রাকীব আল হাসান
একবার একটা ব্যাগের মধ্যে কয়েকটা মুরগির বাচ্চা নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ব্যাগটা এমন ছিল যেন মুরগির বাচ্চাগুলো মাথা বের করে বাইরের আলো-বাতাস নিতে পারে। হঠাৎ একটা জায়গাতে গিয়ে দেখি কয়েকটা কুকুর আমার দিকে লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে আগাচ্ছে। জিহ্বাটা এক হাত লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে, অনবরত লালা ঝরছে আর গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে আগাচ্ছে।
আমি বুঝলাম আমার হাতের এই মুরগি ছানার প্রতি তার এই লালসা। পেছনেই কুকুরের মালিক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বললাম- আপনার কুকুরকে সামলান, অন্যের জিনিসের প্রতি এমন লালসা ভালো নয়। তাদেরকে এ শিক্ষা দেন না? লোকটি বলল- আমার কুকুরের কী দোষ? আপনার মুরগি ছানাগুলোকে যদি একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে করে নিয়ে যেতেন তাহলে তো আর কুকুরগুলো ওটা দেখতে পেত না। হাড্ডি দেখলে সে তো লালায়িত হবেই।
পরের দিন লোকটাকে শুধু শিক্ষা দেবার জন্য একটা কাঠের বাক্সে মুরগি ছানা নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে গেলাম, এবারও কুকুরগুলো ঠিক ঘ্রাণ পেয়েছে আর মুরগি ছানাগুলোর কিচিরমিচির ডাক শুনতে পেয়েছে। তখন কুকুরগুলো আগের দিনের মতোই আচরণ করছে। লোকটিকে আবার বললাম- ভাই, আপনার কুকুরগুলোকে একটু শিক্ষা দেন, যেন তাদের লালসাকে তারা নিবৃত্ত করে। লোকটি এবারও বলল- দেখুন ভাই, আপনার মুরগি ছানাদের দোষ আছে, তারা কেন কিচিরমিচির করে? তাদেরকে কি জীবনের মায়া নেই? আমি বুঝলাম লোকটাকে বলে আর লাভ নেই। কুকুরের জন্য চাই মুগুর। এ রাস্তা দিয়ে যেতে হলে একটা মুগুর নিয়ে যেতে হবে। কুকুর এদিকে আগালেই মুগুর দিয়ে কয়েকবার কষে মারলে তাদের শিক্ষা হবে।
নারীদের হেযাবের ব্যাপারেও বর্তমানে একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। আমরা হেযাবের ব্যাপারে যত ওয়াজ-নসিহত শুনি তার প্রায় সমস্ত আলোচনা জুড়েই থাকে নারীদের প্রসঙ্গ। নারীদেরকে বলা হয়- তোমরা বাইরে বের হবে না, তোমাদের অবস্থান রান্না ঘরে। মহলে থাকার জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, এজন্য তোমাদেরকে মহিলা বলা হয়। যদি অতি প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাহলে এমনভাবে নিজেদেরকে আবৃত করবে যেন মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত কিছুই দেখা না যায়। হাতে-পায়ে মোজা পরবে, মুখে নেকাব দেবে, চোখে কালো গ্লাস অথবা পাতলা কাপড় দেবে। এমনভাবে কথা বলবে যেন কণ্ঠ কোনোভাবেই উচু না হয়, কেউ যেন তোমার কণ্ঠ শুনতে না পারে। যদিও কেউ শুনে ফেলে সেটা যেন কর্কশ আওয়াজ হয়। এভাবে বলতে গেলে শেষ হবে না। পুরুষদের দৃষ্টি সংযত করার ব্যাপারে তেমন কোনো ওয়াজই শোনা যায় না। ঠিক যেন ঐ কুকুরের মালিকের মতো।
যখনই কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তখন একটা শ্রেণি নির্ণয় করতে বসে তার গায়ে কী পোশাক ছিল। ওয়াজ শুরু হয়ে যায়, তার এই পোশাকের কারণেই আসলে তাকে ধর্ষিতা হতে হলো। এর ফলে ধর্ষকের দোষটা কিছুটা হলেও কি চাপা পড়ল না? যুক্তির খাতিরে যদি প্রশ্ন করি- ইদানীং তো পত্র-পত্রিকাতে শিশু ধর্ষণ, পুরুষ শিশু বলাৎকারের ঘটনাও দেখা যাচ্ছে অনেক। এ ক্ষেত্রেও কি পোশাক দায়ী? সমাজটা এখন পুরো ভারসাম্যহীন। একদিকে চলছে পাশ্চাত্যদের হুকুম-বিধান অন্যদিকে চলছে ধর্মের নামে মোল্লা-পুরোহিতদের মনগড়া বিধান। পাশ্চাত্যদের অনুসরণকারীরা একেবারে নগ্ন হয়ে দেহ প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছে আর ধর্মব্যবসায়ী কূপমণ্ড‚ক একটা শ্রেণি নারীদেরকে একেবারে ঘরে বন্দি করে রাখতে চাচ্ছে।
অথচ মহান আল্লাহ ভারসাম্যপূর্ণ একটা হেযাব (শালীনতাপূর্ণ চলাফেরা) পদ্ধতি দিয়েছেন। পুরুষ এবং নারী উভয়কে বলা হয়েছে তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে, তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। (সুরা নুরের ৩০ ও ৩১ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)। নারীদের যেহেতু বাড়তি সৌন্দর্য রয়েছে তাই সেই বাড়তি সৌন্দর্য আবৃত করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। চাদরের কিছু অংশকে বুকের উপর টেনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এমনভাবে সেটাকে নিতে বলা হয়েছে যেন তাদেরকে দেখে চেনা যায় (সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)।
এখন ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে, না হলে একদিকে নগ্নতাও বাড়বে আবার অন্যদিকে নারীদের উপর মোল্লাতান্ত্রিক যুলুমও বাড়বে। পাশ্চাত্যদের কাছে আত্মিক শিক্ষা, ধর্মের শিক্ষা, স্রষ্টার হুকুম এগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই (তারা আত্মা, স্রষ্টাতে বিশ্বাসী না)। বিয়ে ব্যবস্থা তারা প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলেছে। এবার অবাধ করে দিয়েছে যৌন সম্পর্ক। পোশাক করেছে সংকীর্ণ, খোলামেলা। তাদের ধারণা- যেহেতু যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য মানুষ অন্যের উপর জোর-জবরদস্তি করে তাই এটাকে অবাধ করে দিলে মানুষ আর কারো উপর জবরদস্তি করবে না, সুতরাং ধর্ষণও হবে না। আসলে রিপুগুলো এমন নয় বরং ঠিক এর উল্টো। প্রাপ্তিতে লালসা আরও বৃদ্ধি পায়, নিয়ন্ত্রণে তা কমে। কিন্তু শুধুই নিয়ন্ত্রণ অপ্রাকৃতিক, তাই ভারসাম্যপূর্ণভাবে অভাবও মেটাতে হবে। পাশ্চাত্যদের ঐ ধারণা যে ভুল এবং তাদের ঐ কার্যের ফল যে উল্টো হচ্ছে তা তাদের সমাজের দিকে তাকালেই, তাদের দেশে অপরাধের পরিসংখ্যান দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
যে কোনো অপরাধ দূর করতে হলে তিনদিক দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। চুরি বন্ধ করতে হলে প্রথমে মানুষের অভাব দূর করতে হবে যেন কেউ চুরি করতে বাধ্য না হয়। এরপর আত্মিকভাবে প্রত্যেককে চুরি না করার শিক্ষা দিতে হবে, যেন ভেতর থেকে প্রতিটা মানুষের আত্মা চুরি করার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করে। এরপরও চুরি করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। -এই হলো ভারসাম্য।
ঠিক একইভাবে সমাজ থেকে ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে বৈধ উপায়ে জৈবিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা অর্থাৎ সহজে বিয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেন জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য অন্য কোথাও গমন করা না লাগে, মানুষকে কামরিপু নিয়ন্ত্রণের জন্য, দৃষ্টি সংযত করার জন্য নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যেন তার আত্মা ভেতর থেকে এই পাপকাজে বাধা দান করে। এরপর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে, প্রত্যেক অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে, কোনোভাবেই যেন অপরাধী প্রভাব-প্রতিপত্তি বা অর্থের জোরে পার পেয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। – এটা হলো ভারসাম্য। এই ভারসাম্য যে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যাবে সেখানে আর এই অন্যায়গুলো হবে না। এভাবে প্রতিটা অন্যায়, অপরাধের জন্যই ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা করা না গেলে দিনকে দিন অন্যায় বাড়তেই থাকবে। প্রকৃত ইসলাম হলো ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা (দীনুল ওয়াসাতা)। ইসলামের সঠিক শিক্ষাই পারে সমস্ত অন্যায়, অবিচার দূর করতে।