেরই এমন পুরোহিত-যাজক শ্রেণি রয়েছে যারা অর্থের বিনিময়ে ধর্মের কার্যাদি সম্পন্ন করে থাকে। কেউবা রাজনীতির অঙ্গনে ধর্মকে ঢালসরূপ ব্যবহার করে। এটাই ধর্মব্যবসা। অন্যদিকে অস্ত্রব্যবসার সরল-শাব্দিক অর্থ ছাড়াও আরও একটি প্রায়োগিক অর্থ আছে। সেটা হলো আগে অস্ত্রের চাহিদা সৃষ্টি করা, অতঃপর অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রি করা। বিশ্বব্যাপী চলমান অস্ত্রব্যবসার মহাজন হচ্ছে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ কথিত সব উন্নত সুপার পাওয়াররা। আর খাতকের ভূমিকা পালন করছে উন্নয়নশীল, অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো। অবশ্য স্বল্পন্নোত দেশগুলোও এ ব্যবসার দ্বারা কম নিপীড়িত হচ্ছে না। তারাও বিশ্ব অস্ত্রশক্তির তালিকায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র মজুদ করতে গিয়ে ফতুর হচ্ছে।
প্রথমেই আসি ধর্মব্যবসার প্রসঙ্গে। ধর্মকে পার্থিব স্বার্থে ব্যবহার করা একটি সুস্পষ্ট প্রতারণা। এ প্রতারণার করালগ্রাস থেকে মুক্ত নয় আজকের কোনো ধর্মের মানুষই। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম ইত্যাদি পৃথিবীতে আজ যত ধর্ম প্রচলিত আছে তার সবই এখন ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত। কেউ ধর্মের ধ্বজাধরে ধর্মীয় পুস্তকাদির মুখস্থ বিদ্যা আউড়িয়ে অর্থ উপার্জন করছে, আবার কেউ ধর্মকে বানাচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অন্যতম হাতিয়ার। এ সবগুলোই কার্যত ধর্মব্যবসা, যার নিষেধাজ্ঞা প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই মিলে। কিন্তু সে ধর্মগ্রন্থগুলোও তো ঐ ধর্মব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জালে আবদ্ধ। কাজেই ধর্মব্যবসায়ীদের নিকৃষ্ট এই কর্ম সম্পর্কে আজকের দুনিয়ার অধিকাংশ ধর্মভীরু ব্যক্তিই অনবহিত। তারা ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-পুরুত ও রাজনীতিকদেরকে ধর্মের হর্তকর্তা ভেবে কার্যত প্রতারণার পালে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। আর সে হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠছে ধর্মব্যবসায়ী প্রতারকরা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে দেশে ধর্মব্যবসায়ীদের জ্বালানো আগুনে দগ্ধ হচ্ছে অসংখ্য নিপীড়িত অসহায় আদম সন্তান। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে এর ভয়াবহতা সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এদের অপকর্ম দ্বারা সাধারণ মানুষ যতই নিপীড়িত হোক না কেন, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী মহাজনরা কিন্তু স্বল্প দিনের ব্যবসাতেই নাম কামিয়ে ফেলেন। তারা সমাজে পরিচিত হন মাওলানা, আলেম, ওলামা, মোফাসসের, পীর, কামেল, ওলি ইত্যাদি হিসেবে। এভাবে যুগ যুগ ধরে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা অব্যাহত থাকার পরিণাম এই হয়েছে যে, মানবতার মুক্তির পথ ধর্ম রূপ লাভ করেছে মোল্লাতন্ত্রে। সমাজে একটি যুবক আজ যতটা না তার পিতাকে সম্মান করে তার চেয়ে বেশি সম্মান করে কথিত মাওলানা সাহেবকে। স্ত্রী তার স্বামীর আনুগত্য না করলেও ঠিকই পীর সাহেবের আনুগত্য করেন। পিতা তার সন্তানকে না খাইয়ে রেখে সারা দিনের উপার্জনের টাকা মাজারের দানবাক্সে ফেলে আসে, মোল্লাকে নজরানা দেয়। বুভুক্ষ-হাড্ডিসার একজন ভিক্ষুককে অভুক্ত অবস্থায় বাইরে রেখে মোল্লা সাহেবকে গোস্ত পোলাও খাওয়ায়। এক কথায় প্রতারক ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মবাণিজ্য বর্তমানে জমজমাট রূপ লাভ করেছে।
একই অবস্থা অস্ত্র ব্যবসারও। অস্ত্র ব্যবসা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত। জমজমাট এই ব্যবসাটিও ধর্মব্যবসার মতোই সিন্ডিকেট নির্ভর। আর এ ব্যবসায় গুটিকতক পুঁজিপতি ব্যবসায়ীর ষড়যন্ত্রের বলি হয় পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি। বর্তমান পৃথিবীতে মূলত অস্ত্র ব্যবসার ঘুটি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স ইত্যাদি শক্তিধর দেশগুলো। কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে তথা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে অস্ত্র বিক্রির জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে মোটামুটি কিছু অজুহাত ছিল। কিন্তু রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসা পড়ে বেকায়দায়। পরবর্তীতে বুশ (সিনিয়র) সে বেকায়দা থেকে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের রক্ষা করে ইরাক আক্রমণের মাধ্যমে। কিন্তু এরপর ক্লিংটনের আমলে তারা আবার বিপদে পড়ে। অস্ত্র ব্যবসায় ভাটা পড়ে যায়। কারণ ক্লিংটন যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত আগ্রাসী চরিত্রের সাথে মানানসই ছিলেন না। তিনি বহির্বিশ্ব নিয়ে ততটা মাথা ঘামাতেন না। বেশি মনোযোগ দিতেন নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র বেকারত্ব রোধে কিছুটা সফল হতে পারলেও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য তা ছিল অশনিসংকেত। তাছাড়া সে সময় বিশ্ব মোড়লীপনাতেও চরম ঘাটতি অনুভূত হয় যুক্তরাষ্ট্রের। অতঃপর বুশ (জুনিয়র) আসার পর অস্ত্র ব্যবসায়ীরা নড়ে চড়ে বসে ও বিশ্ব মোড়লীপনাতে গতি আসে। তার আমলে একটি ভালো মানের অজুহাত পাওয়া যায়। সেটা হলো- টুইন টাওয়ার ধ্বংস। অনেকেই মনে করেন অজুহাতটা তাদের নিজেদেরই তৈরি। এখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রব্যবসার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দৃশ্যপটে কম্যুনিজমের স্থান দখল করে ইসলাম বা ইসলামী সন্ত্রাস। শুরু হয় আফগান, ইরাক ইত্যাদি স্থানে একের পর এক আক্রমণ। ওদিকে অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও নড়ে চড়ে বসে। কিছুদিনের মধ্যেই চারিদিকে অস্ত্রের নতুন নতুন চাহিদা সৃষ্টি হতে থাকে। আর অস্ত্র বিক্রি করে লাভবান হয় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখানে আরও একটি বিষয় আছে, যে কারণে কিছুটা লাভবান হলেও তাদের কাক্সিক্ষত সফলতা আসছিল না। সমস্যা দাঁড়িয়েছিল এই যে, যখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করছে তখন তো তার মিত্র দেশগুলোর অস্ত্র কেনার দরকার পড়বে না। তাই এবারে পলিসিতে কিছুটা রদ-বদল আনা হলো। এবারে টার্গেট করা হলো ইরান, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি দেশের প্রতি। সারা পৃথিবী থেকে বেছে বেছে এরকম কয়েকটি দেশকে নিয়ে শুরু হলো হুলুস্থুল। উপলক্ষ হিসেবে নেয়া হলো এ দেশগুলোর পরমাণু কর্মসূচি। ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল পৃথিবীজুড়ে। তখন ইরানের জুজুর ভয় দেখিয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইরানবিরোধী দেশগুলোতে অস্ত্রবিক্রি করা শুরু হলো। আবার উত্তর কোরিয়ার ভয় দেখিয়ে অস্ত্র বিক্রি করা হলো দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের কাছে। আরব দেশগুলোর আছে পেট্রো ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আছে বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃৃত্তের অর্থ। চীনের সাথে তাইওয়ানকে নিয়েও বেশ খেলা শুরু হলো। আর এভাবে কোনো প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই শুধু প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের বাজার চাঙ্গা হয়ে গেল।
এরপর ২০১২ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন খেলা শুরু হয়। এখানেও মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সুযোগে সদ্ব্যবহার করেছে। তিউনিসিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনকে সব সময়ই মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো। ২০১৩ সালের শেষ দিকে যখন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সরকার পতনের আন্দোলনে টালমাটাল অবস্থা তখন সুযোগ বুঝে পশ্চিমারা ওই সব দেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেন-এই ৫টি দেশে গত ৫ বছরে ২০০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি করেছে পশ্চিমারা। এসব অস্ত্র মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে পারে জেনেও বিক্রি অব্যাহত রাখে তারা।
শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রই এ খেলা চালাচ্ছে তা কিন্তু নয়। এ খেলার অপরদিকে আরেকটি পক্ষ রয়েছে যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়া, চীন ইত্যাদি দেশ। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ শক্তিধর দেশগুলোর রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পুঁজিপতি অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা। প্রকৃত লাভবানও হচ্ছে তারাই। আর এ অস্ত্র বাণিজ্যের বিপুল অর্থ যোগান দিতে হচ্ছে বিভিন্ন অনুন্নত দেশের দরিদ্র জনসংখ্যাকে। বিভিন্ন দরিদ্র রাষ্ট্রের সরকারগুলো অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে অস্ত্র কিনছে সে অর্থ দিয়ে খুব সহজেই সে দেশের দারিদ্র্য লাঘব করা যায়।
ধর্মব্যবসা ও অস্ত্র ব্যবসার মধ্যে মেলবন্ধন টানা যায় এভাবে যে, এ উভয় প্রকার ব্যবসাতেই সাধারণ জনগণকে প্রতারিত করা হয়। তাদের তেলে তাদেরকেই ভাজা হয়। কিন্তু জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হলেও জনগণের কাছে তার কারণ অজানাই থেকে যায়। তারা নিজেরাও জানে না যে, ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-পুরোহিতরা কীভাবে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। তারা জানে না কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ তাদের অজান্তেই পশ্চিমা শোষককূলের ব্যাংকে জমা হচ্ছে আর বিনিময়ে তাদেরকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দরিদ্র্যতার ঘানি টানতে হচ্ছে।