মোহাম্মদ আসাদ আলী:
কালের দুঃসহ আগ্রাসনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছি পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান। কয়েকশ’ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে এই জাতিটির উপর কী অত্যাচার-নিপীড়নটাই না চলছে! পৃথিবীর সর্বত্র আজ আমরা গজবের পাত্র, যেখানে যে জাতির কাছে আছি, সেখানে সেই জাতিই ফুটবলের মত লাথি মারছে, নিজেরা নিজেরাও রক্তারক্তি করে মরছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দুর্বিসহ লালনপ্রাপ্ত জীবন অন্য কোনো জাতি ভোগ করেছে কিনা জানা নেই। অথচ বোকার মত আমরা এখনও বিশ্বাস করি যে, আমরা আল্লাহর খুব প্রিয় জাতি, আমরা রসুলের প্রকৃত উম্মত, উম্মতে মোহাম্মদী। আমরা যে আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী নেই, কোনো মো’মেন জাতিকে আল্লাহ যে গোলামী ও লাঞ্ছনার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেন না সেটা বোঝার মত বোধশক্তিও আজ আমাদের নেই।
আমরা ভুলে গেছি এই জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে। পৃথিবীর সবচাইতে পশ্চাদপদ জাতি ছিল আরবরা। সেই আরবদের মধ্যে আসলেন আল্লাহর শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ তাঁর রসুলের মাধ্যমে মানবজাতিকে একটি দ্বীন দিলেন। আর সেই পরশপাথরের ছোঁয়ায় মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আরবের পশ্চাদপদ দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত মানুষগুলো উন্নতি-প্রগতির কোথায় গিয়ে পদার্পণ করল তা আজও মানুষের কল্পনাকে হার মানায়।
সেই জাতি বসেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে, তাদের হাতে ছিল পৃথিবীর কর্তৃত্ব, আর দায়িত্ব ছিল সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায়, অবিচার ও অশান্তি নির্মূল করে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে আজ আমরা পৃথিবীর সকল জাতির গোলাম, নেতাহীন, আদর্শহীন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষাহীন, বিশৃঙ্খল একটি জনসংখ্যামাত্র; যারা পৃথিবী থেকে অন্যায় নির্মূল করবে এমন আশা করাটাই হাস্যকর! এই গোলাম জাতি কী করে শ্রেষ্ঠ জাতির উত্তরসূরী হতে পারে? আল্লাহ যাদের অভিভাবক তাদের কি গোলাম হবার কথা?
যিনি মাত্র ৩১৩ জন মো’মেনকে ১০০০ কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী করার মাধ্যমে উম্মতে মোহাম্মদীর বিজয় অভিযান সূচনা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ছোটবড় অসংখ্য যুদ্ধে সংখ্যায় কম থাকার পরও, অস্ত্রশস্ত্রে দুর্বল হবার পরও উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটিকে তাদের চাইতে বহু বহুগুণ শক্তিশালী শত্রæর উপর বিজয় দান করেছিলেন, সেই আল্লাহ কি এখন নেই? (নাউজুবিল্লাহ) অবশ্যই আছেন। তাহলে জাতির আজ এই দুর্দশা কেন? একটাই যুক্তি রয়েছে- আল্লাহ এই জাতির অভিভাবকত্ব ত্যাগ করেছেন। আর সেটাও কেবল একটিমাত্র কারণেই হতে পারে, এই জাতি আর মো’মেন নেই।
আল্লাহর যত ওয়াদা, যত প্রতিশ্রুতি সবই মো’মেনদের সাথে। তিনি বিজয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মো’মেনদেরকে, সাহায্যের অঙ্গীকার করেছেন মো’মেনদের সাথে, পৃথিবীর কর্তৃত্ব দিতে চেয়েছেন মো’মেনদেরকে। তিনি নিজেকে অভিভাবক, বন্ধু বা রক্ষাকারী ঘোষণা করেছেন মো’মেনদের। তিনি কোথাও বলেন নি যে, আমি নামাজীদের অভিভাবক, রোজাকারীদের অভিভাবক, টুপি-পাগড়ি-পাঞ্জাবী পরিধানকারীদের অভিভাবক, মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের অভিভাবক, কোর’আন তেলাওয়াতকারীদের অভিভাবক। তিনি বলেছেন নির্দিষ্ট করে কেবল মো’মেনদের কথা। এই জাতি যদি আল্লাহকে অভিভাবক হিসেবে পেতে চায় তাহলে তাদেরকে সর্বপ্রথম খতিয়ে দেখতে হবে তারা মো’মেন হতে পেরেছে কিনা।
মো’মেন হবার প্রথম শর্ত হচ্ছে- জাতিকে তওহীদের ভিত্তিতে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এবং দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে- পৃথিবীময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জান ও মাল দিয়ে সংগ্রাম করে যাবে। (সুরা হুজরাত ১৫) দুর্ভাগ্যক্রমে আজ আমাদের না আছে ঐক্য, না আছে সংগ্রাম। তাই না আছে বিজয়, না আছে আল্লাহর সাহায্য। এই অবস্থায় যারা মানুষকে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ না করেই উত্তেজিত হয়ে জিহাদের ডাক দিচ্ছেন, রক্ত গরম করা বক্তব্য দিয়ে রাজপথ মাতিয়ে তুলছেন, কথিত মুসলমানের শত্রুদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন, তাদের এই আস্ফালন জাতির কোনো কাজে লাগবে না। এরকম আস্ফালন আমরা ইরাক যুদ্ধে দেখেছি, আফগানযুদ্ধে দেখেছি, ফিলিস্তিনে সত্তর বছর ধরে দেখে আসছি। তারও আগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনশ’ বছর ধরে দেখে এসেছি। সেই একই চিত্র- জেহাদী উন্মাদনা ছড়ানো, তারপর মারের চোটে দিশেহারা হয়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। নিকট অতীতে আমরা যতই চেতনার গরম দেখাতে গেছি, ততই মার খেয়েছি, ততই ধ্বংস হয়েছি। কারণ আল্লাহর সাহায্য আসে নি। মো’মেন না হলে ভবিষ্যতেও একই দশা হবে তাতে সন্দেহ নেই।
আল্লাহর রসুল একদিন বললেন, ‘‘শীঘ্রই এমন সময় আসবে, অন্যান্য জাতিসমূহ এই উম্মাহর বিরুদ্ধে একে অপরকে ডাকবে যেমন করে (খানা পরিবেশন করার পর) একে অন্যকে খেতে ডাকে।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হলো- ‘‘তখন কি আমরা সংখ্যায় এতই নগন্য থাকব?’’ তিনি বললেন, ‘‘না, তোমরা সংখ্যায় হবে অগণিত, কিন্তু হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত।’’ (হাদিস: সাওবান (রা.) থেকে আবু দাউদ, মেশকাত)
আল্লাহ ও রসুলের দৃষ্টিতে যারা স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনা এবং যাদেরকে মারার জন্য বিশ্বের সমস্ত জাতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একে অপরের সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের ধ্বংস ঠেকানো মুখের কথা নয়। আজ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মুসলিমমাত্রই আঁৎকে ওঠেন এই জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে গিয়ে। পৃথিবীর দিকে ভাসাভাসাভাবে তাকালেও এই জাতির অবর্ণনীয় দুর্দশা কারো চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে তারা অনিচ্ছা সত্তে¡ও ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায় এই মৃতপ্রায় জাতিটি যদি আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়, সমস্ত পরাজয় আর গোলামীর গ্লানি ভুলে নতুন করে বাঁচতে চায়, যদি তারা বিশ্বের বুকে ১৪০০ বছর আগের মতই আরেকটি নবজাগরণ ঘটাতে চায়, তাহলে সামনে পথ একটাই- তাদেরকে সর্বপ্রথম মো’মেন হতে হবে। আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ন্যায়ের পক্ষে একজন ইমামের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আল্লাহর রহমে হেযবুত তওহীদ সেই বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছে জনে জনে, দিকে দিকে।