কাজী নজরুল ইসলাম:
যে স্বধর্মে পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার কর্ম-ক্ষেত্রে প্রবেশের কোনো অধিকার নাই। আজ যাঁরা দেশের কর্মী বলে খ্যাত, তাঁদের অনেকেই অনধিকারী বলেই ক্ষেত্রে লাঙ্লই চালিয়ে গেলেন, ফসল আর ফল্ল না। সামান্য যা’ ফসল ফল্ল, তাকে রক্ষা করার প্রহরী, সৈন্য পেলেন না। যিনি নিজে স্বাধীন হলেন না, তিনি দেশের, জাতির স্বাধীনতা আনব্নে কেমন করে। যাঁর নিজের লোভ গেল না, যিনি নিজে দিব্য সত্তা লাভ করেননি, তিনি কেমন করে লোভীকে তাড়াবেন, কোন শক্তিতে দৈত্য, অসুর, দানবকে সংহার করবেন? ধর্মভাব মানে এ নয় যে শুধু নামাজ, রোজা, পূজা, উপাসনা নিয়েই থাকবেন। কর্মকে যে ধার্মিক অস্বীকার করলেন, কর্মকে সংসারকে যিনি মায়া বলে বিচার করলেন, কর্ম, সংসার ও মায়ার স্রষ্টার তিনি বিচার করলেন। যিনি একমেবা দ্বিতীয়ম্ যাঁর কোন শরীক্ নাই, যিনি একমাত্র বিচারক, তাঁর সৃষ্টির বিচার করবে কে? এই পলাতকের শাস্তি সঞ্চিত আছে। তবে মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে হয়, একেবারে পগার পার হয়ে গেলে চলবে না। সমুদ্রের জল আকাশে পালিয়ে যায় বলেই বৃষ্টিধারা হয়ে ঝরে পড়ে। নবনীরদ পাহাড়ে পালিয়ে যায় বলেই নদী-স্রোত হয়ে ফিরে আসে। এই উপরের দিকে উড়ে যাওয়া-অর্থাৎ আমাদের পরম প্রভুর ধ্যান করা মানে সময় নষ্ট করা নয়, আমাদেরই না-জানা পূর্ণতাকে স্বীকার করা; আমারই ঘুমন্ত অফুরন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। নির্লোভ, নিরহঙ্কার, দ্বন্দ্বাতীত হলে-লোভ, অহঙ্কার ও দ্বন্দ্বের মাঝে নেমে অবিচলিত শান্ত চিত্তে কর্ম করা যায়। প্রশংসা, জয়ধ্বনি, অভিনন্দন তখন কর্মীকে ফানুসের মত ফাঁপিয়ে তোলে না। নিন্দা, হিংসা, অপমান, পরাজয় তখন কর্মীকে নিরাশ করতে পারে না, তাঁর অটল ধৈর্য ও বিশ্বাসকে টলাতে পারে না। মন্দ-ভালো দুয়ের মধ্যেই ইনি পূর্ণ-অভয়চিত্তে বিচরণ করতে পারেন। তসবী অর্থাৎ জপমালা ও তরবারি দুই-ই তখন তাঁর সমান প্রিয় হয়ে ওঠে। সত্ত্ব, রজঃ, তম: তিনগুণের অতীত হয়েও ইনি ঐ তিনগুণে নেমে বিপুল কর্ম করতে পারেন। এই সেনাপতি সাগরের মত কখনো শান্ত, অখনো অশান্ত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। এঁরই আহ্বানে, এরই আকর্ষণে ছুটে আসে দেশ-দেশান্তর থেকে স্রোতস্বিনী দুর্নিবার অনিরুদ্ধপ্রবাহ নিয়ে।
ত্যাগ ও ভোগ-দুয়েরই প্রয়োজন আছে জীবনে। যে ভোগের স্বাদ পেল না, তার ত্যাগের সাধ জাগে না। ক্ষুধিত উপবাসী জনগণের মধ্যে এই সেনাপতি, অগ্রনায়ক আগে প্রবল ভোগের তৃষ্ণা জাগান। অবিশ্বাসী নিদ্রাতুর জনগণের বুকে রাজসিক শক্তি জাগিয়ে তাদের তামসিক জড়তা নৈরাশ্যকে দূর করেন। রাজসিক শক্তিকে একমাত্র সাত্ত্বিকী শক্তি নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। এই ভগ্নতন্দ্রা বিপুল গণ শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করেন যে অগ্রনায়কের কথা বলেছি তিনি।
জনগণকে শুধু ঊর্ধ্বে কথা বললে চলবে না। তাদের বুকে ভালো খাবার, ভালো পরবার উদগ্র তৃষ্ণাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এই জাগ্রত ক্ষুধিত সিংহ ও সুন্দর বনের বাঘের দল যাতে উৎপাত না করে, তার ভার নেবেন সেই মায়াবী অগ্র-নায়ক। যিনি এই ভীষণ শক্তিকে জাগাবেন, তাকে সংযত করার শক্তি যেন তাঁর থাকে। নৈলে জগৎ আবার পশ্চিমের রাজসিক উন্মত্ততায় রক্ত পঙ্কিল হয়ে উঠবে। নিজেরাই হানাহানি করে মরবে।
এদের ভোগের ক্ষুধাও জাগাতে হবে, ত্যাগের আনন্দে রসের তৃষ্ণাও জাগাতে হবে।
আমি একবার ‘নিউমার্কেটে’র পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি, এক ভদ্রলোকের নগ্নবক্ষে যজ্ঞোপবীত, আর দুই হাতের এক হাতে একগোছা রজনীগন্ধা ও আর এক হাতে দুইটি রাম পাখি মুর্গী। আমার অত্যন্ত আনন্দ হল, তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললাম: “ফেয়ার ও ফাউলের” এমন “কম্বিনেশন”সঙ্গতি আর দেখি নাই! ভদ্রলোকও আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন: “নিত্য আপনার হাতে ফুল, পাতে মুরগি পড়–ক।”
মুরগির সাথে রজনীগন্ধার তৃষ্ণাও খাকবে?
বড় ত্যাগ তাঁর জন্য, যিনি সকলকে বড় করবেন। জনগণকে তাই বলে ধর্মের আশ্রয়চ্যুত করবার অধিকার করুর নেই। এ অধিকারচ্যুত করতে চাইবেন যিনি, তিনি মানবের নিত্য কল্যাণের, শান্তির শত্র“। মানুষের অন্নবস্ত্রের দুঃখ রাজসিক শক্তি দিতে পারে না। মানুষ পেট ভরে খেয়ে, গাভরা বস্ত্র পেয়ে সন্তুষ্ট হয় না, সে চায় প্রেম, আনন্দ, গান, ফুলের গন্ধ, চাঁদের জ্যোৎস্না যদি শোকে সান্তনা দিতে না পারেন, কলহ বিদ্বেষ দূর করে সাম্য আনতে না পারেন, আত্মঘাতী লোভ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে না পারেন, তা হলে তিনি অগ্রনায়ক নন। ধর্ম ও কর্মের যোগসূত্রে যদি মানুষ না বাঁধা পড়ে, তাহলে মানুষকে এমনি চিরদিন কাঁদতে হবে।