পাবনায় হেযবুত তওহীদের জেলা কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সুজনের বাড়িতে এখন শুধু শোকের মাতম। শোকে কাতর সুজনের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে বাড়িতে ভিড় করছেন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা। পরিবারের সদস্যদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে আশেপাশের পরিবেশ।
গত মঙ্গলবার পাবনা শহরের ভাটামোড় এলাকায় অবস্থিত হেযবুত তওহীদের জেলা কার্যালয়ে দলটির স্থানীয় সভাপতির সাথে বসে আলাপ করছিল সুজন। এসময় সেখানে উপস্থিত হয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা জেলা সভাপতি সেলিম শেখের উপর অতর্কিত হামলা করলে তা প্রতিহত করেন সুজন। এতে হামলাকারীরা ক্ষেপে গিয়ে সুজনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তার মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। একপর্যায়ে সুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার বুকের উপর ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে সুজনকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সুজনের হঠাৎ মৃত্যুর খবরে তার পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া।
সদ্য বিবাহিত সুজনের স্ত্রী ছিল অন্তসত্বা। স্বামী হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “জীবন্ত একটা মানুষ বাসা থেকে বের হলো কিন্তু ফিরে আসলো রক্তাক্ত নিথর দেহে। সে তার সন্তানের মুখটাও দেখে যেতে পারলো না। এখন আমি আর কী বাঁচবো? কে দেখবে আমার সন্তানকে? আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।”
নিহত সুজনের ভাই আলামিন বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যার পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না। সন্ধ্যার পর ও যে দল করতো হেযবুত তওহীদের অফিসে সহকর্মীদের নিয়ে একটি মিটিং ছিল। ওই মিটিং এর মধ্যে কাবলিপাড়া থেকে কিছু দুর্বৃত্তরা আমার ভাই ও অন্যান্য সহকর্মীদের উপর আচমকা হামলা চালায়। এসময় সুজনকে সবার মধ্যে থেকে আলাদা করে বেশ কয়েকজন ধরে হাতুরি দিয়ে পিটায়। স্থানীয় তরকারি বিক্রেতা আলাল শেখ হাঁসুয়া নিয়ে আসে। আজিম শেখ আমার ভাইকে সামনে থেকে ধরে। আর পেছন থেকে আলাল শেখ ওর মাথায় কোপ দেয়। তিনি আরো বলেন, শুনেছি আলাল শেখকে পুলিশে আটক করেছে। আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের কঠিন শাস্তি চাই। যাতে এইসব অপরাধীরা আর কোন অপরাধ করার সুযোগ না পায়।
অসম্ভব পরিশ্রমী ও বিনয়ী সুজন ছিল এলাকাতেও সবার প্রিয়। এলাকায় কোন ধরনের হট্টগোলে তার সম্পৃক্তা ছিল না কখনো। বরং তরুণ প্রজন্মকে সর্বদা ন্যায়ের পথে থাকার তাগিদ দিতেন বলে জানান তার বন্ধুরা। স্থানীয় এক প্রতিবেশী বলেন, “সুজন কখনো কোন খারাপ কাজের সাথে জড়িত বলে আমরা শুনতাম না। সে সব সময় হাসি-খুশী থাকতো, দেখা হলে সালাম দিত। চোখের সামনে বড় হওয়া, এমন একজন ছেলেকে হারানো আমরা কোনভাবেই মানতে পারছি না।”
সেদিনের হামলার বিবরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রত্যক্ষদর্শী আলাউদ্দিন শেখ বলেন, “আমি সন্ধ্যায় বাজারে ছিলাম। হঠাৎ করে দেখি লাঠিসোটা নিয়ে আলাল শেখ ও তার ছেলেরা ভাটামোড় এলাকায় যায়। তারা সেখানে গিয়ে স্থানীয় একটি ক্লাবের ছেলেদের বিভিন্ন উসকানি দিতে থাকে। ক্লাবের ছেলেরা মূলত আলাল শেখের ছেলে আল আমিনের বন্ধু। সেখানে বসে তারা তাস খেলে। এরআগেও তারা এলাকায় বিভিন্ন গণ্ডগোল করেছিল, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও আছে। আলাল শেখ ও তার ছেলের কথায় ক্লাবের ছেলেরা বিভিন্ন ভারী অস্ত্র হাঁসুয়া, রামদা, চাপাতি, বড় বড় লাঠিসোটা নিয়ে অফিসে হামলা করে। এরপর রাতে শুনি আমাদের এলাকার সুজন মারা গেছে।”
এদিকে পাবনায় সেই রাতের হামলায় সুজন ছাড়াও আরো নয় জন আহত হয়েছিল। এরমধ্যে আমিনুল ইসলামকেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আনা হয়েছিল। বাকীদের পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। রাজশাহী মেডিকেলে আইসিইউতে বেড ফাঁকা না পাওয়া যাওয়ায় আমিনুল ইসলামকে গতকাল রাজশাহীর শেরশাহ রোডর সিডিএম হসপিটালে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছে। অন্যদিকে যারা পাবনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল তাদের পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় গতকাল বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ হামলার ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত সাত জনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। বাকী আসামীদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এদিকে পুলিশের অভিযানের খবর পেয়ে বাকী হামলাকারীরা ইতোমধ্যে এলাকা ছেড়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাবনা সদর থানার এসআই সৌরভ বলেন, মামলার অধিকতর তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতারকৃত আসামীদের আজ (বৃহস্পতিবার) আদালতে প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি। আগামী কার্যদিবসে তাদের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ করা হবে।