সোয়াইব আল বান্না:
ইসলামের শত্রুরা সমস্ত মানবতা, মনুষ্যত্ব, বিবেক বিসর্জন দিয়ে আটঘাট বেঁধে মোসলেম নিধনে নেমেছে। বিভিন্ন অজুহাত প্রদর্শন করে পৃথিবীব্যাপী মোসলেম জাতির উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। কোন আইন-আদালত, নিয়ম-নীতি তাদের আগ্রাসনে এতটুকু বাধা সৃষ্টি করতে পারছে না। কমতি নেই ষড়যন্ত্রেরও। নির্বোধ জাতি সে ষড়যন্ত্রে পদার্পন করে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের ডালপালা বিস্তার করছে, এক ভাই আরেক ভাইয়ের বুকে ছুরি চালাচ্ছে। আজ চারদিকে শুধু ধ্বংসের পদধ্বনী। এ ধ্বংস এড়াবার নয়। “কান্নায় হতবিহ্বল বাবার কোলে নিষ্পাপ শিশুর রক্ত আর বারুদ মাখা লাশ, কিশোর পুত্রের ছিন্ন-ভিন্ন নিথর দেহের পাশে আহাজারি করছে পাগলিনী মা, আদরের বোনের রক্তমাখা লাশ ওড়নায় পেঁচিয়ে চোখের পানি মিশিয়ে মাটি চাপা দিচ্ছে ভাই, বাতাসে শুধু ঝাঁঝালো বারুদের গন্ধ আর অজানা আশঙ্কা, কখন যেন একটা বুলেট এসে কেড়ে নেয় প্রাণ, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির মায়া ছেড়ে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, অনেকের সেই পালানোর সুযোগটুকুও অবশিষ্ট নেই, কেবল ভয়-আতঙ্ক আর ধ্বংসের মাঝে বেঁচে থাকা, অথবা মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া”- এই হচ্ছে আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিয়ানমার ইত্যাদি মোসলেম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নিত্য দৃশ্য। টেলিভিশনের পর্দায়, পত্রিকার পাতায় এই করুণ, হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলো দেখে আর সহ্য করা যায় না। কেবল নিজেদেরকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হয়, নিজের সত্ত্বাকে, নিজের অস্তিত্বকে। আমি যদি মোসলেম হোই, ওরাও যদি মোসলেম হয় তবে ভাই হয়ে আরেক ভাইয়ের জন্য তো কিছুই করতে পারছি না। শুধু মোসলেম বলে দাবি করা। বেহায়ার মত সহাস্যবদনে নিজের স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম, ঈদের কেনাকাটা করলাম, পাঞ্জাবি-টুপি কিনলাম, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য ইচ্ছামতো কেনাকাটা করলাম। নতুন জামা-কাপড়ের পাশাপাশি কসমেটিকস্, কিছু ফার্নিচার, আরও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনলাম। নামী-দামি কত রকমের খাবারের সমারহ। ঈদুল আযহা মানেই খাবারের নতুন মাত্রা। কোরবানির গরুর গোস্ত নিয়ে আগে থেকেই কত জল্পনা-কল্পনা। অতঃপর কোরবানী হয়ে গেলে এবার ঘরে ঘরে খাবারের ধুম। চারিদিকে সুস্বাদু রান্নার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। নামাজ পড়লাম, আনন্দ করলাম, পশু জবাই করলাম, মজা করে গোস্ত খেলাম। কী নির্লজ্জ আমি, কী পাষণ্ড! ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ, বোনের উপর নির্মম নির্যাতনের খবর, সন্তানহারা মায়ের হৃদয়বিদারি ক্রন্দন, হাহাকার আমার ঈদ-আনন্দে বিঘœ ঘটাতে পারলনা না! ঈদ করছি, খুশি করছি। আনন্দ করে কি এটাই প্রমাণ করছি না যে, আমরা একজাতি নই, আমরা মোসলেম নই?আজ আমি যখন ঈদ করছি, গোস্ত-পোলাও খাচ্ছি, কথিত মুসলমানিত্বের পরিচয় দিচ্ছি, ঠিক তখন আমারই চারপাশের কত কুলাঙ্গার আমার প্রাণপ্রিয় রসুলাল্লাহকে গালাগালি করছে, তাঁর পবিত্র চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ লেপন করছে, তাঁকে হেয় করছে। কারণ রসুলের প্রকৃত শিক্ষা আমাদের মধ্যে নেই। আমরা এক নির্বোধ পশ্চাদপদ দৃষ্টিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছি। আবার দাবি করছি রসুলের উম্মত বলে। তাই আমাদেরই কৃতকর্মের দায়ে রসুলাল্লাহকে গালি দেওয়া হচ্ছে। কী দাম রইল আমার এই মুসলমানিত্বের? আমি কেমন মুসলমান? কী জবাব দেব রসুলকে?
ধিক তোকে নরপিশাচ, শত ধিক তোর মুসলমানিত্বকে, লেবাস তথা পাঞ্জাবী, টুপি, পাগড়ীকে, ধিক তোর হজ্বসহ সকল উপাসনাকে। আরে তুই তো আল্লাহর হুকুম বহু আগেই বাদ দিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের পায়ে সেজদা করেছিস। তোর মুসলমানিত্ব বহু আগেই খতম হয়ে গেছে। এই লোক দেখানো সেজদা কাকে করছিস তুই? তোর জাতির উপরে তো বহু আগেই লা’নত দিয়েছেন স্রষ্টা, এখন তো তুই শিয়া, সুন্নি, হানাফী, শাফেয়ী, হাম্বলি, আহলে হাদিস ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার আধ্যাত্মিকভাবে তুই কাদেরিয়া, নক্শবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, আহলে বাইত ইত্যাদি হয়ে আছিস। তুই তো আর উম্মতে মোহাম্মদী নেই, মোসলেম বা মো’মেন নেই। আল্লাহ বলেন, “সকল মো’মেন ভাই ভাই (সুরা হুজরাত ১০)”। রসুলাল্লাহ (দ:) বলেছেন, ‘সমগ্র উম্মতে মোহাম্মদী জাতি যেন একটা শরীর, তার একটা অঙ্গে ব্যথা পেলে সারা শরীরেই ব্যথা অনুভূত হয়’ (আব্দাল্লাহ এবনে ওমর রা: থেকে বোখারি মোসলেম আবু দাউদ)। সেই উম্মতে মোহাম্মাদীর দাবিদার, এক মোসলেম জাতির দাবিদার হাজারো লক্ষ ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি, যুদ্ধ, রক্তপাত, দাঙ্গা ইত্যাদি করছি। ফলে আমাদেরই অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে অন্য জাতিগুলিও আমাদের উপর নানা অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চালাচ্ছে। আর আমরা মহাসমারোহে ঈদ উদযাপন করছি। নামাজ পড়ছি, রোজা করছি, হজ্ব করছি। আর যখন ধর্মব্যাবসায়ী মোল্লাদের শকুনী দৃষ্টি পড়ছে আমাদের উপর তখন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, ওয়াজমাহফিল, ওরশ, মাজার ইত্যাদিতে কিছু অর্থ খরচ করে মহা দাতা বনে যাচ্ছি। একবারও ভাবছি না যে, আমরা আসলে মো’মেন, মোসলেমই নেই। কাজেই এসব দান না আমাদের, না সমাজের কোন কল্যাণ বোয়ে আনছে। এতো শুধু ধর্মব্যাবসায়ীদের কল্যাণ করা হোচ্ছে। কাজেই এই পথভ্রষ্ট, বহুধাবিভক্ত, ছিন্ন-ভিন্ন, বিজাতির করুণার পাত্র হতভাগা এই জাতির একজন সদস্য হিসাবে নিজেকে ধিক্কার জানাই। আমি আল্লাহর রসুলের কাছে কী লজ্জায় দাঁড়াবো?