মুস্তাফিজ শিহাব
ইসলামে স্তম্ভ পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে কলেমা, ঈমান বা তওহীদ, সালাহ বা নামাজ, সওম বা রোজা, হজ ও যাকাত। সর্বপ্রথম কলেমা হচ্ছে ইসলামে প্রবেশের মূল। এরপর বাকিগুলো হচ্ছে আমল। কিন্তু আমাদের সমাজে বর্তমানে একটি ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে যে নামাজ জান্নাতের চাবি। এ কথাটি আল হাদিস হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, অনেকে এমন কি ভুল করে এটিকে আল কোর’আনের বাণী বলেও লিখে থাকেন। আমরা ইসলামের বিষয়ে যখন কোন কথা বলবো তখন আমাদের উচিত কোর’আন, হাদিসের পাশাপাশি যুক্তিকেও প্রাধান্য দেয়া। কারণ আল্লাহর রসুল স্বয়ং বলেছেন- এ দীনের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি (কিতাবুল শেফা, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৮৭)।
সালাহ ইসলামে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কিন্তু সালাহর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তওহীদ। কোর’আনে মহান আল্লাহ ৮০ বারের বেশি সালাহ এর কথা বলেছেন কিন্তু তিনি কখনও বলেন নি যে সালাহ না করলে জান্নাত দিবেন না বা জান্নাতের মূল শর্ত সালাহ। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে যতগুলো আয়াতে সালাহর কথা বলেছেন তার প্রতিটি তিনি বলেছেন তাদের যারা তওহীদকে মেনে নিয়ে মো’মেন হয়েছেন। আমি এখানে দুইটি আয়াত দিয়ে উদাহারণ দিচ্ছি। “আপনি বলে দিন তাদের যারা মো’মেন হয়েছে, তারা যাতে সালাহ কায়েম রাখে ও আমার দেয়া রিযিক থেকে প্রকাশ্যে ব্যয় করে সেদিন পর্যন্ত যেদিন কোন কেনা-বেচা নেই আর কোন বন্ধুত্বও নেই (সুরা ইবরাহিম ১১)।” এছাড়াও আল্লাহ অপর জায়গায় বলেছেন, “হে মো’মেনগণ, তোমাদের জন্য সওম ফরজ করা হয়েছে যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য (সুরা বাকারাহ ১৮৩)।” কোর’আনে মো’মেনদেরকে নির্দেশ করে এমন প্রচুর আয়াত রয়েছে। নামাজ কে জান্নাতের চাবি বলা হলেও জান্নাতে যাওয়ার শর্তে আল্লাহ স্পষ্ট তওহীদকে নির্দিষ্ট করেছেন। আল্লাহ কোর’আনে বলেন, “হে মো’মেনগণ আমি কি তোমাদের এক উত্তম বাণিজ্যের সন্ধান দিব যা তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে? তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনবে ও আল্লাহর পথে সর্বাত্মক সংগ্রাম করবে, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ (সুরা সফ ১০,১১)।” অপর জায়গায় আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ মো’মেনদের থেকে তাদের জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে (সুরা তওবা ১১১)।” স্পষ্ট যে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশের যে কয়টি শর্ত দিচ্ছেন সে সকল শর্তেই আল্লাহ তওহীদ ও সর্বাত্মক সংগ্রাম এ দুটোকে অধিক প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাই কোর’আনের বিধানগুলো যদি আমি দেখি তবে এটা স্পষ্ট হয় যে জান্নাতের চাবি বা শর্ত সালাহ হতে পারে না।
এবার হাদিসে আসি। বুখারি শরিফের প্রসিদ্ধ একটি হাদিস, “ওয়াহিব ইবনে মুনাব্বিহ (র.) থেকে বর্ণিত, তাকে জিজ্ঞেস করা হল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কী জান্নাতে চাবি নয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই।” আল্লাহর রসুল বলেছেন, “যে হৃদয়ে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (স.) তাঁর রসুল, আল্লাহ তাঁর জন্য জাহান্নাম হারাম করে দিবেন (ওবায়দাহ বিন সোয়ামেত (রা.) ও আনাস (রা.) থেকে বুখারী ও মুসলিম)।” অপর জায়গায় আল্লাহর রসুল স্পষ্ট বলেছেন, “জান্নাতের চাবি হচ্ছে তওহীদ (মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে আহমদ)।” এরকম আরো অনেক হাদিস রয়েছে যেখানে আল্লাহর রসুল তওহীদকে জান্নাতের মূল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু ঘটনাও রয়েছে। “আল্লাহর রসুল একদিন বললেন, যে ব্যক্তি বলল আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই সে জান্নাতে যাবে। এ কথা শুনে আবু যার (রা.) বলেন যদি সে চুরি ও ব্যাভিচার করে তবুও জান্নাতে যাবে? রসুলাল্লাহ জবাব দিলেন, হ্যাঁ। সাহাবী বিস্মিত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, চুরি ও ব্যভিচার করলেও জান্নাতে যাবে? রসুল জবাব দিলেন, হ্যাঁ সে চুরি করলেও, ব্যভিচার করলেও এমনকি আবু যরের নাক মাটিতে ঘষে দিলেও (বুখারী ও মুসলিম)।” ইবনে ইসহাক বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁর কাছে এ মর্মে বর্ণনা করা হয়েছে রসুলুল্লাহ (স.) যখন মুয়াজকে (রা.) দূত হিসেবে পাঠান তখন কতিপয় উপদেশ দেন ও তাঁর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “সহজভাবে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবে, কঠিনভাবে নয়। তাদের মনে আশার আলো জাগাবে, বীতশ্রদ্ধ করে দেবে না। আহলে কিতাবের একটি গোষ্ঠির সাক্ষাৎ পাবে। ওরা জিজ্ঞেস করবে যে জান্নাতে চাবি কি? তুমি তাদের বলবে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- এ সাক্ষ্য প্রদানই জান্নাতে চাবি (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ৩৩০)।” অতএব হাদিস মতেও যদি আমি দেখি তবে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র উপায়, জান্নাতে যাওয়ার চাবি, হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
এবার দেখা যাক এই ধারণাটি যুক্তির নিরিখে কতটুকু টেকসই। আল্লাহ যুগে যুগে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নবী-রসুল প্রেরণ করেছেন (সুরা ইউনুস ৪৭)। প্রতিটি নবী রসুল তাঁদের সম্প্রদায়ের জন্য একটি বাণীই নিয়ে এসেছিলেন আর তা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। যেমন- আদম (আ.) এর সময় কলেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আদম শাফিউল্লাহ’, মুসা (আ.) এর সময় ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুসা কালিমুল্লাহ’, ইবরাহীম (আ.) এর সময় ছিল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইবরাহীম খালিলুল্লাহ’ এবং সর্বশেষ আমাদের রসুলের সময় ছিল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ’। প্রতিটি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই মূল মন্ত্র ছিল ঐ একটিই, তওহীদ। শুধু সময়ের পরিবর্তনে রসুলের নামে পরিবর্তন এসেছে। একটি ছোট বাক্স খুলতে চান বা বিরাট বড় রাজ প্রাসাদের সিংহদরজা, আপনার চাবি প্রয়োজন পড়বেই। তাহলে চাবির গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। যদি সালাহ জান্নাতের চাবি হয় তবে পূর্ববর্তী উম্মাহর উপর বর্তমানের সালাহ ছিল না। তাহলে কী আল্লাহ তাদের জান্নাতে ঢুকাবেন না? প্রথম নবী আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত সকল নবীর মাধ্যমেই আল্লাহ যে মূলমন্ত্র প্রেরণ করেছেন অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সেটিই জান্নাতের চাবি হওয়া উচিত। মক্কায় আল্লাহর রসুল নবুয়্যাত লাভের ১১ বছর পর সালাহ এর বিধান আসে। তাহলে এই সালাহ আসার আগে কী আল্লাহর রসুলের কোন সাহাবী ইন্তেকাল করেন নি? তারা কী তবে জান্নাতে যাবেন না? অবশ্যই যাবেন কারণ তারা তওহীদকে মেনে নিয়েছিলেন। সর্বশেষ যুক্তি যদি আমি দেই তবে বলবো, ধরুন আপনার কাছে একজন অমুসলিম এসে বললো যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চায়। তবে আপনি তাকে প্রথমে কোনটি বলবেন? কলেমা পড়তে নাকি সালাহ করতে?
পরিশেষ ‘অজু নামাজের চাবি আর নামাজ জান্নাতের চাবি’- বলে যে হাদিসটি আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেটি জয়িফ হাদিস। উক্ত হাদিসটি মুসনাদে আহমদ শরীফ, তিরমিজি ও মিসকাত শরিফে রয়েছে। কিন্তু হাদিসটি জইফ কারণ এর সনদে দুজন দুর্বল রাবি রয়েছেন যারা হচ্ছেন, সুলাইমান বিন করম ও আবু ইয়াহিয়া আল-কাত্তাত (আলবানি, মিসকাত হা/২৯৪ এর টিকা দ্রষ্টব্য)। আল্লাহর রসুল নিজে যেখানে বলেছেন যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হচ্ছে জান্নাতের চাবি সেখানে সালাত কে জান্নাতের চাবি বলার কোন কারণ থাকে না। আল্লাহর রসুল কখনই একটি বিষয়ের উপর দুইটি ভিন্ন মতামত দিতে পারেন না। কলেমা বা তওহীদ এই দীনের ভিত্তি এবং সালাত হচ্ছে এ দীনের খুঁটি। দুইটি একদম ভিন্ন দুটি বিষয়। একটি ঈমান যা ছাড়া ইসলামে আসা অসম্ভব আরেকটি আমল। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি পরীক্ষায় পাশ করার জন্য আপনার ন্যূনতম ৩৩ নম্বর দরকার এরপর আপনি যা পাবেন তা আপনার মান বৃদ্ধি করবে আপনাকে তালিকায় উপরে নিতে সহায়তা করবে। তেমনি তওহীদ হচ্ছে সর্ব প্রথমে যা আপনাকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করবে ও পুরস্কারস্বরূপ জান্নাতে ঢুকার জন্য পাশ নম্বর দিবে এরপর হচ্ছে সালাহ, সওম, যাকাত, হজ যেগুলো আপনার জান্নাতের স্তর বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। তাই আমাদের এখন জান্নাতের মূল চাবিকে হাতে নিতে হবে। তওহীদ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এ কথার উপর নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক মোটকথায় সার্বিক জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবেই আমরা হব মো’মেন, আমরা হব সফলকাম।