আফরোজা শবনম
সমস্ত মানবজাতির মুক্তির জন্য যে ধর্মের আগমন তা কখনো নারীর মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ইসলাম এসেছে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, তা হরণ করার জন্য নয়। তৎকালীন আরব সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো কি না সন্দেহ। সেখানে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে পরিবারের লোকেরা লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়ে যেত। সদ্য জন্ম নেওয়া কন্যাকে জীবিত পুঁতে ফেলার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও ঘটত সেখানে। ওয়ারিশ হিসেবেও তাদেরকে বিবেচিত হত না। এমন একটি সমাজে ইসলামের আগমনে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পেল। নারী খুঁজে পেল তার মুক্তির পথ। অথচ তেরশ’ বছর পর আজ সেই জীবনব্যবস্থাটিই বিবেচিত হচ্ছে নারীর মুক্তির পথে অন্তরায় হিসেবে। এর কারণ অনুসন্ধান করা খুবই জরুরি।
আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবদের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবাধ বিচরণ ছিল। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারীর অংশগ্রহণ ছিল। এই অংশগ্রহণ ব্যবসা-বাণিজ্যের মত অর্থনৈতিক খাত থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত বি¯তৃত ছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের জন্য তখনকার প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল মসজিদ। আর এই মসজিদে নারীদের অবাধ বিচরণ ছিল। রসুল (সা:) এর সামনে বসে তাঁর কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষা নিয়ে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছেন। এতে ইসলাম কোন আপত্তি জানায় নি। তবে এক্ষেত্রে নারীকে তার পোশাকে ও আচরণে পর্যাপ্ত শালীনতা বজায় রাখার হুকুম দেওয়া হয়েছে। কেননা নারীর অশালীনতা, বেহায়াপনা সমাজে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দেয়। অবশ্য এই হুকুম ইসলাম শুধু নারীকেই দেয় নি, পুরুষকেও দিয়েছে।
কিন্তু আজ ধর্মব্যবসায়ীরা দ্বীনের অপব্যাখ্যা, বিকৃত ফতোয়াবাজি এবং অনেকক্ষেত্রে রসুল ও আসহাবদের নামে মিথ্যা, বানোয়াট হাদিস ও মনগড়া ঘটনার অবতারণা করে ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে অস্বীকার করেছে। একই সাথে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর ভূমিকার প্রয়োজনীয়তাকেও অবমূল্যায়ন করেছে। তারা দেখাতে চেষ্টা করেছে, ইসলাম নারীকে ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে শুধুমাত্র পরিবারের লোকেদের সেবা করার হুকুম দিয়েছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে ভূমিকা রাখার কোন এখতিয়ার ইসলাম তাদের দেয় নি। ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাশ্রেণির এই ফতোয়াবাজির ফল হয়েছে দুইটি। প্রথমত, ধর্মভীরু নারীরা তাদের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে। কখনো একান্ত প্রয়োজনে বাইরে আসতে চাইলে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে কিম্ভূতকিমাকার রূপ নিয়ে তবেই বের হয়। এভাবে তারা সমাজের মূল প্রবাহ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সমাজের অগ্রযাত্রায় তাদের কোন ভূমিকা নেই। আর দ্বিতীয় ফলটি হয়েছে এই যে, ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়ার বেড়াজালে বন্দি নারীদের একটি শ্রেণি খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের মুক্তির উপায় খুঁজতে চেয়েছে। আর এই সুযোগটির পূর্ণ ব্যবহার করেছে পশ্চিমা সমাজ। অধিকারহারা নারী তার মুক্তির পথ হিসেবে পশ্চিমা সভ্যতা ও তাদের নগ্ন সংস্কৃতিকে বিবেচনা করতে বাধ্য হল। আজকে আমাদের সমাজে নারীর যে চারিত্রিক অধঃপতন তার পেছনে এই ধর্মব্যবসায়ীরা অনেকাংশেই দায়ী, তা তারা যতই অস্বীকার করুক। তারাই নারীকে এই অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ইসলাম নারীকে একই সাথে যে অধিকার ও সম্মান দিয়েছে পৃথিবীর কোন জীবনব্যবস্থাই তা দিতে পারে নি। আজ যে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নারীর মুক্তির পথ হিসেবে বলা হচ্ছে, এই সভ্যতা নারীকে মুক্তির নামে লাগামহীন করেছে, স্বাধীনতার নামে বেহায়াপনা শিখিয়েছে। কিন্তু ইসলাম এক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রেখেছে। সমাজের সর্বস্তরে ভূমিকা রাখার জন্য যেমন উদ্বুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে নিজেকে সংযত রাখার উপদেশও দিয়েছে। আজ ধর্মব্যবসায়ীদের কূপমণ্ডূকতা ও সেই সুযোগে ইসলামবিদ্বেষীদের অপপ্রচারের আড়ালে প্রকৃত ইসলামে নারীর যে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে তা সবার তুলে ধরার সময় এসেছে। এবং একই সাথে নারীকে ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মবিদ্বেষী উভয় শ্রেণির হাত থেকে উদ্ধার করে সত্যিকার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সময়োচিৎ পদক্ষেপও নিতে হবে।