যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরাশক্তিধর রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয়েছিল আধিপত্যের লড়াই। তাদের উভয়েরই হাতে রয়েছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ও হাজার হাজার অ্যাটম বোমা যা দিয়ে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে ধূলায় মিশিয়ে দিতে সক্ষম। কিন্তু তারা সেটা করছে না। কারণ একটাই, তারা ভাবছে যে আমি যদি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করি তাহলে আমাকেও মরতে হবে। আমাকে মারার মত যথেষ্ট সামর্থ্য প্রতিপক্ষের রয়েছে। এই কারণে এই রাষ্ট্রদুটো কখনও সরাসরি যুদ্ধে জড়ায় নি তবে নানা কৌশলে চেষ্টা চালিয়ে গেছে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার জন্য। তাদের এই রেষারেষি, আধিপত্যের প্রতিযোগিতাকে শীতল যুদ্ধ নাম দেওয়া হয়েছে।
পরস্পরকে পরাভূত করার জন্য তারা অনেকগুলো প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধও করেছে। এটা হচ্ছে এরকম যে, রাশিয়া মুসলিম প্রধান দেশ আফগানিস্তানে আক্রমণ চালালো আর যুক্তরাষ্ট্র পেছন থেকে আফগানিস্তানের মানুষের হাতে অস্ত্রপাতি তুলে দিল, আরবের সাহায্যে জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করল রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য। এভাবে আশির দশকে আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। আফগানিস্তানের যুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠল বিশ্বের একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। তারা একটার পর একটা মুসলিম প্রধান দেশগুলোকে নানা অসিলায় দখল করে নিল। মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ তারা হত্যা করল। এই দুই যুগ রাশিয়া বসে বসে কেবল শক্তি সঞ্চয় করেছে তাদের চিরশত্রুর সমকক্ষতা অর্জন করার জন্য। এখন তারা আবার অস্ত্রশক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ। তাই আবারও তারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর তারা বেছে নিয়েছে সিরিয়ার মাটিকে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দুটো দেশই সোচ্চার কিন্তু সিরিয়াতে বিদ্রোহী তথা জঙ্গিদেরকেই অস্ত্র অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আর উল্টো দিকে আসাদ সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। ধূলিসাৎ হয়ে গেছে সিরিয়ার সুপ্রাচীন নগরগুলো, প্রাণ হারিয়েছে নির্দোষ সিরিয়াবাসী, শিশু, নারী, বৃদ্ধরা। উদ্বাস্তু হয়েছে লাখে লাখে। মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই যুদ্ধ চলছে গত কয়েক বছর থেকেই। চলছে এখানে ওখানে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, রাসায়ানিক বোমা পরীক্ষা। কয়েক বছর আগে সিরিয়ার একটি বিমানঘাটিতে রাসায়নিক গ্যাস বোমা নিক্ষেপ করার দরুন ২৭টি শিশুসহ ৭৮ জন মানুষ (যারা মুসলমান) মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল যা আলোড়িত করেছিল বিশ্ববাসীকে।
রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। ১৯৪৫ সনে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র যে অ্যাটম বোমাদুটো ফেলেছিল তার ক্ষত এখনও বয়ে চলেছে মানবজাতি। এখনও সেখানে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে, মারাত্মক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আর মুহূর্তের মধ্যে প্রায় ২,২৬,০০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেই থেকে ৭৬ বছর পৃথিবী পাশবিকতার দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, এখন যে ৪০ হাজার পরমাণু বোমা নিয়ে মানবজাতি বসে আছে সেগুলোর একেকটার ধ্বংসকারী ক্ষমতাও বহু সহস্রগুণ বেশি। যদি কোনো কারণে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তাহলে এই বোমাগুলো কি তারা প্রয়োগ করবে না?
ধরুন দু’জন মানুষ একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ট্রিগার টানছে না কারণ আমি গুলি করলে আমার প্রতিপক্ষও গুলি ছুড়বে। আমি তাকে হয়তো হত্যা করতে পারবো কিন্তু বিনিময়ে আমার নিজেকেও নিহত হতে হবে। এমতাবস্থায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব? নিশ্চয়ই আজীবন নয়। এক সময় না এক সময় ট্রিগার টিপতেই হবে কাউকে না কাউকে। এই অবস্থাকে কূটনৈতিক ভাষায় বলা হয় দাঁতাত বা ডিটারেন্ট। এটা একটি প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল যা দিনকেদিন নাজুক হয়ে পড়ছে। যদি দুই পরাশক্তির মধ্যে থাকা এই দেওয়ালটি ভেঙ্গে যায় তাহলে তাদের মিত্রশক্তিগুলোও যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবে যা ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে মানবজাতিকে ঠেলে দেবে। এর পরিণামে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরো মানবজাতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দাঁতাতের সেই প্রাচীর এখন সূক্ষ্ম পর্দায় পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত উত্তর কোরিয়া, চীনসহ অন্যান্য পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও। তাদের নৌবহরের মহড়া চলছে বিভিন্ন দেশের সামুদ্রিক সীমান্তে।
পারমাণবিক মারণাস্ত্রের অধিকারী রাষ্ট্রগুলোর এই শত্রুতামূলক অবস্থানের মাধ্যমে পৃথিবী এসে দাঁড়িয়েছে এক মহা সংকটের সীমানায়। এ জাতীয় মহাসংকট সম্পর্কে প্রচুর ভবিষ্যদ্বাণী ধর্মগ্রন্থগুলোতে আমরা দেখতে পাই যা ধর্মবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী প্রত্যেক মানুষের জন্যই কৌতূহলুদ্দীপক। প্রতিটি ধর্মমতেই বর্তমান যুগটিকে শেষ যুগ বলা হয়েছে। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে ঘোরকলি, ইসলামে আখেরি যামানা বা ইয়াউমুল আসর, বাইবেলে দ্য লাস্ট আওয়ার ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। রসুলাল্লাহর প্রতিটি হাদীসগ্রন্থেই ‘কিতাব আল ফিতান’ বলে একটি অধ্যায় রয়েছে যেখানে শেষ যুগে যে বিরাট যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যায় অশান্তির বিস্তার হবে তার বিস্তারিত বিবরণ আমরা দেখতে পাই। এসব নিয়ে বহু গবেষক গবেষণা করে হাজার হাজার মোটা মোটা বই লিখেছেন। ধর্মহীন সভ্যতায় অভ্যস্ত মানুষেরা এতটাই অন্ধ হয়ে গেছে যে ঐ সমস্ত ভবিষদ্বাণীকে আমলে নেওয়ারও কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। যাহোক, আমরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে যে বড় বড় ঘটনাগুলো সম্পর্কে আলোচনা দেখতে পাই সেগুলো হচ্ছে,
১. একটি মহাশক্তিশালী দানবের আবির্ভাব ঘটবে যে মানবজাতির প্রভু বলে নিজেকে দাবি করবে। এই রূপক দানবটিকে আল্লাহর রসুল ‘দাজ্জাল’ বলে অভিহিত করেছেন। দাজ্জালের সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের মত দুইটি জিনিস থাকবে। সে যেটাকে জান্নাত বলবে সেটা আসলে হবে জাহান্নাম, আর যেটাকে জাহান্নাম বলবে সেটা আসলে হবে জান্নাত। যারা তাকে প্রভু বলে মেনে নেবে তাদেরকে সে তার জান্নাতে স্থান দেবে (বোখারী, মুসলিম)। সে পৃথিবীর সর্বত্র কী হচ্ছে তা দেখতে ও শুনতে পাবে, তার নির্দেশে ভূগর্ভের সম্পদ উঠে আসবে, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে।
তার কাছে জীবনোপকরণের বিশাল ভাণ্ডার থাকবে। যারা তাকে প্রভু বলে মেনে নেবে তাদেরকে সে সেখান থেকে দান করবে। আর যারা তার প্রভুত্ব অস্বীকার করবে, অর্থাৎ তার আদেশমত চলবে না, তাদের সে তার ভাণ্ডার থেকে দান তো করবেই না বরং তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) ও অবরোধ (Embargo) আরোপ করবে। তার পদতলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের করুণ পরিণতি নেমে আসবে (বোখারী, মুসলিম)। মহানবী এই দাজ্জালের আবির্ভাবকে আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুতর ও সাংঘাতিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করেছেন (মুসলিম), শুধু তা-ই নয়, এর মহাবিপদ থেকে তিনি নিজে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন (বোখারী)। বাইবেলে একেই এন্টি ক্রাইস্ট বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
২. একজন মহামানব আসবেন যিনি পথভ্রষ্ট মুসলিম জাতিকে আবার সঠিক পথে, হেদায়াতে ফিরিয়ে আনবেন। এজন্য তাঁকে এমাম মাহদি (আ.) অর্থাৎ হেদায়াতপ্রাপ্ত নেতা বলে হাদসীগ্রন্থে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
৩. দাজ্জালকে ধ্বংস করার জন্য ঈসা (আ.) এর পুনরাবির্ভাব হবে। এ বিষয়ে কোর’আন, হাদীস, বাইবেল সব গ্রন্থেই ইঙ্গিত ও সরাসরি বর্ণনা রয়েছে।
৪. ইয়াজুজ মাজুজ নামক দুটো যুদ্ধবাজ সম্প্রদায়ের রূপক বর্ণনা ইসলামে যেমন আছে বাইবেলেও আছে। বাইবেলে তাদের বলা হয়েছে গগ-ম্যাগগ। পবিত্র কোর’আনে রয়েছে যে একটি ব্যবধানকারী প্রাচীর নির্মাণ করে এই ভয়াবহ ইয়াজুজ মাজুজকে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। আবার আল্লাহর প্রতিশ্রুত সময় আসলে সেই প্রাচীরটি আল্লাহ চূর্ণ করে দেবেন এবং তারা একে অপরের উপর তথা মানবজাতির উপর তরঙ্গের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়বে (সুরা কাহাফ)। হাদীসে বলা হয়েছে, ইয়াজুজ মাজুজ মানবজাতিকে সম্পূর্ণ বিনাশ করে দেবে। পৃথিবীর কোনো জায়গা থাকবে না যেখানে মানুষের লাশের গন্ধ নেই। কেবল ঈসা (আ.) এর নেতৃত্বে কিছু বিশ্বাসী মানুষ যুদ্ধকালীন কঠিন দুর্ভিক্ষের মধ্যেও প্রাণে রক্ষা পাবে।
আখেরি যুগে পৃথিবী জুড়ে বিরাট এক যুদ্ধ হবে যাকে বাইবেলে Battle of Armageddon এবং হাদিসগ্রন্থে “মালহিম” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “The kings of the entire inhabited earth” will be gathered together to the war of the great day of God the Almighty.”—Revelation 16:14. অর্থাৎ পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল রাজা সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নির্ধারিত দিনে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিলিত হবে। আরো বলা হয়েছে, “আরমাগেডনের যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের স্বৈরাচারী রাজত্বের সমাপ্তি হয়ে স্রষ্টার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে (বাইবেল, দানিয়েল ২: ২২)।
৫. অতঃপর পৃথিবীতে কল্পনাতীত শান্তি ফিরে আসবে। একে বাইবেলে বলা হয়েছে কিংডম অব হ্যাভেন। হাদীস ও বাইবেলের বিবরণ মতে ফুলে ফসলে পৃথিবী পূর্ণ হয়ে যাবে। এমন শান্তি আসবে যে বাঘেরা ভেড়ার পালকে পাহারা দেবে। দুইজন মানুষের মধ্যেও কোনো শত্রুতা থাকবে না। পৃথিবীটা কাঁচের মত স্বচ্ছ বা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে।
যারা ধর্মবিশ্বাসী তাদের কাছে ধর্মগ্রন্থে থাকা এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অবশ্যই চিন্তার দাবি রাখে। আমরা ওগুলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাবো না, কেবল মোটাদাগে মূল ঘটনাগুলো চিহ্নিত করলাম। আমরা মানবজাতি এখন এই বাস্তবতার মধ্যেই বসবাস করছি এবং ভবিষ্যতে এই বড় ঘটনাগুলো যেগুলো এখনও হয় নি, সেগুলো অবশ্যই হবে। কারো বিশ্বাস বা অবিশ্বাস এগুলো ঘটার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না। যারা ধর্মের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে অস্বীকার করেন তারাও আশা করি বর্তমান বিশ্বের ভয়াবহ যুদ্ধমুখী পরিস্থিতির সত্যতাকে অস্বীকার করতে পারবেন না।