রিয়াদুল হাসান :
কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত ‘মহাভারত’ দ্বিতীয় খণ্ডে ধর্মের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- “প্রাণীগণের অভ্যুদয়, ক্লেশনিবারণ ও পরিত্রাণের নিমিত্তই ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে; অতএব যাহা দ্বারা প্রজাগণ অভ্যুদয়শালী, ক্লেশবিহীন ও পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয়, তাহাই যথার্থ ধর্ম্ম।” (মহাভারত ২য় খণ্ড: শান্তিপর্ব, নবাধিকশততম অধ্যায়- পৃষ্ঠা: ৬৪৪)।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক শৈলেন্দ্র বিশ্বাস এম. এ প্রণীত সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধানে ধর্ম শব্দের অর্থ করা হয়েছে- ‘স্বভাব, শক্তি, গুণ’ অর্থাৎ বস্তুর অভ্যন্তরস্থ সেই নীতি যা সে মেনে চলতে বাধ্য থাকে, যা তার স্বকীয়তা বজায় রাখে। সুতরাং যা মানুষের স্বকীয়তা বজায় রাখে, মানবতা জাগ্রত করতে সহায়তা করে তাই মানুষের ধর্ম। ধর্মের মূল লক্ষ্যই হলো মানবতার কল্যাণ, সমগ্র সৃষ্টির কল্যাণ, বিশ্বসংসারের কল্যাণ। প্রতিটি পদার্থ, প্রতিটি প্রাণীরই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতিগত কিছু গুণাগুণ থাকে যাকে উক্ত পদার্থ বা প্রাণীর ধর্ম বলে। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, উত্তাপ দেওয়া, আলো দেওয়া। আগুনের এই গুণ সনাতন, শাশ্বত। লক্ষ বছর আগেও আগুন পোড়াতো, লক্ষ বছর পরও পোড়াবে। এটাই তার ধর্ম। এখন যদি আগুন কোনো কারণে পোড়াতে ব্যর্থ হয়, উত্তাপ না দেয়, আলো নির্গত না করে তবে ঐ আগুনকে কি আগুন বলা যাবে? সে তো শুধু আগুনের প্রতিচ্ছবি, অর্থাৎ শুধুমাত্র আগুনের অবয়ব ধারণ করে আছে। একইভাবে হীরক যদি তার কাঠিন্য, ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য হারায় তবে তাকে আপনি কী বলবেন? বাঘ যদি তার হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা, শক্তি, সাহস হারায় তবে সে বড় দেহধারী বিড়াল ছাড়া আর কী? একইভাবে মানুষেরও কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, ধর্ম রয়েছে; এই ধর্মগুলির কারণেই সে মানুষ, তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তাহলে মানুষের সেই ধর্মগুলি কী? মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্যতা, বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবেই পরিগণিত হবার যোগ্য। এতে সে স্রষ্টার পূজা-উপাসনা-অর্চনা, নামাজ, রোজা, স্রষ্টার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করুক আর না করুক। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যখন হারিয়ে যায় তখন তার কোনো ধর্ম থাকে না। সে তখন ধর্মহীন হয়ে যায়। তার মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। এটাই আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন- তারা চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট (সুরা আ’রাফ- ১৭৯)।
কাজেই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো ধর্মের মানুষ এমনকি ধর্ম অস্বীকারকারী তথা নাস্তিক ব্যক্তিও যদি দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পতিত হয় তবে তার সমপরিমাণ দুঃখ সকলের অনুভব করা উচিত। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা মুসলিম যে ধর্মেরই অনুসারী হোক বর্তমান পৃথিবীর নির্যাতিত ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তস্রোত যদি কারোর চক্ষুকে অশ্র“সিক্ত না করে, আফ্রিকার হাড্ডি-কঙ্কালসার মানুষগুলোর ক্ষুধা, দুঃখ, দারিদ্র্য যদি কারোর বিবেককে আন্দোলিত না করে, ভারতের ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ যদি কারোর কর্ণকুহরে না পৌঁছে, পৃথিবীব্যাপী মানুষে মানুষে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত, হানাহানি চললেও যদি কেউ ভালোই থাকে তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই যে সে তার মানবীয় ধর্ম হারিয়েছে। সুতরাং সে আর মানুষ নেই, পশুতে পরিণত হয়েছে। আর এমন মানুষ দিয়ে যখন সমাজ পরিপূর্ণ হয়ে যায় তখন সেই সমাজকে আর মনুষ্যসমাজ না বলে শ্বাপদসংকুল অরণ্য বলাই যুক্তিযুক্ত হবে। এই পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাস করার কোনো অধিকার এই মানুষ নামের জন্তু জানোয়ারদের নেই। যদি সে স্রষ্টার উপাসনা-এবাদত, পূজা অর্চনা করে আকাশ-পাতাল পরিপূর্ণও করে ফেলে তথাপি সে ধার্মিক হতে পারবে না। দাহ্যশক্তিহীন আগুন যেমন ধর্মহীন, মূল্যহীন, তেমনি মনুষ্যত্বহীন বিবেকহীন, মানবতাহীন মানুষও ধর্মহীন, মূল্যহীন।