রিয়াদুল হাসান
ন্যায় ও সত্যকে আংশিক পরিত্যাগ করা যায় না, ধর্মের পরিত্যাগ মানেই স¤পূর্ণ ধর্মত্যাগ। এক মণ দুধকে অপেয় করতে এক ফোটা গোমুত্রই যথেষ্ট। অর্ধসত্য যা মিথ্যাও তা। ইসলামে শেরক হচ্ছে তেমনই একটি বিষয় যা ধর্মবিশ্বাস ও যাবতীয় সৎকর্মকে বিনষ্ট করে দেয়। কিন্তু সেটা কীভাবে দেয়?
সুরা বাকারা ৮৫ নম্বর আয়াতটি এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও চমকপ্রদ ধারণা প্রদান করে। বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেও আয়াতটি প্রাসঙ্গিক। আল্লাহ বলেন, “তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারা কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিষ্কার করাই ছিল তোমাদের জন্য অবৈধ।” বোঝা যাচ্ছে মানুষকে আটক করে বা বহিষ্কার করে বাণিজ্য করা বর্তমান সময় যেমন হচ্ছে ২০০০ বছর আগের ইহুদিদের মধ্যেও ছিল।
এর পরের অংশটি শেরকের সংজ্ঞা। আল্লাহর বিধানের (সত্যের) আংশিক মানা আর আংশিক অস্বীকার করাই হচ্ছে শেরক। কেননা সেই সত্যের শূন্যস্থান অনিবার্যভাবে মিথ্যা দ্বারাই পুরণ করতে হয়। আল্লাহ বলছেন, “তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দুগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম স¤পর্কে বে-খবর নন।”
আমাদের পার্থিব দুর্গতি তো দৃশ্যমান বাস্তবতা, বাকি অংশ সময়ের অপেক্ষা। ধর্মের কোন অংশ না মানার কারণে আল্লাহ এই আয়াতটি অবতীর্ণ করলেন সেটা আমাদের বোঝা প্রয়োজন আছে।
লক্ষ্য করুন, ইহুদি জাতি কেতাবে (ধর্মের) কোন অংশকে অমান্য করেছিল, যে অংশটি পুনরায় জাতির মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে আল্লাহ ঈসাকে (আ.) পাঠিয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে ধর্মের আধ্যাত্মিক ভাগ, মানবতা, মায়া, দয়া, করুণার ভাগ। নির্জীব উপাসনাভিত্তিক ধর্মচর্চা থেকে প্রাণময় ভারসাম্যপূর্ণ ধর্মের দিকে বনি ইসরাইলকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই করুণার অবতার ঈসার (আ.) আবির্ভাব হয়।
পূর্ববর্তী আয়াতে তা সুস্পষ্ট। আল্লাহ বলেন, “যখন আমি বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও প্রতিনিধিত্ব করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও দীন-দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, সালাহ প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দেবে, তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, তোমরাই অগ্রাহ্যকারী।” (বাকারা ৮৩) ধর্মের নির্দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে তওহীদের উপর বিশ্বাস যার মর্মার্থ হচ্ছে সর্বাবস্থায়, জীবনের সর্ব অঙ্গনে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার অঙ্গীকার। এর পরে আসে আমল বা কাজ। সেই আমলগুলোর সবই হচ্ছে সামাজিক শান্তির লক্ষ্যে যেমন পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও দীন-দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার, মানুষকে সদুপদেশ দান, অর্থ দান কেবল একটি কাজ অর্থাৎ সালাহ প্রতিষ্ঠাকে আনুষ্ঠানিক উপাসনা হিসাবে মনে করা হয়। কিন্তু আসলে সালাহ হচ্ছে মানবতার কল্যাণে কাজ করতে পারার জন্য যে চরিত্র লাগে, আত্মীক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য লাগে তা অর্জনের প্রশিক্ষণ, অর্থাৎ আমলের প্রশিক্ষণ।
ইহুদিরা যেটা করেছিল তা হচ্ছে, তারা কেবল সাবাথের দিনে এবাদতগাহে সালাহ করত, আর অন্যান্য আনুষ্ঠানিক উপাসনাগুলোর মধ্যেই ধর্মকে সীমিত করে ফেলেছিল। ধর্মের যে মূল কাজ তথা সমাজে শান্তি, করুণার প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সেই অংশটুকুই তারা পরিহার করেছিল। আর সেটা পূরণ করাই ছিল ঈসা (আ.) একমাত্র সংগ্রাম। তিনি সাবাথের দিনে অন্ধকে দৃষ্টিদান করে, অবশরোগীর হাত ভালো করে ইহুদি রাব্বাইদের দৃষ্টিতে ধর্মদ্রোহ (ব্লাসফেমি) করেছিলেন। কারণ ঐ দিনের কাজ শুধুই উপাসনা আর উপাসনা। আর ঈসা (আ.) প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, মানুষের কল্যাণ করাই স্রষ্টার উপাসনা।
আজকে যে ইসলামটি আমরা দেখছি সেটাও প্রাচীন ইহুদি ধর্মের মতোই আচারসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মসজিদের পাশেই বর্ষায় শীতে কষ্ট করে বস্তিবাসী মানুষ, কিন্তু মসজিদগুলো প্রাসাদোপম। সেখানে আগত মুসল্লিদের লক্ষ্য হচ্ছে নামাজ পড়া আর নামাজ পড়া, আর আলেম ওলামাদের লক্ষ্য হলো মসজিদকে ব্যবহার করে অর্থোপার্জন করা। তারা রমজান মাসের কতই না ফজিলত বর্ণনা করেন, কিন্তু সবকিছুর উদ্দেশ্য সেই স্বার্থ। যারা নিত্য উপবাসী তাদের প্রতি করুণাপ্রদর্শন কেবল ওয়াজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। যাকাত হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনীর খ্যাতিবৃদ্ধির মাধ্যম। যাকাতের সস্তা কাপড় নিতে এসে পদপিষ্ট হয়ে অমানবিক মৃত্যুবরণ করে বহু গরীব মানুষ। প্রকৃত ইসলামের যুগে কি এমন দৃশ্য কল্পনা করা যেত? ধনীরা স¤পদ, খাদ্য বোঝাই উট নিয়ে শহরের পথে, মরুর পথে ঘুরত একজন গ্রহণকারীর সন্ধানে। আর আজ বিরাট ধনী, বিরাট পরহেজগার কিন্তু চরম স্বার্থপর, ঘোর বস্তুবাদী।
এভাবে ধর্মের আত্মাকে পরিহার করে কেবল আচারসর্বস্ব লেবাসি ধর্মকেই ইসলাম বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে- এটাই হচ্ছে কেতাবের কিছু মানা আর কিছু না মানা। উপরস্তু ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ পরিসরে আল্লাহকে মান্য করে রাষ্ট্রীয় জাতীয় জীবনে পুরোপুরি তাঁর বিধানকে অস্বীকার করা হয়েছে। স্রষ্টার পরিবর্তে ইলাহ তথা হুকুমদাতার আসনে বসানো হয়েছে পশ্চিমা সভ্যতাকে। এই সামষ্টিক শেরক আমাদের জীবনকে চরম অশান্তির মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছে, আখেরাতকেও ধ্বংস করছে।
এই অংশটুকু আমাদের ইসলামী চিন্তাবিদগণ অনেকেই অনুধাবন করেন আর যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান তারাও ঐ শরিয়তের অংশটুকুরই গুরুত্ব দেন। এ কারণে দেখা যায় জঙ্গিবাদীরা যেখানে তাদের শাসন কায়েম করতে পেরেছে, সেখানে শরিয়াহ কায়েম হলেও মানুষ শান্তি পায় নি, কারণ আত্মাহীন মানুষ যেমন মৃত, তেমনি মানবতাহীন ধর্মও মৃত।