রিয়াদুল হাসান:
যে কাজের পরিণামে একটি জাতি ধ্বংস হয়ে যায়, যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আল্লাহ একজন নবী প্রেরণ করেন সেই উদ্দেশ্য পণ্ড হয়ে যায়, একটি আসমানি কেতাবের কার্যকারিতা হারিয়ে যায়, মানুষ ধর্মের কাছে এসে সেখানে অধর্ম পেয়ে ধর্মকে, আল্লাহ ও নবী-রসুলগণকে ঘৃণা করতে শুরু করে সেই কাজ কতটুকু ক্ষতিকর কাজ- তা অনুধাবন করার জন্য মুসলিম নামক জাতির পচন-পতন ও চলমান দুর্দশাকে বিবেচনায় নেওয়াই যথেষ্ট। ধর্মব্যবসা হচ্ছে এই মাত্রার বিপর্যয় সংঘটনকারী, প্রাণঘাতী, জাতিবিধ্বংসী একটি অপকর্ম। এজন্যই আল্লাহ ধর্মব্যবসা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এই বলে যে, ‘তোমরা কেতাবের প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়ো না আর তুচ্ছমূল্যে আমার আয়াত বিক্রি করো না। এবং আমার (আযাব) থেকে বাঁচ। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না।” [সুরা বাকারা ৪১, ৪২]
যেহেতু মানবজাতির ইতিহাস ন্যায় ও অন্যায়ের, সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাস, তাই কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সেটা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত না করা গেলে একজন মানুষের পক্ষে সত্যের পক্ষ অবলম্বন করা সম্ভব হয় না। ধর্মব্যবসা কী করে? ধর্মব্যবসা সেই সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের মানদণ্ডটাকে নষ্ট করে দেয়। হালালকে হারাম, হারামকে হালাল বানিয়ে দেয়। যার পরিণামে ঘোরতর অন্যায় কাজ ধর্মের মোড়কে মহাসমারোহে করা হতে থাকে। হারামকে হালাল বলা অথবা হালালকে হারাম বলা কুফরী। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “যদি কেউ হারামকে হালাল বলে অথবা হালালকে হারাম বলে তবে সে কাফের হবে।” [শরহে আকাইদে নফসি, ফিকহে আকবার, আকাইদে হাক্কা]। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ ধর্মব্যবসাকে হারাম করেছেন আর ধর্মব্যবসায়ীরা একে হালাল বানিয়ে ফেলেছেন।
হানাফি মাজহাবের মুজতাহিদ আল্লামা ফকিহ্ আবুল লায়ছ সমরকন্দি (র.) (৩৭৩ হিজরি) লিখেছেন, “যখন আলেমগণ হারাম ভক্ষণকারীতে পরিণত হবে তখন সাধারণ মানুষেরা কাফেরে পরিণত হবে।” [তাম্বিহুল গাফিলিন] কারণ সাধারণ মানুষ মনে করবে আলেম সাহেব হালাল বলেই তো এটা করছে। তখন তারা ঐ হারামটাকে হালাল মনে করার কারণে কাফের হবে।
মানুষও ধর্মব্যবসায়ীদের মুখের কথায় বিশ্বাস করে আল্লাহ ও রসুলের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজকে অতি সওয়াবের কাজ মনে করে পালন করে যেতে থাকে। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সঠিক বানানের মানদণ্ড হচ্ছে অভিধান। যদি কোনোভাবে অভিধানে ভুল বানান ঢুকে যায় তখন মানুষ কী করে সঠিক বানানটি জানতে পারবে? একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে ধর্মের প্রকৃত ভারসাম্যযুক্ত শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা। ‘এই প্রকৃত ভারসাম্যযুক্ত শিক্ষাটিকে’ ধ্বংস করে দেয় ধর্মব্যবসা। তাই শান্তির কোনো পথই আর অবশিষ্ট থাকে না। বহুমুখী বাতাস এসে একটি জাহাজের দিক পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু কম্পাস যদি ঠিক থাকে আবার সে একসময় ঠিকই তার বন্দরে ফিরতে পারবে। কিন্তু যে ব্যক্তি ঐ কম্পাসটিই নষ্ট করে দেয় সে যাত্রীদের গন্তব্যে যাওয়ার সকল আশাই ধ্বংস করে দেয়, যা কিনা ঝড়ের পরেও অবশিষ্ট ছিল।
এভাবেই শান্তির একমাত্র পথ হচ্ছে আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করা। যদি ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের তৈরি করা, নিজেদের মগজপ্রসূত বিধি-বিধানকে আল্লাহর হুকুম বলে চালিয়ে দেয় এবং সেটাই মানুষকে মানতে বাধ্য করে, তাহলে কি মানবসমাজে আদৌ শান্তি আসবে? আসবে না। কিন্তু মানুষ মনে করবে যে তারা আল্লাহর হুকুমেরই আনুগত্য করল কিন্তু শান্তি আসলো না। ফলে আল্লাহর হুকুমের প্রতিই মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এই যে আল্লাহর উপর থেকে, আল্লাহর হুকুমের উপর থেকে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারানো, এর চেয়ে ধর্মের বড় ক্ষতি আছে? নেই। ধর্মব্যবসায়ীরা এই ক্ষতিটাই করে। তারা নিজেদের মনগড়া কথাকে আল্লাহর কথা, শরিয়তের কথা বলে চালিয়ে দেয়। এদেরকেই আল্লাহ বলেছেন অপদার্থ উত্তরসূরি। [সুরা মারইয়াম ৫৯]।
আল্লাহ যাদেরকে কেতাবের জ্ঞান দান করেছেন তারা আল্লাহর বিশেষ নেয়ামতপ্রাপ্ত। তারা যখন সেই জ্ঞানকে পুঁজি করে ব্যবসা করতে শুরু করে, তখন তারাই আল্লাহর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। আল্লাহ তাদের অবস্থা বোঝাতে কুকুরের উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “তাদের উদ্দেশ্যে সেই ব্যক্তির কাহিনী বর্ণনা করুন যাকে আমি আমার আয়াত শিক্ষা দিয়েছিলাম কিন্তু সে তা হতে সরে আসল এবং শয়তানের অনুসরণ করল ফলে পথভ্রষ্ট হল। আমি চাইলে তাকে তার এলেমের কারণে সম্মানিত করতে পারতাম কিন্তু সে দুনিয়ার জীবনের দিকেই ঝুঁকে গেল আর তার মনের ইচ্ছাকে অনুসরণ করল। অতএব সে কুকুরের মতো, তুমি তার উপর বোঝা চাপাও বা ছেড়ে দাও সর্বদা সে হাঁপাতে থাকে। যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাদের উদাহরণ খুবই নিকৃষ্ট। অতএব আপনি এসব কাহিনী বর্ণনা করুন হয়ত তারা চিন্তা করবে।” [সুরা আরাফ ১৭৫]
প্রকৃতপক্ষে সত্য গোপন ও দীন বিক্রিই আলেমদেরকে নিকৃষ্ট করে। আহলে কেতাব ও মোশরেকদের মধ্যে যারা কাফের (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) তাদের বেলায় আল্লাহ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন “উলাইকাহুম শাররুল বারিয়্যাহ” অর্থাৎ তারাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্টতম [সুরা বাইয়্যেনাহ ৬]। এই একই পরিভাষা আল্লাহর রসুল ব্যবহার করেছেন আখেরি যুগের আলেমদের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, “ওলামাউহুম শাররুন মান তাহতা আদীহিম সামায়ী অর্থাৎ ওলামাগণ হবে আসমানের নিচে সর্বনিকৃষ্ট জীব”। [হাদিস: আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত] যারা কুফরি ও শেরক করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ যে শব্দটি ব্যবহার করলেন সেই শব্দটি রসুলাল্লাহ আলেমদের বেলায় ব্যবহার করলেন, কত মারাত্মক বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা এত নিকৃষ্ট? এই আলেম কোন আলেম?
এই আলেম হচ্ছে তারা যারা মানবসমাজে ফেতনার (দাঙ্গা) সৃষ্টি করেন যে ফেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সকল নবী-রসুল এসেছেন, যে ফেতনাকে আল্লাহ হত্যার চেয়ে জঘন্য বলে আখ্যায়িত করেছেন [সুরা বাকারা ১৯১], যে ফেতনাকে নির্মূল করতেই আল্লাহ তাদের মাধ্যমে যুগে যুগে সত্যদীন বা জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছেন। যে আলেমরা এই জীবনব্যবস্থাকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় তারাই সমাজে ফেতনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী, যাবতীয় অশান্তির মূল গোড়া তারা। সত্য গোপন করাই হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা, সত্যই হচ্ছে শান্তির উৎস। এক শ্রেণির আলেম মানুষকে সত্য জানতে দিচ্ছেন না, কুফর করছেন, ঢেকে রাখছেন। যার ফলশ্রুতিতে মিথ্যা সংসারকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আর মিথ্যার পরিণাম হচ্ছে ফেতনা তথা শোষণ, রক্তপাত, অবিচার ও দাঙ্গা হাঙ্গামা।
আলেম সাহেবরা কী গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি গোপন করেছেন? সেটা হচ্ছে তারা ইসলামের দৃষ্টিতে মো’মেন ও কাফের কাকে বলে সেটাই গোপন করেছেন এবং আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞার পরিবর্তে ভিন্ন সংজ্ঞা উদ্ভব করে জাতিকে পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছেন। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, যারা আল্লাহর হুকুম দিয়ে হুকুম (শাসন, বিচার-ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক। [সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭]
জাতীয় জীবনে আল্লাহর বিধানকে জাতিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জাল অর্থাৎ পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার তৈরি করা বিধানকে গ্রহণ করে নিয়ে, আল্লাহর পরিবর্তে মানুষকে ইলাহ’র (হুকুমদাতা) আসন প্রদান করে মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠী যে আসলে মো’মেন নেই, আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা কাফেরে পরিণত হয়েছে এই সত্যটি আলেম সাহেবরা মানুষকে বুঝতে দেন না, পার্থিব স্বার্থে গোপন রাখেন।
ফলে মানুষ বাস্তবে কাফের হয়েও নিজেদেরকে মো’মেনই মনে করতে থাকে এবং জান্নাতের আশায় আমল করে যায়। তারা এটাও বলেন না যে, আল্লাহ বলেছেন, মো’মেন হচ্ছে তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের উপর ঈমান আনে (তওহীদ), তাতে কোনো সন্দেহ করে না এবং জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে আল্লাহর রাস্তায় (মানবতার মুক্তির জন্য) সংগ্রাম করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। [সুরা হুজুরাত ১৫]
এই আলেমগণ সর্বনিকৃষ্ট জীব কারণ তারা ধর্মের ‘ধ্বজাধারী’ হয়েও মানুষকে সত্য মিথ্যার জ্ঞান দিচ্ছে না। তারা অমূল্য জ্ঞান বহন করে চলেছেন কিন্তু সেটা না সত্যিকার অর্থে তাদের কাজে আসছে, না মানবজাতির কোনো উপকারে আসছে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেছেন, “তাদের দৃষ্টান্ত হলো পুস্তক বহনকারী গাধার মতো! কত নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে!” [সুরা জুম’আ: ৫] মুসলিম দাবিদার এই জনগোষ্ঠী যে মো’মেন না, তারা যে উম্মতে মোহাম্মদী না, তারা যে জান্নাতের পথ সেরাতুল মোস্তাকীম থেকে সরে গেছে এটা বুঝতে দিচ্ছে না। তারা বলছেন, “নেক আমল করো। আমাদেরকে টাকা দাও, আমি তোমাদের মিলাদ পড়িয়ে দেব, নামাজ পড়িয়ে দেব, জানাজা পড়িয়ে দেব, কোর’আন খতম দিয়ে দেব, ওয়াজ শোনাবো। এগুলোই নেক আমল, এগুলোই তোমাদের জান্নাতে নিয়ে যাবে।” যারা নেক আমল করবে তাদেরকে আগে মো’মেন হতে হবে আর এই জাতি তো মো’মেনই নয়, সুতরাং মো’মেন না হওয়া পর্যন্ত কোনো আমল দিয়েই তারা জান্নাতে যেতে পারবে না এই কথাটি তাদেরকে জানতে দিচ্ছে না। এই প্রতারণার ফলে মানুষের দুনিয়ার জীবন যেমন অশান্তিময় হয়ে গেছে, তেমনি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের আখেরাত।
পূর্ববর্তী ধর্মের অনুসারী সম্প্রদায়গুলোর মতো বর্তমানের বিকৃত ইসলামের ধর্মব্যবসায়ীরাও এর ব্যতিক্রম নন। তারা এমন আকর্ষণীয় সুরে বয়ান করে থাকেন যে তারা যা বলেন তাকেই সত্য কথা, কোর’আন হাদিসের কথা মনে করে বিশ্বাস করে নিতে মানুষ বাধ্য হয়। ধর্মব্যবসায়ীদের এই চিরন্তন বৈশিষ্ট্যের কথাই আল্লাহ কোর’আনে আমাদেরকে সতর্কবার্তারূপে জানিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তারা কেতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা তেলাওয়াত করছে তা আদৌ কেতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সুরা ইমরান ৭৮]
আমাদের সমাজের ধর্মজীবীরাও ঠিক এভাবেই ‘মুখ বাঁকিয়ে’ কেতাব পাঠ করেন, যেন সবাই বিশ্বাস করে যে তারা বুঝি আল্লাহ-রসুলের কথাই বলছেন। কিন্তু আদৌ তা নয়। তারা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি ইসলামকে যা তাদের পূর্বসূরীগণ বিকৃত করেছে সেগুলোকে অভিনব মুখভঙ্গি ও সুর সহযোগে আল্লাহর নামে চালিয়ে দেন। এমন পরিষ্কারভাবে আল্লাহ এই ধর্মজীবী ওয়াজকারী আলেমদের মুখোশ উন্মোচিত করে দেওয়ার পর আর কী বলার বাকি থাকে?
নবী-রসুলদের দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা আলাদা করে দেওয়া। এরপর ন্যায়পথে যারা চলতে চায় তাদেরকে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। স্বভাবতই সেই নবীর প্রতি ঈমান আনয়নের পর প্রতিটি মো’মেনের উপরও এই একই ঐশী দায়িত্ব অর্পিত হয়। সেই মো’মেনদের দায়িত্ব কী, তারা কেন শ্রেষ্ঠ জাতি সেটা আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,“তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির মধ্য থেকে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে এই জন্য যে তোমরা মানুষকে ন্যায়কাজের আদেশ করবে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে।” [সুরা ইমরান ১১০]
কিন্তু যে সকল কথিত আলেম-ওলামারা ধর্মব্যবসা করেন তাদের পক্ষে এইভাবে সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করে দেওয়া এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব হয় কি? কস্মিনকালেও না। এর কারণ তারা একটি শ্রেণির কাছে আত্মবিক্রয় করেছেন। এটা চিরকাল হয়ে এসেছে যে, কোনো শাসক যখন অন্যায় করেন তখন সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্যায়ের সমর্থনে বা নিজ দায়মুক্তির জন্য আইনও তৈরি করেন। সেই আইন তৈরি করে দেন আইন পরিষদের সদস্যরা, এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন বুদ্ধিজীবীরা। পূর্বকালে যখন ধর্মের আইন দিয়ে রাষ্ট্র চলত তখন শাসকের অন্যায়কে সমর্থন যোগাতে ধর্মের বিধানের মধ্যেও যোগ-বিয়োগ করা হয়েছে। সেটা করেছেন তখনকার ধর্মবেত্তাগণ তথা আলেমগণ। তাদের তৈরি করা শরিয়তকেই স্রষ্টার বিধান বলে কার্যকর করা হয়েছে। আজকে আমরা ইসলামের যে রূপটি দেখি সেটার খুব সামান্যই স্রষ্টার নাজিল করা। বাকিটা ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রণীত। সুলতান, বাদশাহদের পাপ কাজকে কোর’আন সুন্নাহর মাপকাঠিতে বৈধতা দিতে তারা ভাড়াটিয়া আলেমদের ব্যবহার করেছেন যারা পদ ও সম্পদের লোভে জনগণকে ইসলাম সম্পর্কে ভুল শিখিয়েছে। আজও এই শ্রেণিটি আমাদের সমাজে রয়েছে যারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজনমাফিক ফতোয়া ও ব্যাখ্যা প্রদান করতে অত্যন্ত পটু।
ধর্মব্যবসার একটি অতি প্রচলিত রূপ হচ্ছে মসজিদগুলোতে নামাজের ইমামতির চাকরি করা। বর্তমানে এটাই সর্বজনবিদিত রেওয়াজে (Tradition) পরিণত হয়েছে যে সমাজে যারা বিত্তবান, প্রভাবশালী (যাদের বিরাট একটি সংখ্যা দুর্নীতিগ্রস্ত) তাদেরকে মসজিদ কমিটির পরিচালক বা সদস্য করা হয়। তাদের আয়ের উৎস কী সেটা নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তোলে না, তাদের অর্থ আছে, প্রভাব আছে এটাই যোগ্যতার মানদণ্ড। এর উদ্দেশ্য যে প্রধানত অর্থনৈতিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মসজিদের ইমামগণ এই কমিটির অধীনে চাকরি করেন। তাদের চৌহদ্দি মসজিদের চার দেওয়াল। কেউ মারা গেলে, দোকান উদ্বোধন, মুসলমানি, বিয়ে পড়ানোর জন্য, গরু বকরি জবাই করতে তাদের ডাক পড়ে। জীবনের বাস্তব অঙ্গনে তাদের কোনো অংশগ্রহণের সুযোগই নেই।
এবার দেখুন ইমামতির হাল:
খ্রিষ্টানদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থার ফলে আমাদের সমাজেও দুই ধরনের নেতা সৃষ্টি হয়েছে – ধর্মীয় নেতা এবং অধর্মীয় নেতা। আজ মসজিদে যে নামাজ হয় তাতে অর্ধশিক্ষিত কয়েক হাজার টাকার বেতনভোগী ‘ধর্মীয়’ ইমাম সাহেবের পেছনে তার তকবিরের (আদেশের) শব্দে ওঠ-বস করেন সমাজের ‘অধর্মীয়’ অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা। নামাজ শেষ হলেই কিন্তু ঐ ‘অধর্মীয় নেতারা’ আর ‘ধর্মীয় নেতা’র দিকে চেয়েও দেখেন না। কারণ তারা জানেন যে ঐ ‘ধর্মীয়’ নেতার দাম কয়েক হাজার টাকা বেতনের বেশি কিছুই নয়, জাতীয় জীবনে তার কোনো দাম নেই, প্রভাব নেই, কর্তৃত্ব নেই। ঐ ‘ধর্মীয় নেতারা’ অর্থাৎ ইমামরা যদি ‘অধর্মীয় নেতাদের’ সামনে কোনো ধৃষ্টতা-বেয়াদবি করেন বা কোনো একটি আদেশের অবাধ্যতা করেন তবে তখনই তাদের নেতৃত্ব অর্থাৎ মসজিদের ইমামতির কাজ শেষ। পশ্চিমা খ্রিষ্টান প্রভুদের অন্ধ অনুকরণ ও আনুগত্য করতে করতে এ জাতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, ঐ খ্রিষ্টানদের পাদ্রীদেরও তাদের জাতির উপর যেটুকু সম্মান ও প্রভাব আছে, এই ‘ইমাম’ সাহেবদের তাও নেই। কমিটির লোকেরা যত বড় অন্যায়ই করুক, সুদখোর হোক, মাদকব্যবসা করুক, ঘুষখোর হোক, ধান্ধাবাজির রাজনীতি করুক সেগুলোর শক্ত প্রতিবাদ ইমাম সাহেবরা করতে পারেন না।
এ তো গেল ব্যক্তিস্বার্থে ধর্ম বিক্রি। এভাবে বহুরকম স্বার্থে যখন ন্যায়ের কণ্ঠস্বর মৌন হয়ে যায়, তখন ‘ধর্ম’ পরাজিত হয়ে যায়। আর ধর্মের মিম্বরে দাঁড়িয়ে যখন অধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা হয় না, তখন সমাজ থেকে ধর্ম বিদায় নিতে সময় লাগে না। অথচ মানুষের মর্জিমত না চলে আল্লাহর আয়াত দ্বারা যাবতীয় অন্যায়কে প্রতিহত করাকেই আল্লাহ জেহাদে আকবর, বড় জেহাদ বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের (কাফের) আনুগত্য করো না এবং এর (আল্লাহর কেতাব) দ্বারা শ্রেষ্ঠ জেহাদ (জেহাদে আকবর) করো।” [সুরা ফোরকান ৫২] তিনি আরেকটি আয়াতে বলেছেন, “আমরা সত্য দ্বারা মিথ্যাকে আঘাত করি, অতঃপর তা মিথ্যার মস্তক চ‚র্ণ করে দেয়। মিথ্যা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।”(২) [সূরা আম্বিয়া: ১৮] সত্য আসে মিথ্যাকে দূর করার জন্যই। এজন্যই আল্লাহ আরো বলেছেন, সত্য যখন আসে তখন মিথ্যাকে বিতাড়িত হতেই হয়। মিথ্যা তো বিতাড়িত হওয়ারই বিষয়।(৩) [আল কোর’আন, সুরা বনী ইসরাইল ৮১] কাজেই ধর্মের মিম্বরে দাঁড়িয়ে সত্য দ্বারা মিথ্যাকে আঘাত করতে না পারলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে না পারলে ঐ মিম্বরে দাঁড়ানোই নিরর্থক। এজন্যই আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, “সর্বোত্তম জেহাদ হচ্ছে অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা।” [হাদিস: তিরমীজি, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, দারেমি]।
যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ অর্থাৎ আদর্শিক লড়াই করার হিম্মত, সাহস ও যোগ্যতা জাতির মধ্যে থেকে লুপ্ত হয়ে গেল, তখন ভারসাম্যহীন সুফিবাদীরা বিকল্প হিসাবে নফসের বিরুদ্ধে জেহাদকে আবিষ্কার করলেন। আজকে জেহাদে আকবর বলতেই বোঝানো হয় নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ। এ জেহাদের আবিষ্কর্তারা তাদের বক্তব্যের সমর্থনে মাত্র তিনটি হাদিসের উল্লেখ করতে পেরেছেন। এগুলোর একটি বর্ণনা করেছেন ইবনে নাজ্জার, একটি দায়লামি ও তৃতীয়টি খতিব। সমস্ত মুহাদ্দিসগণ এক বাক্যে ঐ তিনটি হাদিসকে দুর্বল অর্থাৎ দয়ীফ বলে রায় দিয়েছেন। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীর মতো বিখ্যাত মুহাদ্দীস ঐ হাদিসগুলোক হাদিস বলেই স্বীকার করেন নি। বলেছেন নফসের সঙ্গে যুদ্ধ জেহাদে আকবর, এটা হাদিসই নয়। এটি একটি আরবি প্রবাদবাক্য মাত্র [তাশদীদ উল কাভেস- হাফেজ ইবনে হাজার]। গত কয়েক শতাব্দী ধরে আল্লাহর ঘোষণার বিপরীত এই ‘জেহাদে আকবর’ চালু করার ফল এই হয়েছে যে, সমগ্র জাতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের চরিত্র হারিয়ে নির্জীব, নিবীর্য্য, নিষ্প্রাণ হয়েছে। সেজন্য তাদের আবিষ্কৃত আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদও দুনিয়া জোড়া তাদের মার খাওয়া ঠেকাতে পারল না, গোলাম হওয়া ঠেকাতে পারল না এমন কি চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে সৃষ্ট সামাজিক অপরাধও দূর করতে পারল না।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ধর্মের বিবিধ কাজ করে বিনিময় গ্রহণকারীরা যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন না, বরং অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন তার মূল কারণ কী? সেটা হচ্ছে অপরের কৃপার মুখাপেক্ষী থাকার দরুণ তাদের নৈতিক মেরুদণ্ড ধ্বংস হয়ে যায়। দাতার শির সর্বদা উঁচু থাকে আর গ্রহীতার শির থাকে নিচু। যাদের বেতনে, অনুকম্পায়, দানে-দক্ষিণায় তাদের সংসার চলে, তাদের দ্বারা সংঘটিত কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এই শ্রেণিটির পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে, কাউকে সত্যের উপর দণ্ডায়মান থাকতে হলে কোনভাবেই নিজে অন্যের দানের উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। দানে-দক্ষিণার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি কার্যত দাতার গোলামে পরিণত হয়, নেতা হতে পারে না। আর মসজিদ কমিটির দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের অনেকে এমনিতেই সামাজিক নীতি নৈতিকতার ধার ধারেন না, সামাজিক ক্ষমতা বা রাজনৈতিক শক্তির দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, এর উপরে যখন ধর্মনেতাদেরকেও তারা টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন তখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতেও তারা কুণ্ঠিত হন না। এজন্য যখন কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে, কোনো ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টির ঘটনা ঘটে তখন এই লোকগুলো সেটাকে ব্যবহার করে অন্যের বাড়িঘর, জমিজমা দখল করে নেন, যথাসম্ভব সর্ব উপায়ে স্বার্থ হাসিল করেন। ধর্মব্যবসা টিকে থাকার দরুনই এই অন্যায় অবস্থাগুলো সমাজে সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থাকে। কাজেই ধর্মের বিনিময়ে কোনোরূপ স্বার্থোদ্ধারের বিষয়ে ইসলাম এত কঠোর। যখন থেকে আল্লাহর এই হুকুম অমান্য করে নানা অসিলা দিয়ে দীনের বিনিময় নেওয়াকে বৈধ করা হলো তখন থেকে এ জাতির আলেমদের যে অংশটি বিনিময় নিতে শুরু করল তারা আর ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকতে পারলেন না। কিন্তু এ অবস্থা আল্লাহ-রসুলের কাম্য হতে পারে না। বরং যারাই আল্লাহর দীনের এলেম অর্জন করেছেন, আমাদের কাম্য আমাদের ইমাম সাহেবরা যেন প্রকৃতপক্ষেই ইমাম (নেতা, Leader) হন, সমাজে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক, তাদের মেরুদণ্ড সোজা হোক, শির উন্নত হোক, সমাজ তাদের আনুগত্য করুক। পরাশ্রয়ী মর্যাদাহীন জীবন থাকার চেয়ে জীবন না থাকা ভালো। এই উন্নত জীবন লাভ করার একটাই শর্ত, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্যের উপর দণ্ডায়মান হতে হবে। আর এর পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে তাদের ধর্মব্যবসা।
অন্যায়কারী ও অন্যায় সহ্যকারী উভয়ই সমান অপরাধী। ধর্মব্যবসা জাতিকে কাপুরুষের মতো মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার শিক্ষা প্রদান করে। যারা সমাজের অন্যায়, অবিচার দেখেও তা বন্ধ করার লক্ষ্যে সংগ্রাম পরিচালনা না করে মৌন থাকে, সে আস্তিক বা নাস্তিক, আলেম বা মূর্খ, মুত্তাকী বা বেপরোয়া, নামাজী বা বে-নামাজী যা-ই হোক না কেন, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে মুজরিম (অপরাধী, Criminal)। হাশরের দিন আল্লাহ বলবেন, “হে অপরাধীরা! আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও” [সুরা ইয়াসীন ৫৯]। তখন এই সর্বগোষ্ঠীর মানুষই অপরাধীদের কাতারে একীভূত হবেন। আল্লাহ মো’মেনদের রিপুজনিত দোষ- ত্রুটি গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অসংখ্যবার। এই মো’মেন হচ্ছে তারা, যারা সমাজে অন্যায় হতে দেন না, অন্যায় প্রতিরোধ করেন, আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা (জেহাদ) করেন।
মুসলমান সমাজের পরহেজগার ব্যক্তিরা নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদির দ্বারা পুণ্যসঞ্চয় করে পরকালে মুক্তি পেতে চান, কেননা এগুলোকেই তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল মনে করেন। কিন্তু অন্যায়পূর্ণ সমাজকে বদলে দেওয়ার জেহাদ, অন্যায়কে প্রতিহত করার সংগ্রাম যে ওগুলোর চেয়ে কত গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা কয়জনে বোঝেন, কয়জনে জানেন? তাদের না জানার মূল কারণ তাদেরকে এটা জানতে দেওয়া হয় নি। ইসলামে গুরুত্বের অগ্রাধিকার (Priorities) সম্পর্কে এই অজ্ঞতা তাদের কাজেই প্রমাণিত। তাই সুদখোর কোনো মহাজন বা কোনো রাজনীতিক দলের সন্ত্রাসীও হয়ে ওঠে মসজিদ কমিটির পরিচালক। অনাহারী, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও কথিত ধার্মিকেরা মাথা নিচু করে, চেক রুমাল কাঁধে ঝুলিয়ে, টাখনুর উপরে পায়জামা তুলে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে ছোটেন, রোজা রাখেন, হজ্ব করেন। কারণ আমাদের ধর্মনেতারা এহেন সওয়াব গণনার শিক্ষাই তাদেরকে দিয়ে থাকেন, এমন সমাজবিমুখ ধর্মশিক্ষাই বিদ্যালয়ে, মক্তব-মাদ্রাসায় দেওয়া হয়। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “আমি কি তোমাদের এমন লোকদের কথা বলব, যারা আমলের দিক থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত? (এরা হচ্ছে) সেসব লোক যাদের সকল প্রচেষ্টা এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে, তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে।” [সুরা কাহাফ: ১০৩-১০৪]
“যেদিন তারা মালায়েকদেরকে দেখবে, সেদিন অপরাধীদের (মুজরিম) জন্য কোনো সুসংবাদ থাকবে না এবং মালায়েকরা বলবে, (জান্নাত তোমাদের জন্য) হারাম ও নিষিদ্ধ। আমি তাদের আমলসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত করে দেব।” [সুরা ফোরকান ২৩]
আদ-সামুদ ইত্যাদি জাতিগুলোকে আল্লাহ যখন ধ্বংস করলেন তখন তাদের মধ্যে কি পরহেজগার লোক ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। কিন্তু তাদের পরহেজগারির তোয়াক্কা আল্লাহ করেন নি। কারণ সেই পরহেজগার লোকগুলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় নি। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে এমন সৎকর্মশীল কেন রইল না, যারা পৃথিবীতে অরাজক পরিস্থিতি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে বাধা দিত; তবে মুষ্টিমেয় লোক ছিল যাদেরকে আমি তাদের মধ্য হতে রক্ষা করেছি। আর পাপিষ্ঠরা তো ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল যার সামগ্রী তাদেরকে যথেষ্ট দেয়া হয়েছিল। আসলে তারা ছিল মহা অপরাধী।” [সুরা হুদ ১১৬]
এ আয়াতের শেষ শব্দটিও মুজরেম অর্থাৎ অপরাধী। কারা সেই অপরাধী তা তো আয়াতেই পরিষ্কার। আর বোঝাই যাচ্ছে, আল্লাহ সেই মুষ্টিমেয় লোকদেরকেই রক্ষা করেছেন এবং করবেন যারা সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত অর্থাৎ মো’মেন।
আজ বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যে দেশগুলো এখনও সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় নি সেসব দেশের অধিকাংশ নাগরিকই যার যার সাধ্যমত ভোগবিলাসে মেতে থেকে জীবন উপভোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য, অনিবার্য বিপর্যয় থেকে নিজেদের দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর জন্য আলেম দাবিদার, ধর্মের নামে স্বার্থ হাসিলকারী শ্রেণিটির কার্যকর কোনো ভূমিকাই নেই। আর যারা নিজেদেরকে আলেম বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে মৌন, কেবল দোয়া মেঙ্গেই দায় সারতে চান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে চান না। সামাজিক কর্মকাণ্ড, সমাজ পরিবর্তন ইত্যাদি কাজকে তারা দুনিয়াবী কাজ বলে ঘোষণা দিয়ে, সমাজকে দুর্বৃত্তের হাতে ছেড়ে দিয়ে গা বাঁচিয়ে চলেন। মসজিদে পর্যন্ত নোটিশ টানিয়ে দেন – “মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা হারাম।” এমন হাদিসও তারা উদ্ভাবন করেছেন যে, মসজিদে দুনিয়াবি কথা বললে নাকি ৪০ বছরের আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যেখানে নবী এবং সত্যনিষ্ঠ খলিফাগণ এই মসজিদে বসেই দুনিয়ার বিরাট ভূখণ্ড শাসন করে গেছেন সেখানে তারা কী করে এমন ধ্বংসাত্মক দুনিয়াবিমুখ ফতোয়া জারি করে দিলেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস এই যে, তারা যতই উটপাখির মতো আত্মপ্রতারণা করে দুনিয়াবি সবকিছু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন না কেন, প্রলয় এড়াতে পারবেন না, দুর্বৃত্ত রাজনীতিকরা, জঙ্গিবাদীরা, সাম্রাজ্যবাদীরা প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়বে। সেই প্রলয় থেকে অতি পরহেজগার ও বুজুর্গ ব্যক্তিও বাঁচতে পারবেন না। ইরাক সিরিয়া আফগানিস্তানের অতি পরহেজগার বুজুর্গরাও রেহাই পায় নি। কারণ এটা প্রাকৃতিক বিধান যা এই জাতির তকদিরে পূর্বেও ঘটেছে। উদাহরণ- এক সময়ের বোখারা, সমরকন্দ, বাগদাদ, কর্ডোভা, আলেকজান্ড্রিয়া ইত্যাদি অঞ্চলগুলো ছিল ইসলামের বিদ্যাপীঠ, পণ্ডিত, আলেম, বুজুর্গদের স্বর্গভূমি। আর আজ সেখানে মৃত্যুপুরি, ধর্মহীনতা, ধর্মবিদ্বেষ আর নাস্তিক্যের চারণভূমি। যারা এই বিধান বুঝতে অক্ষম, তাদের রসুলাল্লাহর (সা.) স্মরণ করা উচিত। তিনি বলে গেছেন, “কোনো সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কিছু লোক যদি অন্যায় কাজ সংঘটিত করে এবং সেটা পরিবর্তন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যরা যদি সেটা না করে তাহলে আল্লাহ তাদের সবার উপরে আযাব নাযিল করেন।” [হাদিস: হাইসাম (রা.) থেকে আহমদ।]
এই সমাজকে বদলে দেওয়ার সামর্থ্য মানুষের অবশ্যই আছে, যদি একটি মাত্র শর্ত তারা পূরণ করে। সেটা হলো- যদি তারা তাবৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে একদেহ একপ্রাণ হয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। কোটি কোটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তির সামনে কোনো বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু কে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধায় পরিণত করবে? যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, সেই আলেম সমাজ, ধর্মনেতারা তো কয়েক হাজার টাকার বেতনেই পরিতুষ্ট। ও দিয়েই তারা পার্থিব জীবনটা কাটিয়ে কোনোমতে জান্নাতুল ফেরদাউসে (!) চলে যেতে চান।
ধর্মের নামে কিছু আনুষ্ঠানিক উপাসনার দ্বারা ধর্মব্যবসা বেঁচে থাকে, তাই ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের সমাজকল্যাণকর বাস্তব জীবনমুখী সবকিছু ছেটে ফেলেও অনুষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখেন। সব আমলের যেন এক উদ্দেশ্য- বহুত সওয়াব হবে, বহুত ফায়দা হবে; সেই সব সওয়াব জমিয়ে জান্নাতের টিকিট কেনা যাবে। অথচ আল্লাহর রসুল (স.) বলেছেন, ‘দুনিয়ার জীবন হচ্ছে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।’
সুতরাং যাদের দুনিয়ার জীবন সফলতাপূর্ণ, আখেরাতে তারাই সফল। দুনিয়ার জীবনে যারা লাঞ্ছিত অপমানিত, আখেরাতের জীবনে তারা আরো অধিক লাঞ্ছিত অপমানিত হবে। এ সত্য উপলব্ধি করেই জাগরণের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “জীবন থাকিতে বাঁচিলি না তোরা, মৃত্যুর পরে রবি বেঁচে?” দুনিয়ার জীবনেই যারা আল্লাহর লানতের, গজবের, ক্রোধের, শাস্তির পাত্র, আখেরাতে তারা আরো অধিক অপদস্থ হবে, মর্মন্তুদ শাস্তির আঘাতে দিশাহারা হবে। এ কারণেই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে আমাদেরকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর করো আর আমাদের আখেরাতের জীবনকেও সুন্দর করো। এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ করো।” [সুরা বাকারা ২০১]
আল্লাহর রসুল যে জাতিটা গঠন করে গিয়েছিলেন সেই জাতি সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সর্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল। সেই ইসলাম নামক পরশমণির ছোঁয়ায় যে আরবরা নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির সামনে মাথা নোয়াতো তারা আকাশের জ্যোতির্মণ্ডলী নিয়ে গবেষণায় যুগান্তকারী অবদান রাখল। যারা ছিল জাহেলিয়াত অর্থাৎ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত তারা জ্ঞানের প্রদীপ্ত মশালকে ধারণ করে বিশ্ববাসীকে পথ দেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করল। সম্পদের প্রাচুর্য, সামরিক শক্তি, প্রতাপ, মানবিক গুণাবলী শিক্ষা কোনো বিষয়ে তাদের সাথে তুলনা করা যায় এমন কোনো মানবগোষ্ঠী সেই কয়েকশ’ বছর পৃথিবীতে ছিল না। তাদের দুনিয়াও সুন্দর ছিল নিঃসন্দেহে আখেরাতও সুন্দর হবে। কিন্তু আমাদের দুনিয়ার জীবনটা এমন কদর্য কেন? আমরা কেন শত শত বছর ধরে অন্য জাতিগুলোর কাছে মার খেয়ে যাচ্ছি? কেন আমরা আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার বদলে পাশ্চাত্য পরাশক্তিগুলোর চাপিয়ে দেওয়া জীবনব্যবস্থাগুলো মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছি? আজকে আমাদের প্রভু আল্লাহ নন, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। আমরা বাস্তব জীবনে তাদেরই আনুগত্য করছি আর পূর্বপুরুষের অনুকরণে আল্লাহর প্রতি প্রথাগত সেজদা করে যাচ্ছি। এ সেজদা আল্লাহর সাথে তামাশা বৈ কিছু নয়। কারণ সেজদা হচ্ছে আনুগত্যের প্রতীক। আমি জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনে যার আনুগত্য করছি না, তার পানে মাটিতে কুর্ণিশ করে মাথা ঠেকিয়ে সেজদা করে কী ফল? সে জাল্লে জালাল বে-নেয়াজ আল্লাহ তো আমাদের মেকি সেজদার কাঙাল নন। কাদের কাজের ফলে আমাদের এই হীন পরিণতি?
এর উত্তর পেছনের পৃষ্ঠাগুলোতে রেখে এসেছি। যারা দীনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মতভেদ সৃষ্টি করে জাতিটা অসংখ্য ফেরকা, মাজহাবে বিভক্ত করল, যারা জ্ঞানকে কেবলমাত্র ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করল, যারা বিকৃত সুফিবাদ আমদানি করে জাতির বহির্মুখী গতিকে উল্টিয়ে অন্তর্মুখী করে দিল, নিষ্প্রাণ, জড়তায় জাতির মন মগজকে আচ্ছন্ন করে দিল, সেই কথিত মহাজ্ঞানী (আল্লামা), মহাবুজুর্গদের কাজের পরিণামেই মুসলিম জাতি বল-বীর্যহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে এবং শত্রুর কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হয়ে দাসানুদাসে পরিণত হয়েছে। মুসলিম জাতি কি কখনও অন্য জাতির দাস হতে পারে? কখনোই না। তবু এই জাতির মধ্যে থাকা ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী জাতিকে বুঝতে দিল না যে এই জাতি আল্লাহর দৃষ্টিতে আর মো’মেন, মুসলিম, উম্মতে মোহাম্মদী নেই। তারা কার্যত কাফের ও মোশরেকে পরিণত হয়েছে। ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা এই কাজটি করল। ফলে মানুষ ভাবতে শিখল না, তাদের ধর্মচিন্তার সকল দুয়ারে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো।
মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠীটি এই মুহূর্তে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে, কিন্তু সে হুঁশ তাদের খুব কম লোকেরই আছে। জঙ্গিবাদকে ইস্যু বানিয়ে একটার পর একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। ঘরের পাশে মায়ানমারে বৌদ্ধরা হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করে, নারীদের ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিল, সাগরে ভাসিয়ে দিল। ফিলিস্তিনে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করে তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করা হলো। গণবিধ্বংসী বোমা থাকার মিথ্যে অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথবাহিনী দশ লক্ষ মুসলমানের রক্তে মাটি রঞ্জিত করল। সেখানে এখনও যুদ্ধ চলমান আছে। আফগানিস্তান আক্রমণ করে সেখানকার লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হলো। প্রায় অর্ধলক্ষ মুসলমানের জীবন কেড়ে নিয়ে লিবিয়া ধ্বংস করে দেওয়া হল। সিরিয়া হামলা করে অন্তত পাঁচ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হলো। মধ্য আফ্রিকা উত্তরা আফ্রিকার মুসলিম জনবহুল এলাকাগুলোয় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে দিয়ে লাখে লাখে হত্যা করা হচ্ছে, তাদের মাটির নিচে আল্লাহপ্রদত্ত মহামূল্যবান খনিজ সম্পদগুলো লুট করে নিয়ে তাদেরকে শীর্ণকায়, অসুস্থ, অজ্ঞ, ভিখারির জাতিতে পরিণত করল। বিশ্বে সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান এখন উদ্বাস্তু। খাদেমুল হারামাইন, ইসলামের পীঠস্থান হিসাবে যাদের অহঙ্কারের সীমা নেই, সেই সৌদি আরবের হামলার ফলে ইয়েমেনে চলছে ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ। বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিনারে যার টার্গেট, লক্ষ্যবস্তু এই মুসলমানেরা। ইরাক সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে সাম্রাজ্যবাদীদের হামলা তো চলছেই, তার উপর শিয়া-সুন্নী ব্লকের যুদ্ধও বিরতিহীনভাবে চলছে। সৌদি আরব বিগত দুই বছরে ইয়েমেনের উপর লাগাতার হামলা চালিয়ে প্রায় ১২,০০০ মুসলমানকে হত্যা করেছে। এ হামলা দ্বারা তারা সেখানকার জনগণকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়াচ ডগ’ হিসাবে আখ্যায়িত সৌদি আরব প্রভুদের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে মুসলমানদের উপর ব্যবহার করছে। তারা শিয়া অধ্যুষিত ইরানকে প্রায়শই হুমকি ধামকি দিয়ে থাকে। সম্প্রতি সৌদি উপ যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলমান যুদ্ধ ইরানে নিয়ে যাওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হলে তা হবে ইরানের মাটিতে।” সালমানের এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমরা তাদেরকে মূর্খের মতো কাজ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাব। কিন্তু তারপরও তারা যদি বেকুবের মতো কিছু করে বসে তাহলে মক্কা ও মদীনা ছাড়া সৌদি আরবের আর কোনো জায়গায় হামলা চালাতে আমরা বাদ রাখব না।” [দৈনিক কালেরকণ্ঠ (৯ মে ২০১৭)]
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ইচ্ছানুসারে’ কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে প্রতিবেশী ছয়টি দেশ। কাতারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে সৌদি আরব। কাতারের সমর্থনে এগিয়ে গেছে ইরান ও তুরস্ক। এই অসিলায় কাতারের কাছে চটজলদি ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে ফেলল যুক্তরাষ্ট্র [দৈনিক যুগান্তর ৫ জুলাই ২০১৭]। এভাবেই উত্তেজনাপূর্ণ গোটা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠছে গোলা বারুদের পিঁপে। যে কোনো মুহূর্তে ঘটবে অগ্নিসংযোগ যা উপসাগরীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং অনিবার্যভাবেই বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে। কেননা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জোট ন্যাটো, ইসরাইল সকলেই মুখিয়ে আছে সন্ত্রাসী অর্থাৎ ‘মুসলিম’ নিধনের জন্য। আর দুনিয়াটা দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতার’ হাতের মুঠোয়। সবাই হন্যে হয়ে বিধ্বংস ঘটানোর একটি অসিলা তালাশ করছে শুধু। এমতাবস্থায় যারা চলনে বলনে ইসলামের কাণ্ডারি, যাদেরকে এই জনগোষ্ঠী ধর্মের পুরোহিত পুরোধা, ধর্মের ধ্বজাধারী বলে মান্য করে, সমীহ করে, যাদের ওয়াজে প্রভাবিত হয়ে চোখের পানি প্রবাহিত হয় সেই কথিত আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কোটি কোটি মানুষ তারা জাতির এই দুর্দিনে কী ভূমিকা রাখলেন বা রাখবেন বলে ঠিক করেছেন? আমরা দেখতে পাচ্ছি, একেবারে কিছুই না। তারা আজও ব্যস্ত আছেন তাদের নামাজ রোজার ফজিলত নিয়ে, তারাবি নিয়ে, ঈদ-কোরবানি-হজ্ব নিয়ে, শবে বরাত নিয়ে, ব্যস্ত আছেন ভাস্কর্য, সঙ্গীত ইত্যাদি জায়েজ নাকি না-জায়েজ ইত্যাদি বিষয়ের ফতোয়াবাজি নিয়ে, ব্যস্ত আছেন খানকায় মিলাদে ওরশ মোবারকে। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দীনরক্ষা ও দেশরক্ষার কাজে তাদের যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে এটাও তাদের আকিদার বাইরে, চিন্তার সীমানার বাইরে চলে গেছে। তারা বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করে নিজেদের তাগদের জানান দিচ্ছেন, এর ওর বিরুদ্ধে গলার রগ ফুলিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন কিন্তু মুসলিম জাতির অস্তিত্বের সঙ্কট উপস্থিত, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। শীতকাল আসলেই ওয়াজ মাহফিলগুলোতে অপ্রয়োজনীয় অনর্থক বিষয়ের পাশাপাশি তারা কখনও বুশের মাথা কাটছেন, মোদির শিরোচ্ছেদ করছেন, ফিলিস্তিন দখলে নিচ্ছেন, ইহুদিদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে তাদের জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন। তাদের ‘জ্বালাময়ী ভাষণ’মানুষকে সাময়িক উত্তেজিত করে শীত তাড়ায় বটে কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না। দিনের বেলায় সেই উত্তেজনার রেশ কেটে যায়। এভাবেই তারা যুগে যুগে নিজেদের স্বার্থে মুসলিম জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের দিকে নিয়ে গেছে, তাদেরকে মগ্ন করে দিয়েছে অবাস্তব চিন্তারভাবনা আর তুচ্ছ বিষয়ের মধ্যে যার সাথে জনস্বার্থের বা জাতির প্রকৃত মঙ্গল-অমঙ্গলের কোনো সম্পর্কই নেই।
যে যে ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে তাদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, যে কাজটি করলে তাদের পকেট ভারি হবে তারা সেই কাজের প্রতিই আরো বেশি বেশি জাতিকে ধাবিত করেন। মসজিদে মাদ্রাসায় আরো বেশি দান করা হোক, আরো বেশি বেশি ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হোক, মানুষ আরো বেশি বেশি মিলাদ পড়াক, আরো বেশি বেশি মানুষ পীরের মুরিদ হোক, আরো বেশি বেশি তারাবির নামাজ পড়া হোক, তাদের অনর্থক আন্দোলনগুলোতে আরো বেশি বেশি মানুষ যোগদান করুক। যেসব দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন হয়েছে সেসব দেশে এখন না আছে মসজিদ, না আছে মাদ্রাসা, না হয় কোনো ওয়াজ মাহফিল আর না হয় কোনো ওরশ মোবারক (!)। কোনো ধর্মের উপাসনালয়ই সেখানে আর আবাদ হয় না। তাহলে সেখানকার প্রকৃত ধার্মিকদের জন্য কোন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল- দেশ ও মাটি, ধর্ম ও ঈমান রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে রণসাজে সজ্জিত হওয়া নাকি আনুষ্ঠানিক উপাসনা করে নেকির পাল্লা ভারি করা? ক্ষুদ্র স্বার্থের পেছনে ছুটে সেসব দেশের ধর্মব্যবসায়ীরা জাতিকে সঠিক পথে না নিয়ে তাদের ঈমানকে ভুল পথে প্রবাহিত করেছে। যার পরিণামে এখন তারা সবাই ইউরোপের পথে পথে ভিক্ষাবৃত্তি করছে নয়তো মাটির সাথে মিশে গেছে। পেটের দায়ে, বেঁচে থাকার অধিকার পেতে তাদের অনেককেই ধর্মান্তরিত হতে হচ্ছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেহব্যবসায় নামতে হচ্ছে। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতের ওয়াজ শোনার অবস্থা আজ আর তাদের নেই। এভাবেই ধর্মব্যবসা ও দীনের অতি বিশ্লেষণের পরিণামে দীনের বিকৃতি আর দীনের বিকৃতির পরিণামে মুসলিম জাতির পচন ও পতনের অধ্যায় ইতিহাসের পাতায় লিখিত হলো।
ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহর কী অবস্থা হবে বলতে যেয়ে একদিন আল্লাহর রসুল (সা.) বললেন- “এমন সময় আসবে যে, এই জাতি পৃথিবীর সব জাতির দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত, পরাজিত হবে। উপস্থিত সাহাবাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ প্রশ্ন করলেন- হে আল্লাহর রসুল! তখন কি পৃথিবীতে তারা এত অল্প সংখ্যক হবে যে, অন্য জাতিগুলো তাদের পরাজিত ও লাঞ্ছিত করবে? মহানবী (স.) তার জবাব দিলেন- “না, সংখ্যায় তারা অসংখ্য হবে।”
জবাব শুনে আসহাবরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন। বিস্মিত হবার কথাই। কারণ তখন ঐ ছোট্ট উম্মাহটার ঈমান ইস্পাতের মতো, আকিদা (দীন সম্পর্কে ধারণা) সম্পূর্ণ ও সঠিক, উদ্দেশ্য পরিষ্কার, উদ্দেশ্য অর্জন করার প্রক্রিয়া দৃঢ়, ঐক্য লোহার মতো; দুর্বলতা শুধু এই জায়গায়- সংখ্যাল্পতায়। তাই এর জবাবে তারা যখন শুনলেন যে, সেই একমাত্র দুর্বলতাই থাকবে না, সংখ্যায় ঐ উম্মাহ হবে অগণিত, তখন পরাজয় কী করে সম্ভব? বিশেষ করে যখন ঐ ছোট্ট উম্মাহ তাদের চেয়ে সংখ্যায় বহু বেশি, সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত শত্রুদের বারবার পরাজিত করেছেন।
তারা আবার মহানবীকে (সা.) প্রশ্ন করলেন- “আমরা সংখ্যায় অসংখ্য হলে পরাজয় কী করে সম্ভব?” রসুল (সা.) জবাব দিলেন একটা উপমা দিয়ে, বললেন,“মনে করো শত শত উট, কিন্তু উটগুলো এমন যে যেটার উপরই চড়ে বসতে যাও ওটাই বসে পড়ে বা পড়ে যায়। ঐ অসংখ্যের মধ্যে খুব কম উটই পাওয়া যাবে যেগুলোর পিঠে চড়া যাবে।” [হাদিস: আবুদল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারী ও মুসলিম]
বিশ্বনবীর (সা.) উপমাটা লক্ষ্য করুন- উট। উটের উদ্দেশ্য কী? উট দিয়ে কী কাজ হয়? উট হচ্ছে বাহন, মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেইটাই যদি উট দিয়ে না হয় তবে ঐ উট অর্থহীন- দেখতে অতি সুন্দর উট হলেও এবং সংখ্যায় অসংখ্য হলেও।
শেষনবীর (সা.) সেই ভবিষ্যদ্বাণী বহু আগেই বাস্তবায়িত হয়েছে, জাতির সদস্য সংখ্যা অগণিত হওয়া সত্ত্বেও শত্রুর পদানত দাস হয়েছে, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মহানবীর (সা.) বর্ণনা অনুযায়ী এরা দেখতে অতি সুন্দর উট, লম্বা কোর্তা, পাগড়ী, লম্বা দাড়ি, ছেটে ফেলা মোচ, টাখনুর ওপরে ওঠানো পাজামা, কাঁধে চেক রুমাল, দিনে পাঁচবার মসজিদে দৌঁড়াচ্ছেন, গোল হয়ে বসে চারিদিক প্রকম্পিত করে আল্লাহর যিকর করছেন, খানকায় বসে মোরাকাবা, কাশফ করছেন, তাদের লেবাসে আর ছোটখাটো আমলে ভুল ধরে এমন সাধ্য কারো নেই। দেখতে একেবারে নিখুঁত উট। কিন্তু আসলে উট নয়, ওদের পিঠে চড়া যায় না, চড়লেই বসে পড়ে।
[লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি, ই-মেইল: mdriayulhsn@gmail.com]