মোহাম্মদ আসাদ আলী
জাতির অর্ধেক অংশ নারী। সম্প্রতি সেই নারীদেরকে যেন অভিভাবকরা ক্লাস ফোর-ফাইভের বেশি পড়ালেখা না করান সেই ওয়াদা নিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফি, যাকে মনে করা হয় বাংলাদেশের কওমী শিক্ষামাধ্যমের দিকপাল। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে তিনি বলেন, ‘আপনাদের মেয়েদের স্কুল-কলেজে দেবেন না। বেশি হলে ক্লাস ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে পারবেন। বিয়ে দিলে স্বামীর টাকা পয়সা হিসেব করতে হবে। চিঠি লিখতে হবে স্বামীর কাছে। আর বেশি যদি পড়ান, পত্রপত্রিকায় দেখছেন আপনারা, মেয়েকে ক্লাস এইট, নাইন, টেন, এমএ, বিএ পর্যন্ত পড়ালে ওই মেয়ে আপনার মেয়ে থাকবে না। অন্য কেহ নিয়ে যাবে। পত্রপত্রিকায় এ রকম ঘটনা আছে কিনা? ওয়াদা করেন। বেশি পড়ালে মেয়ে আপনাদের থাকবে না। টানাটানি করে নিয়ে যাবে আরেকজন পুরুষ।’ বলা বাহুল্য, এর আগেও তিনি নারী বিষয়ক বিতর্কিত মন্তব্য করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন এবং দেশজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে, এই একবিংশ শতাব্দীর যুগে যখন মেয়েরা মহাশূন্যে উড়ে বেড়াচ্ছে, পৃথিবী শাসন করছে, তখন একজন ব্যক্তি কী করে বলতে পারেন মেয়েদেরকে ক্লাস ফোর ফাইভের বেশি পড়ালেখা করাবেন না? একজন আলেম বলবেন আল্লাহর কথা, আল্লাহর রসুলের কথা। কিন্তু শফি সাহেবের বক্তব্যটি শুধু কোর’আন-সুন্নাহ বহির্ভূতই নয়, কোর’আন-সুন্নাহ পরিপন্থী কথা। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী, জাতিবিনাশী ও ধর্মদ্রোহী!
আমরা তার বক্তব্যটি দু’টি দিক দিয়ে বিচার করব। প্রথমত দেখা যাক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে। ইসলাম আসার আগে আরবের অবস্থা কেমন ছিল আমরা মোটামুটি সবাই জানি। অন্ধত্ব, কুসংস্কার, গোড়ামী, বিজ্ঞানবিমুখতা, আর অজ্ঞতার কারাগারে বন্দী ছিল তাদের সমাজ। আল্লাহ সেখানে মুক্তির দূত করে পাঠালেন বিশ্বনবীকে। সর্বপ্রথম যে শব্দটি আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন তাহলো ‘পড়’। মানুষ পড়ে কেন? জানার জন্য, বোঝার জন্য, উপলব্ধি করার জন্য। অর্থাৎ সেই মূর্খ অশিক্ষিত আরব জাতি, যারা অজ্ঞতা ও অন্ধত্বের কারণে সমস্ত পৃথিবীর অবহেলার পাত্র ছিল, তাদের অন্ধত্বের শেকল চূর্ণ করতে ঘোষিত হলো ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ- “জানো, বোঝো, উপলব্ধি করো, চোখ মেলে তাকাও, মগজ খোলো, চিন্তা করো, স্বার্থের গোলাম হয়ে থেকো না, তুমি আর দশটা পশুর মতো নও, তোমার মস্তিষ্ক অসাধারণ, তাকে কাজে লাগাও।’ শত শত যুগসঞ্চিত অজ্ঞানতার সকল আবর্জনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল এই একটি শব্দ। এ যেন একটি শব্দ নয়, একটি রেনেসাঁর বীজমন্ত্র, নবজাগরণের সংকল্প যা অচিরেই আরব জাতিকে বিশ্বের শিক্ষকের জাতিতে পরিণত করল। সেই সভ্যতার কারিগর ছিল নারী ও পুরুষ উভয়েই। তার অসংখ্য উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে আছে, আর তা পড়েই একজন মানুষকে আলেম হতে হয়। কাজেই প্রখ্যাত আলেম হয়ে শফি সাহেব কীভাবে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন তার জবাব একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন। আমার কেবল একটি সবিনয় জিজ্ঞাসা- তিনি কি মনে করেন কোর’আনের প্রথম অবতীর্ণ শব্দটি (ইক্বরা-পড়) কেবল পুরুষদের জন্যই নাজেল হয়েছিল? আল্লাহর রসুল কিন্তু তা মনে করেননি। আল্লাহর রসুল যেই শিক্ষা উম্মাহকে দিয়ে গেছেন তা বোঝানোর জন্য আমি এখানে কয়েকটি হাদিস খুবই সংক্ষেপে উপস্থাপন করব। চিন্তাশীল মানুষদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট হবে আশা করি।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরদ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)। রসুলাল্লাহ বলেন, যার দুটি বা তিনটি কন্যাসন্তান আছে এবং তাদের উত্তম শিক্ষায় সুশিক্ষিত ও প্রতিপালিত করে সৎ পাত্রস্থ করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে সহাবস্থান করবে (মুসলিম)।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, মেয়েরা একদিন নবীজীকে (সা.) বলল, আপনার কাছে পুরুষরা এত ভিড় করে থাকে যে অনেক সময় আমাদের পক্ষে আপনার কথা শোনা সম্ভবই হয় না। অতএব আমাদের জন্য আপনি আলাদা একটি দিন ধার্য করে দিন। এ কথা শুনে তিনি তাদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিলেন (বুখারি)। একদিন নবী করিম (সা.) বেলাল (রা.)-কে নিয়ে বের হলেন। তিনি ধারণা করলেন, রসুলাল্লাহ (সা.) পুরুষদেরকে শিক্ষা দিতে গিয়ে পেছনের সারিতে বসা নারীদের কথা শুনতে পাচ্ছেন না। তখন তিনি নারীদের কাছে গিয়ে জ্ঞান ও উপদেশ শোনালেন। (বুখারি) তিরমিজি শরিফে আবু মুসা (রা.) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, ‘আমাদের মাঝে যখনই কোনো বিষয় নিয়ে সমস্যা দেখা দিত, আমরা তখনই আয়েশা (রা.)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করলে তার সমাধান পেয়ে যেতাম।’
জুবায়ের ইবনে মুতইম (রা.) বর্ণিত হাদিসে আছে- ‘একবার এক মহিলা রসুল (সা.) এর দরবারে এসে কিছু বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করলো। বিদায় নিয়ে যাবার সময় রসুল (সা.) তাকে বললেন আর জানার মতো কিছু থাকলে অন্য সময় জেনে নিও। মহিলাটি আরজ করলো- ইয়া রসুলাল্লাহ! যদি আপনাকে না পাই অর্থাৎ যদি আপনি দুনিয়াতে না থাকেন তখন কী হবে? রসুল (সা.) বললেন- আবু বকর এর নিকট তখন শিক্ষা গ্রহণ করিও।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী)।
এমন সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকার পরও আর যাই হোক কোনো মুসলিম বলতে পারেন না যে, ‘মেয়েদেরকে ক্লাস ফোর ফাইভের বেশি পড়াবেন না।’ হ্যাঁ, বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান সবাইকে নিজস্ব মতামত প্রদানের অধিকার দেয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলেন অন্তত প্রথমেই পরিষ্কার করে বলে দেওয়া উচিত যে, ‘এই মন্তব্য আমার নিজস্ব বিবেচনাপ্রসূত, এটা আল্লাহ-রসুলের বক্তব্য নয়। এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ আমার ব্যক্তিগত মতামতের সাথে একমত হলে গ্রহণ করবে, নইলে প্রত্যাখ্যান করবে।’ আল্লামা শফি কিন্তু সেটা করেননি। তিনি ইসলামের দোহাই দিয়ে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন এবং তার অনুসারীদের ওয়াদা পর্যন্ত নিয়েছেন। এটা যদি ধর্মের অপব্যবহার না হয় তাহলে ধর্মের অপব্যবহার বলে আর কিছু নেই। নিজস্ব মতামতকে যারা আল্লাহ-রসুলের নামে চালিয়ে দেন তারা কেবল নিজেরই ক্ষতি করেন না, ইসলামেরও অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেন, বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি এমন কেউ হন যার লক্ষ লক্ষ অনুসারী রয়েছে যারা তার প্রতিটি কথাকে যৌক্তিকতা বিচার না করেই পালন করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে।
নাগরিক সমাজের সকল প্রান্ত থেকে যখন আল্লামা শফির এ বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা চলতে থাকে তখন সংবাদমাধ্যমে তার পক্ষ থেকে প্রেরিত একটি বিবৃতিতে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। সেখানে কৈফিয়ত দেওয়া হয়, তিনি নাকি নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলেননি, বলেছেন নারী-পুরুষের সহশিক্ষার বিরুদ্ধে। কারণ এতে পর্দা লঙ্ঘন হয়। কিন্তু এ কৈফিয়ৎ ধোপে টিকছে না। কারণ তিনি বারংবার বলেছেন, মেয়েরা যেন কেবল স্বামীর টাকার হিসাব নিকাশ রাখতে পারে, কেবল স্বামীকে চিঠি লিখতে পারে এটুকুই শিখে। এই টাকা গোনা ও চিঠি লেখার উদাহরণ দিয়েই তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন এর বেশি জ্ঞান অর্জনের কোনো প্রয়োজনীয়তাই তার দৃষ্টিতে নেই, সেটা মাদ্রাসাতেই হোক বা স্কুল কলেজেই হোক। তাছাড়া পর্দা লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে তিনি সহশিক্ষার বিষয়েও আপত্তি করতে পারেন না কারণ রসুলাল্লাহর সমগ্র জীবনীতে আমরা দেখেছি তিনি নারী ও পুরুষ সাহাবিদেরকে একত্রে বসিয়ে দীনের শিক্ষাপ্রদান করেছেন। মসজিদ ছিল জাতির সকল কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে নারী ও পুরুষ অবাধে যাতায়াত করতেন, সকল সালাতে ও আলোচনা সভায় অংশ নিতেন। নারী সাহাবীগণ রসুলের নির্দেশে যুদ্ধে গেছেন, রসদ সরবরাহের কাজ ছাড়াও সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছেন, মদীনার বাজার ব্যবস্থাপনা করেছেন, হাসপাতালের অধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। সুতরাং আল্লামা শফি যে পর্দা লংঘনের অজুহাত তুলে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বয়ান করলেন এটা কোনো যুক্তিতেই ইসলামের আকিদার সঙ্গে খাপ খায় না।
রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকগণ হেফাজত নেতা আল্লামা শফির এই বক্তব্যকে কীভাবে গ্রহণ করছেন তা যথেষ্ট কৌতুহলের বিষয়। কারণ কিছুদিন পূর্বেই এই হেফাজত নেতার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবর্ধনা নিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ সরকার কেন হেফাজতে ইসলামের মতো একটি মৌলবাদী শক্তির সাথে সম্পর্ক রেখে চলছে, তাদের অনেক দাবি দাওয়া মেনে নিচ্ছে, সবই কি রাজনৈতিক কূটকৌশল নাকি আদর্শিক পদস্খলনও এর পেছনে দায়ী ইত্যাদি প্রশ্ন অতীতে বহুবার উঠেছে, এখনও উঠছে। আল্লামা শফির সাম্প্রতিক বক্তব্যটি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠার পর বর্তমান সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এটাকে ‘আল্লামা শফির নিজস্ব বক্তব্য’ বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজেও ভালোমত জানেন- এই বক্তব্য নারীপ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের গৃহীত নীতিমালার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং অদূর ভবিষ্যতে তা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে! আল্লামা শফি দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান। তার কথা ব্যক্তিগত অভিমত নয় বরং ইসলামের কণ্ঠস্বর! রাষ্ট্র চলবে এক নীতিতে, পক্ষান্তরে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জনগণের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হবে ভিন্ন নীতি- এই মধ্যযুগীয় সাংঘর্ষিকতা (চার্চ বনাম রাজা) নিয়ে কোনো রাষ্ট্রই উন্নতি প্রগতি অর্জন করতে পারে না। আমাদেরকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কোন পথে হাঁটব? আমরা কি আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের আদর্শের অনুকূলে একটি উন্নত, আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাষ্ট্র চাই নাকি ইসলামপূর্ব আইয়ামে জাহেলিয়াতের আরব সমাজের মতো শিক্ষা-দীক্ষাহীন, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিমুখ, অজ্ঞতা-মূর্খতায় ভরা অন্ধকার সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চাই?
এতে সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রও চায় মানবকল্যাণ, ধর্মও চায় মানবকল্যাণ। রাষ্ট্রও চায় নারী প্রগতি, ধর্মও চায় নারীপ্রগতি। রাষ্ট্র ও ধর্মকে যারা মুখোমুখী অবস্থানে নিয়ে ফায়দা হাসিল করতে চায় তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের যেমন সতর্ক থাকতে হবে, তেমনি সতর্ক থাকতে হবে যারা ধর্মের প্রতি মমতাবোধ করেন, ধর্মের কল্যাণকামী ঈমানদার মানুষ- তাদেরও।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। asadali0605@gmail.com