কামরুল আহমেদ
সূর্যে যখন গ্রহণ লাগে তখন চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। অফুরন্ত শক্তির উৎস যে সূর্য সেও দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। ঠিক সেভাবে সূর্যের ন্যায় সমুজ্জ্বল, সমস্ত সত্য ও কল্যাণের উৎস আল্লাহর নাজেল করা যে দীন, ধর্ম বা জীবনবিধান সেটা নিয়ে যখন স্বার্থ হাসিল শুরু হয় তখন তা অশান্তির বিষবৃক্ষে পরিণত হয়। মানবসমাজে তখন সূর্য গ্রহণের মতোই কালো ছায়া নেমে আসে। আল্লাহ মানুষকে শান্তি, ন্যায় ও প্রগতির মধ্যে বাস করার জন্য যে দীন বা ধর্ম পাঠিয়েছেন সেটাকে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করে তখন তাকে ধর্মব্যবসা বলা হয়ে থাকে।
সাধারণ মানুষ ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখেন না। অন্যায়পূর্ণ সমাজে অশান্তির দাবানলে দগ্ধ হয়ে তারা যখন ইহজাগতিক ও পারলৌকিক মুক্তির আশায় ধর্মের দিকে ফিরে আসে তখন তারা শরণাপন্ন হয় ধর্মের ধ্বজাধারী সেই শ্রেণিটির যারা ধর্মকে স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত করেছে, ধর্মকে পণ্য বানিয়ে ব্যবসা করছে, ধর্ম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে, ধর্মকে ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি বানিয়ে প্রতিনিয়ত ধর্মকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। আর সেই শ্রেণিটি নিজেদের স্বার্থের অনুক‚লে ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে প্রতিনিয়ত বিপথগামী করছেন, প্রতারিত করছেন। তারা যেটাকে ইসলাম বলে উপস্থাপন করেন সেটাকেই মানুষ আল্লাহ-রসুলের কথা হিসাবে শিরোধার্য বলে মনে করে। কেবল স্বার্থের জন্য তারা বহু গুরুত্বহীন বিষয়কে ইসলামের অপরিহার্য বিষয় বানিয়ে দেন, আবার মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একেবারে বাদই দিয়ে দেন। তাদের প্রতি অন্ধবিশ্বাস থাকায় জনগণ প্রতারিত হয়, তারা বুঝতে পারে না ধর্মব্যবসায়ীরা ইসলামের যে রূপ তাদের সামনে তুলে ধরছে সেটা একান্তই তাদের মনগড়া অপব্যাখ্যা। ভোক্তার চাহিদা মোতাবেক যেমন পণ্যের গুণাগুণ, আকার, আকৃতি বিভিন্ন হয়, তেমনি ইসলামেরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়।
মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ধর্মীয় চেতনা একটি মহাশক্তি। যে কোনো শক্তিরই সুফল ও কুফল নির্ভর করে তার ব্যবহারের উপর। যারা ধর্মকে নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়েছে তারা সর্বপ্রথম যে ক্ষতিকর কাজটি করেছে তা হলো, তারা মানুষের চিন্তার জগতে তালা মেরে দিয়েছে এই বলে যে ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। ধর্মের নির্দেশের ব্যাপারে কোনো যুক্তি চলবে না। মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়েছে মস্তিষ্কের গুণে, আর ধর্মের ধ্বজাধারীরা সেই মস্তিষ্কের ঘরে তালা দিয়ে মানুষকে চিন্তাহীন, যুক্তিবোধহীন, কূপমণ্ডুক, পশু বানিয়ে ফেলতে চায়। এভাবেই মুসলিম জাতি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এটা বোঝার সাধারণ জ্ঞান তাদের ধার্মিকদের লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন যদি ধর্মকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সবার আগে মানুষের চিন্তা করার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে, অচল মস্তিষ্ককে অর্গলমুক্ত করতে হবে। যতদিন ইসলামের কর্তৃত্ব, ধর্মানুভূতির নিয়ন্ত্রণ ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে থাকবে ততদিন মুসলিমদের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশা দুরাশা। ততদিন ইসলাম কোনো জীবিত মানুষের কল্যাণে আসবে না, মৃত মানুষের কল্যাণেও আসবে না। আল্লাহর রসুল (সা.) এর দু’টো ভবিষ্যদ্বাণী এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
১.তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন ১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, ২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, ৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) থাকবে না, ৪) আসমানের নিচে নিকৃষ্টতম জীব হবে আমার উম্মাহর আলেম সমাজ, ৫) তাদের সৃষ্ট ফেতনা তাদের দিকেই ধাবিত হবে (হাদিস: আলী (রা.) থেকে বায়হাকি, মেশকাত)।
২.আবু যর (রা.) বলেন, একদিন আমি রসুলাল্লাহর (সা.) সাথে ছিলাম এবং তাঁকে বলতে শুনেছি: “আমি আমার উম্মতের জন্য দাজ্জালের থেকেও একটা জিনিসকে বেশি ভয় করি।” আমি ভয় পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, “ইয়া রসুলাল্লাহ (সা.) সেই জিনিস কী?” তিনি বললেন, “আয়াম্যায়ে দোয়াল্লিন বা পথভ্রষ্ট ইমাম”। (হাদিস: মুসনাদে আহমাদ: ২১৩৩৪, তিরমিযী: ২২২৯)
এ দু’টো হাদিস থেকে আখেরি যুগের আলেমদের সম্পর্কে রসুলাল্লাহর বক্তব্য খেয়াল করুন। প্রথমত তিনি বলেছেন, আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। দ্বিতীয়ত, দাজ্জালের থেকেও ভয়ঙ্কর হবে আলেমগণ যে দাজ্জালকে রসুলাল্লাহ মানবজাতির জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ, সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
ধর্মব্যবসা বহুরূপী। ধর্মব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কেতাবের ভাষা শিখে ও বেশভূষা ধারণ করে নিজেদেরকে একটি ধর্মীয় ভাবমূর্তি প্রদান করেন যেন মানুষ তাদেরকে ধর্মের কর্তৃপক্ষ বলে বিশ্বাস করে। এভাবে মানুষের ঈমানকে তারা আগে ছিনতাই করে, তারপর নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য নানাপ্রকার বক্রপথ তারা অবলম্বন করে। আমরা যদি উদাহরণ টানি তাহলে বহুরকম ধর্মব্যবসারই উদাহরণ আমাদের সমাজে বিরাজ করছে। পৃথিবীতে বিরাজিত তাবৎ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু আমাদের আলোচনার মূল ক্ষেত্র যেহেতু ইসলাম ধর্ম, তাই মুসলমান দাবিদার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মব্যবসা যে সকল রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে সেগুলোর উদাহরণ দিচ্ছি। আসুন দেখি, ইসলাম নিয়ে প্রচলিত ধর্মব্যবসার রূপগুলো কী কী?
মসজিদে নামাজ পড়িয়ে টাকা নেওয়া।
জানাজা পড়িয়ে বা তার পরবর্তীতে কবর জেয়ারত করে, কুলখানি, চেহলামে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও বিশেষ মোনাজাত করে টাকা নেওয়া।
চুক্তি করে বা চুক্তি ছাড়াই কোর’আনের মাহফিল করে টাকা নেওয়া।
রমজান মাসে খতম তারাবি বা অন্য যে কোনো উসিলায় কোর’আন খতম দিয়ে টাকা নেওয়া।
মসজিদ মাদ্রাসার নির্মাণ বা উন্নয়নের নাম করে টাকা তুলে সেটা ঐ খাতে ব্যয় না করে নানা অসিলায় নিজেদের জন্য বৈধ করে নেওয়া।
টাকার বিনিময়ে মিলাদ পড়ানো।
প্রতারণামূলক রাজনীতি করে সেখানে ধর্মকে ঢাল হিসাবে এবং ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়িরূপে ব্যবহার করা।
হজ্বের নামে প্রতারণামূলক বাণিজ্য করা।
প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো বুনিয়াদি পরিবর্তন না এনে, ইসলামের কোনো নীতি প্রবর্তন না করে, রাষ্ট্রে ইসলামের কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা না করে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম আখ্যা দেওয়া।
সুদের নাম পাল্টে মুনাফা, ইন্টারেস্ট বা অন্য যে কোনো শব্দ ব্যবহার করে ধর্মীয় আবরণে সুদী কারবার করা।
আখেরাতে মুক্তির উসিলা সেজে পীর-মুরিদী করে রোজগার করা।
জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়ে পাশ্চাত্যের জন্য রণক্ষেত্র ও অস্ত্রব্যবসার বাজার নির্মাণ করে দেওয়া। আরব দেশগুলো এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে করে যাচ্ছে।
ভোটের সময় এলে আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পাক্কা মুসল্লি সেজে হজ্ব-ওমরা পালন ও পীরের দরবারে, মসজিদে মাদ্রাসায় বেশি বেশি অর্থদান করা।
এক কথায় ধর্মকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করাই ধর্মব্যবসা আর মানবতার কল্যাণে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করাই ধর্মের সদ্ব্যবহার। সবচেয়ে বড় অধর্ম হচ্ছে সেটাই যা ধর্মের নামে করা হয়। ধর্মবাণিজ্য এমনই আরো বহুরূপী সাজে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দিকভ্রান্ত করছে এবং গোটা মানবজাতিকে মহা সঙ্কটের মধ্যে নিক্ষেপ করছে।