রিয়াদুল হাসান:
দেহ-আত্মার সমন্বয়ে যেমন মানুষ, তেমনি দুনিয়া ও পরকালের ভারসাম্যপূর্ণ দীন হচ্ছে ইসলাম। এই ভারসাম্য যতদিন অটুট ছিল ততদিন মুসলিমরা না ছিল ভোগবাদী, আর না বৈরাগ্যবাদী। তাদের জীবন ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। এরপর দীনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে জাতির মধ্যে দুইটি শ্রেণির জন্ম হয়, যার একটি ভাগ সম্পূর্ণভাবে বিকৃত সুবিফাদের অনুসরণ করে দুনিয়া ছেড়ে দিয়ে শুধু আত্মা নিয়ে ঘষামাজা করতে লাগল, অপরটি জীবন থেকে তাসাউফের লেশমাত্রও ছুঁড়ে ফেলে ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিল। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো ওই ভোগবাদী ভাগটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আল্লাহর রসুল আরবদেশে জন্ম নিয়েছিলেন কিন্তু তিনি আরব-অনারব সকলের নবী ছিলেন, বিশ্বের সকল মানুষের নবী তিনি (আল কোর’আন, সুরা আরাফ ১৫৮)। তিনি আরবকেন্দ্রিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে যান নি। তিনি বিদায় হজ্বের ভাষণে এই দীনের নীতিগুলো সুস্পষ্টভাবে বলে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনি এও বলেছিলেন যে, আরবদের উপর অনারবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, অনারবদের উপর আরবদেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কিন্তু আল্লাহর রসুল বিদায় নেওয়ার কিছুদিন না যেতেই আরবরা এই কথাটি ভুলে গেল। তারা আবারো পূর্বের সেই জাহেলিয়াতের মূল্যবোধ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারা আবার দাসত্বপ্রথা চালু করল, যে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আল্লাহর রসুল আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। তাদের এই কাজের পরিণামে মুসলিম বংশজাত, মুসলিম নামধারী রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরাহগণ আবারও পুরোদমে ক্রীতদাস প্রথা প্রচলন করেছিল যার কলঙ্ক স্বভাবতই ইসলামের উপর বর্তেছে। এভাবে আরবরা বহুভাবে ইসলামকে কলঙ্কিত করেছে। তবুও যেহেতু তারা ছিল শাসকের আসনে, মানুষ তাদেরকে অনুসরণ করেছে। শাসকের ভাষাকে বরণ করেছে, শাসকের পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া, রুচি-অভিরুচি সবই মানুষ অনুকরণ করেছে। যেগুলো ভালো সেগুলোও যেমন নিয়েছে, যেগুলো খারাপ সেগুলোও বাদ দেয় নি। সমস্যা হয়েছে যেটা, পরবর্তী সময়ে আরবরাই ইসলামের প্রতিভ‚ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে। আরবের ভাষা হয়ে গেছে ইসলামের ভাষা, আরবের খাদ্য খেজুর হয়ে গেছে ‘সুন্নতি খাবার’, আরবীয় জোব্বা হয়ে গেছে ইসলামের ‘লেবাস’, আরব্য মুসলিম শাসকদের দাড়ি হয়ে গেছে ইসলামের ‘অপরিহার্য’ বিষয়। আল্লাহর রসুল আরব-অনারবের ঊর্ধ্বে ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে মুফতি মুফাসসিরগণ মাসলা-মাসায়েল আবিষ্কার করে ইসলামের সার্বজনীন চরিত্র পালটিয়ে তাতে আরবের গন্ধ লাগিয়ে দেন।
আর আরবের লোকেরা এটাকে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের সূচক হিসাবে দাঁড় করিয়ে ফেলল। আজও বাকি পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান মনে করেন, আরবে যেটা চলে সেটাই ইসলামের নমুনা। মক্কা-মদীনার ইমাম সাহেব, মুফতি সাহেব যেটা বলেছেন সেটা কোনোভাবেই ভ্রান্ত হতে পারে না। আরবদের অনুকরণে আমাদের দেশের আলেম সাহেবরা ওয়াজ মাহফিলে, বড় বড় অনুষ্ঠানে আরবীয় অভিজাত শ্রেণির ব্যবহৃত ‘আবায়া’ পরে বসে থাকেন, মাথায় বাঁধেন পাগড়ি, ঘাড়ে চেক রুমাল। মানুষ মনে করে তারাই মূর্তিমান ইসলাম (Idol) বা ইসলামের প্রতীক (Icon)।
মুসলমানেরা আরবদেশকে নবীজীর জন্মস্থান হিসাবে অপরিসীম শ্রদ্ধা করে এবং করবে এটাই স্বাভাবিক, এটা যৌক্তিক। কিন্তু আরবদেরকে ইসলামের মানদণ্ড ‘Head of religion’ মনে করা একটি বিরাট পথভ্রষ্টতা। ইসলামের মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসুল। এই মানদণ্ডে আরব অনারব সবাইকে উত্তীর্ণ হয়েই মুসলিম হতে হবে। বর্তমানে আরবে রাজতন্ত্র চলছে অথচ আল্লাহর রসুল তো রাজতন্ত্র নিষিদ্ধ করে গেছেন। রসুলাল্লাহ (সা.) নিজেও মালিক (রাজা) বা সুলতান উপাধি ধারণ করেন নি, তাঁর পরবর্তী খলিফারাও তা করেন নি। খলিফাদেরকে ‘আমীরুল মো’মেনীন’ বা মো’মেনদের নেতা বলা হতো। তারা রাজা-বাদশাহ ছিলেন না, অন্যান্য মো’মেনগণ যে জীবনযাপন করতেন, আমীরুল মো’মেনীনগণও সেই একই মানের জীবনযাপন করতেন। তাদের কোনো দেহরক্ষীও ছিল না। কিন্তু আজ আরব রাজপুত্রদের দেহরক্ষীদের দাবড়ানিতে হজ্ব করতে আসা অর্ধ লক্ষ হাজী পদদলিত হয়ে মারা যায়। মুসলিমদের মধ্যে যে দুঃখজনক বিভক্তি বিরাজ করছে তার মূল কেন্দ্রবিন্দুু হচ্ছে আরবদের মিথ্যা ধার্মিকতার মোড়ক (False theological cover)। মুসলিমদের গোটা ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়।
মুসলিমদের দুটো পবিত্র স্থান মক্কা ও মদীনা আরবদেশে অবস্থিত, তার মানে এই নয় যে ওদুটো আরবের সম্পত্তি। আল্লাহর রসুল আরব বলে আলাদা দেশ রেখে যান নি, তাঁর মিশন ছিল সমগ্র পৃথিবীকে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ছায়াতলে নিয়ে আসা। ভৌগোলিক বিভক্তি, জাতিগত বিভক্তি, ধর্মীয় বিভক্তি এক কথায় মানুষে মানুষে যে কোনো প্রকার বিভক্তি ইসলামে কেবল নিষিদ্ধই নয়, একেবারে কুফর। আরবের মুসলমানেরা গরিব দেশের মুসলমানদের সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করে, মহিলা গৃহকর্মীদের সর্বপ্রকার নির্যাতন করে। অথচ আল্লাহ বলেছেন, মো’মেনরা ভাই ভাই। ইসলাম আসার আগে আরবদের মূল বাণিজ্যই ছিল হজ্ব। আর বর্তমানে তারা একে একেবারে পর্যটন শিল্পে রূপ দিয়েছে। মক্কা-মদীনা এখন ফাইভ স্টার, সেভেন স্টার হোটেল দিয়ে পূর্ণ। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এজেন্টদের মাধ্যমে, বিভিন্ন দলের মাধ্যমে হাজি সংগ্রহ করা হয়।
বাকি মুসলিম দুনিয়ার রাজনৈতিক নেতারাও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ঘন ঘন হজ্ব-ওমরা পালন করেন আর দেশ চালান ব্রিটিশদের তৈরি আইন-কানুন আর জীবনবিধান দিয়ে। মাঝে মধ্যে তারা আরব থেকে দু একজন ‘শায়েখ’ ভাড়া এনে নিজেদের মুসলমানিত্বকে সত্যায়ন করিয়ে নেন। আরব বাদশাহরাও কাবার পুরোনো গেলাফ উপহার দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের ধন্য করে দেন। কেউ এ প্রশ্ন তোলেন না যে, যখন মুসলিম বিশ্বের বহু দেশ, সোমালিয়া, ইয়েমেন দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত, সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু শিবিরে অনাহারে দিন যাপন করছে, তখন নিজেরা বহুমূল্য লেবাস ধারণ করে নিজেদেরকে ইসলামের ধারক-বাহক প্রমাণ করা ইবাদত, নাকি নিরন্ন, নির্বস্ত্র মানুষকে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় দেওয়া ইবাদত?
আরব রাজতন্ত্র বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ইসলামের নামে, বিভিন্ন জঙ্গিবাদী দল, আমলের দাওয়াত প্রদানকারী দলের নামে বিকৃত ওয়াহাবী/সালাফি মতবাদের প্রসার ঘটিয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন মানুষমাত্রই অবগত আছেন। তারাই আফগান-রাশিয়া যুদ্ধের সময় সারা পৃথিবী থেকে মুসলিমদের আফগানের মাটিতে সমবেত করেছিল এবং আরব ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দ্বারা জঙ্গিবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত করে তুলেছিল। মুসলিম তরুণ-যুবকরা জেহাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেখানে ছুটে গিয়েছিল কিন্তু সেখানে তারা জীবন দিয়ে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করেছে। ইসলামের চার আনাও উপকার হয় নি। উল্টো জঙ্গিবাদের মতো এক জঘন্য মিথ্যা মতবাদের ভুত মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাঁধে চেপে বসেছে। এখন সেই ভুত তাড়ানোর নামে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ করে মুসলমান জনগোষ্ঠীকেই নির্মূল করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে পশ্চিমা পরাশক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। শিয়া-সুন্নী বিরোধকে কেন্দ্র করে এখন দুনিয়া তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লেবানন, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, কুয়েত প্রতিটি দেশে গত দশকগুলোতে যে যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের প্রাণ গেছে, সেই রক্তের দাগ যেমন পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোর হাতে লেগে আছে, তেমনি লেগে আছে আরবের সেই ইসলামের ধ্বজাধারীদের হাতেও। তারা আজ পর্যন্ত একজন মুসলিম উদ্বাস্তুকেও তাদের দেশে আশ্রয় দেয় নি। উল্টো এসব যুদ্ধে তারা মার্কিনদের থেকে হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে সেগুলো মুসলিমদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেছে। এসবই তারা করছে কেবল নিজেদের পার্থিব ভোগবিলাস আর সিংহাসন টিকিয়ে রাখার লোভে।
[লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি; ইমেইল: mdriazulhsn@gmail.com]