হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

পশ্চিমে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা গৃহীত হলো, প্রাচ্যে কেন হচ্ছে না?

পর্ব-১

Untitled-2রিয়াদুল হাসান

সব মতবাদের মতো গণতন্ত্রেরও জোয়ার-ভাটা আছে। কখনো দুনিয়াজুড়ে এর ঢেউ আছড়ে পড়ে, আবার সেই পর্ব শেষ হলে গণতন্ত্রে আসে ভাটার টান। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন তার ‘দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’ বইয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের তিনটি জোয়ারের সময়ের কথা বলেছেন। এই জোয়ারগুলোর মাঝে ভাটার পর্ব গেছে। বাংলাদেশও গণতন্ত্রের এসব জোয়ার-ভাটার বাইরে নয়।
তিনি লিখেছেন, আধুনিক গণতন্ত্রের যে যাত্রা, তা তিনটি পর্ব বা ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। গণতন্ত্রের প্রথম ঢেউটি ছিল ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত। প্রায় ১০০ বছরের দীর্ঘ এই জোয়ারের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ভাটার সময় গেছে গণতন্ত্রে। তখন কোথাও ফ্যাসিজমের বিকাশ হয়েছে, কোথাও কোথাও কমিউনিজম। গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর বিজয়ের পর। বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব গণতন্ত্রে আবার চলে ভাটার টান। সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জোরদার হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী শাসন। গণতন্ত্রের শেষ জোয়ারটি বয়ে গেছে ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, এ সময়ে দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ১৯৯৪ সাল নাগাদ বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গণতন্ত্র অবলম্বনকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে ১২৫ এ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে সংখ্যার নয় মানের। অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থা বা মতবাদের মতোই গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও সরকারগুলো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে যা গণতন্ত্রের তত্ত্বের পরিপন্থী।
সমাজের সবকিছুর ওপর সরকারগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ কঠোর থেকে কঠোরতর করে যাচ্ছে। ফলে গণতন্ত্রের নামে বিশ্বময় শুরু হয়েছে জবরদস্তিমূলক শাসন যা কম্যুনিজমের নামে জনতার উপর ফ্যাসিজমের স্টীম রোলার চালানোর স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখন গণতন্ত্র যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই গণঅভ্যুত্থান হবে। যার উদাহরণ হচ্ছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরাতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে থাই জনগণের রাস্তায় নেমে আসা।
মিসরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেখানে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়েছে পশ্চিমা সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে এবং সেখানকার জনগণের একটি বড় অংশ তাকে সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্ব যে গণতন্ত্রের অবতার এমন ধারণা মায়ানমারে সামরিক শাসন উৎখাতের ঘটনা দেখে অনেকে মনে করতে পারেন, কিন্তু তাদের ভুল ধারণা ভেঙ্গে যাবে মিসরের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন কায়েমের পক্ষে পশ্চিমাদের জোরালো অবস্থান গ্রহণের ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করলে। স্যামুয়েল হান্টিংটন এ ধরনের প্রবণতা স¤পর্কে বলেছেন, ‘নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কখনো ‘ওপর’ থেকে চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং অভিজাতদের চাপেই এমনটা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধারণ করতে প্রস্তুত নয়।’
প্রাচ্যের মানুষও তেমনি প্রস্তুত নয় সেটা গ্রহণ করতে যদিও সরকারগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন এই প্রস্তুত না থাকার কারণটা হৃদয় দিয়ে বোঝা নীতি নির্ধারকদের জন্য খুবই জরুরি। অন্যথায় আমরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র নামক মরীচিকার পেছনে ঘুরে ঘুরে আরো অনেক সময় নষ্ট করে ফেলব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অত সময় নেই আমাদের হাতে। এই কারণগুলো নিয়ে কয়েকটি সূত্রকথা আমরা এখন আলোচনা করব।

১. ব্যবস্থাটি মানুষের হৃদয়ের অনুকূল ও যুগের দাবি হতে হবে:

সমাজব্যবস্থা ও সভ্যতা সম্পর্কে একটি সরল সূত্র আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। তা হচ্ছে সভ্যতার ভিত্তিটি স্থাপন করতে হয় মানুষের হৃদয়ে। মানুষ যদি কোনো জীবনব্যবস্থাকে, সংস্কৃতিকে আদর করে গ্রহণ করে নেয় তাহলে সেটি চর্চার মাধ্যমে এক সময় সভ্যতার রূপ নেয়। যদি কোনো সভ্যতাকে ‘ওপর’ থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেটা ক্ষমতা ও বলপূর্বক শাসন করতে পারে তবে সেটা স্থায়ী হয় না, সভ্যতায় রূপ নিতে পারে না। কিছুদিন পরেই তা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। ধর্মগুলো হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের হৃদয়ে আসন গেঁড়ে আছে, সেগুলো সভ্যতার রূপ নিয়েছে। তাই একমাত্র পাশ্চাত্য ধর্মহীন সভ্যতাটি ছাড়া অতীতের সবগুলো সভ্যতাই ধর্মভিত্তিক সভ্যতা। তবে ধর্মও যদি চাপিয়ে দেওয়া হয় সেটা গৃহীত হয় না, যার উদাহরণ দীনে এলাহী ও তালেবান ইত্যাদি।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে এসে শাসনক্ষমতা দখল করে এবং তাদের নিজেদের দেশে যা চালিয়ে অভস্ত সেই ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মহীন) রাষ্ট্রব্যবস্থা এখানেও প্রচলন করে। অর্থাৎ তারা ভারতবর্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি সভ্যতার উপরে আরেকটি অসামঞ্জস্যশীল সভ্যতার মূল্যবোধ ও বিধিবিধান চাপিয়ে দেয়। পূর্বতন সভ্যতাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন ও জীবনব্যবস্থার ভিত্তিতে, অর্থাৎ এর ভিত্তি ছিল মানুষের মর্মমূলে যেখানে তাদের ধর্মবিশ্বাস সেখানে। কথা হচ্ছে, ভারতবর্ষের মানুষ কি সেই ধর্মভিত্তিক (যদিও তা ত্রুটিহীন ছিল না) ব্যবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ত্রাহিসুরে চিৎকার করছিল? তারা কি খারাপ ছিল খুব? না। তারা সেই বিধানের মধ্যে বেশ ভালোই ছিল। টাকায় আট মণ চাল, গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু এই কথাগুলো সেই সোনালি অতীতের গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল। অন্তত এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয় নি যে মানুষ তার রাষ্ট্রীয় জীবনে, সামগ্রিক জীবনে ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যাবে।

২. ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ছিল যুগের দাবি:

ইউরোপ কেন ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবিধানের দিকে ঝুঁকলো তা প্রাসঙ্গিক কারণে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। এটা ছিল দীর্ঘ ১,৫০০ বছরে সৃষ্ট প্রেক্ষাপট ও অজস্র মর্মবিদারী ঘটনাপ্রবাহের ফল। খ্রিষ্টধর্মে জাতীয় জীবনব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও গীর্জার বানোয়াট ধর্মকে জাতীয় জীবনে চালাতে গিয়ে মধ্যযুগে চরম মানবিক বিপর্যয়, সহিংসতা, অরাজকতা, বর্বরতা ও জাহেলিয়াতে ঢেকে যায় ইউরোপ তথা খ্রিষ্টান জগৎ। জনগণের আত্মা রাজা ও গীর্জার পেষণে পড়ে মুক্তির জন্য ত্রাহি চিৎকার করতে থাকে। এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রাজাকে গীর্জার উপরে ক্ষমতাবান করে ১৫৩৭ সনে নতুন একটি ব্যবস্থার পত্তন ঘটানো হয় ব্রিটেনে। এখানে রাজা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের কর্তৃত্ব ও বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যান। ধর্ম নির্বাসিত হয় হিতোপদেশ, পরকাল, প্রার্থনা ইত্যাদি বিষয়ের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থাটির আবির্ভাব ইউরোপে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয় বরং তাদের ঐকান্তিক ইচ্ছার প্রতিফলন ছিল যা তাদের হিসাবে ‘ইউরোপের আধুনিক যুগের’ সূচনা করেছিল। কোনো ধর্মভিত্তিক জীবনব্যবস্থা না থাকায় তাদের সামনে এ ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু ভারতবর্ষে তা ছিল ‘ওপর’ থেকে চাপিয়ে দেওয়া, জীবনব্যবস্থার সংকটের দরুন নয়।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...