হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মব্যবসার উৎপত্তি হলো কী করে?

রিয়াদুল হাসান: স্রষ্টার পক্ষ থেকে যত নবী-রসুল-অবতারগণ এসেছেন, তারা সবাই যে জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা। তাঁরা যেখানেই স্রষ্টাপ্রদত্ত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানেই অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম শব্দের অন্যতম অর্থ হচ্ছে শান্তি। তাই বলা যায়, পূর্বের সবগুলো ধর্মই আসলে ‘ইসলাম’ যার ধারাবাহিকতায় আল্লাহ শেষ নবীর (সা.) উপর নাযেল করেছেন শেষ কেতাব আল কোর’আন। এই শেষ ইসলামে ধর্মব্যবসায়ী পৃথক কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী ধর্ম সম্পর্কে এমন অজ্ঞ থাকবে যে আল্লাহর কাছে মোনাজাতটাও ঠিকমত করতে পারবে না, আর বৃহত্তর জনসাধারণ থেকে আলাদা একটি বেশভূষা চিহ্নিত শ্রেণি যারা অর্থের বিনিময়ে আমাদের মসজিদগুলিতে নামাজ পড়াবেন, মিলাদ পড়াবেন, জানাজা পড়াবেন, কবর জেয়ারত করে দেবেন, ফতোয়া দিবেন, বিয়ে পড়িয়ে দিবেন ইত্যাদি ধর্মীয় কাজগুলি করে দিবেন, আর ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ বৃহত্তর জনসাধারণ ইসলাম সম্পর্কে এ শ্রেণিটির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে এমন কোনো ব্যবস্থা ইসলামের প্রাথমিক যুগে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ছিলই না। তাহলে তাদের জন্ম হলো কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাব জানতে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম পুরুষ মোহাম্মদ (সা:) কে আল্লাহ সর্বশেষ নবী হিসাবে মনোনীত করলেন। তাঁকে আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন তা তিনি পবিত্র কোর’আনে অন্ততঃ তিনবার সুস্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি স্বীয় রসুল প্রেরণ করেছেন হেদায়াহ ও সত্যদীন (ন্যায়পূর্ণ জীবনব্যবস্থা) সহকারে এই জন্য যে, রসুল যেন একে অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থার উপরে বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন (সুরা সফ ৯, সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮)। মানবজাতির একেকটি অংশ একেক শাসকের অধীনে একেক রকম বিধি-বিধান, নিয়মকানুন মেনে জীবন পরিচালনা করছে। সেই সব মানুষকে একটি ন্যায়পূর্ণ জীবনব্যবস্থার ছায়াতলে নিয়ে আসার চেয়ে কঠিন কাজ, গুরু দায়িত্ব আর কী হতে পারে? সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তাদের জীবন চলার পথে আল্লাহ যেটাকে ন্যায় বলেছেন সেটাকেই ন্যায় বলে মান্য করবে, আল্লাহ যেটা নিষিদ্ধ (হারাম) করেছেন তা খাদ্য হোক কি কার্য হোক, সেটা মানবে না এমন একটি অবস্থারই নাম হচ্ছে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। আল্লাহর দেওয়া দিকনির্দেশনাই সঠিক এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই হচ্ছে হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করা একটি জীবনব্যবস্থাও আল্লাহ রসুলকে দান করলেন। সমগ্র মানবজাতির জীবনধারা পাল্টে দেওয়ার এই বিশাল দায়িত্ব একা পালন করার প্রশ্নই আসে না। তাই শুরুতেই তিনি মানুষের মধ্যে তওহীদের আহ্বান প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তিনি মানবজাতিকে আহ্বান করলেন, “হে মানবজাতি! তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা নেই। তাহলেই তোমরা সফল হবে”।
সুতরাং এটা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, এই শেষ দীনের লক্ষ্য হচ্ছে পুরো মানবজাতিকে একটি জীবনব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা, একজন নেতার নেতৃত্বে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মহাজাতিতে পরিণত করা। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে রসুলাল্লাহ ১৩ বছর মক্কায় কেবল তওহীদের ডাক দিয়ে গেলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন আম্মা খাদীজা (রা.), যায়েদ (রা.), আম্মার (রা.), ওমর (রা.), আলী (রা.), আবু বকর (রা.), বেলাল (রা.) প্রমুখ সাহাবীগণ। রসুলাল্লাহ এবং তাঁর আসহাবগণ তওহীদের ডাক দিতে গিয়ে ১৩ বছর মক্কায় অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করলেন। তারপর আল্লাহ যখন তাঁকে মদিনায় একটি জনগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব দান করলেন তিনি সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন এই জাতির মধ্যে এর আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে কোন মতভেদ ছিল না। পুরো উম্মতে মোহাম্মদী ছিল একটি জাতি এবং তাদের নেতা ছিলেন একজন স্বয়ং রসুলাল্লাহ। রসুলাল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় ঐ জাতিকে সঙ্গে নিয়ে জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম) চালিয়ে গেলেন এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার অধীনে এলো। বাকী পৃথিবীর যাবতীয় অন্যায় অবিচার দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব স্বীয় উম্মাহকে দায়িত্ব অর্পণ করে রসুলাল্লাহ প্রভুর কাছে চলে গেলেন। রেখে গেলেন পাঁচ দফার অমূল্য এক কর্মসূচি। এই কর্মসূচি তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করার সময় বলছেনÑ এই কর্মসূচি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, (আমি সারাজীবন এই কর্মসূচি অনুযায়ী সংগ্রাম করেছি) এখন এটা তোমাদের হাতে অর্পণ করে আমি চলে যাচ্ছি। সেগুলো হলো:
(১) ঐক্যবদ্ধ হও; (২) (নেতার আদেশ) শোন; (৩) (নেতার ঐ আদেশ) পালন করো; (৪) হেজরত করো; (৫) (এই দীনুল হক কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করো।
যে ব্যক্তি (কর্মসূচির) এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হলো, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেললো- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামায পড়লেও এবং রোযা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত]।
উম্মতে মোহাম্মদী এ কর্মসূচি ও তাদের উপরে তাদের নেতার অর্পিত দায়িত্ব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ এই যে, ঐ উম্মাহ বিশ্বনবীর (দ.) ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পার্থিব সব কিছু কোরবান করে তাদের নেতার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করতে জন্মভূমি আরব থেকে বের হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন এক নেতার নেতৃত্বে বজ্রকঠিন ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, নেতার হুকুমে জীবন উৎসর্গকারী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্বিনীত আপসহীন জাতি। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ তো ছিল না। রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কিছু সাময়িক মতবিরোধের ইতিহাস থাকলেও সেটা গোটা জাতির প্রাণশক্তিকে হরণ করতে পারে নি। ফলে অল্পসময়ে তারা অর্ধদুনিয়ায় একটি নতুন শান্তিময় সভ্যতার উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হন যা পরবর্তীতে সুফলদায়ী মহীরুহের আকার ধারণ করে। মোটামুটি ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত এই জাতি তার লক্ষ্যে অটল থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল। পরিণতিতে অর্ধ পৃথিবী ইসলামের ছায়াতলে এসে গিয়েছিল, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীতে একটি মহান সভ্যতার ভিত নির্মিত হলো।
সেই জাতির কোর’আনের কোন অখণ্ড কপিও ছিল না, হাদিসের কোন বই ছিল না, ফেকাহ, তফসির, ফতোয়ার কেতাব তো দূরের কথা। তবু অর্ধেক দুনিয়া আল্লাহ এ জাতির পায়ের নিচে দিয়ে দিলেন। এর কারণ মো’মেনের সংজ্ঞা কী তা এ জাতির সামনে সুস্পষ্ট ছিল। সেটা হচ্ছে, আল্লাহ বলেছেন, কেবলমাত্র তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি বিশ্বাস (তওহীদ) স্থাপন করে, অতঃপর এতে কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ না করে দৃঢ়পদ থাকে এবং আল্লাহ রাস্তায় নিজ জীবন সম্পদ দিয়ে জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে। এরাই সত্যনিষ্ঠ।” (সুরা হুজরাত ১৫)। প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী এই সংজ্ঞার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ মো’মেন ছিলেন যদিও তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর। কোনো বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে তারা নেতার সিদ্ধান্তের উপর ন্যাস্ত করে দিতেন এবং নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। ভুলেও জাতির ঐক্য নষ্ট করে ‘কুফর’ করতেন না। দীনের ছোটখাট বিষয়গুলি নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী, আল্লামা, মওলানা, মুফতি, মোফাসসের টাইটেলধারী, মসজিদে, খানকায়, হুজরায় নিরাপদে বসে জনগণের মধ্যে ফতোয়া প্রদান করে জীবিকা নির্বাহকারী একটি আলাদা ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি কল্পনাও করা যেত না।
তারপর শুরু হলো সেই দুঃখজনক অধ্যায়। আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন যে, তাঁর উম্মাহর আয়ু হবে ৬০/৭০ বছর (আবু হুরায়রা (রা.) থেকে মুসলিম)। ঠিকই তাই হলো। ৬০/৭০ বছর পরে এই উম্মাহ তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলল। জাতির নেতৃত্ব ভুলে গেল এ জাতির উদ্দেশ্য সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবন থেকে সর্বপ্রকার অন্যায় অশান্তি নির্মূল করে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে তারা অন্যান্য রাজা বাদশাহদের মত শান শওকতের সঙ্গে রাজত্ব করতে লাগল। আল্লাহর রসুলের সৃষ্টি করা উম্মতে মোহাম্মদীর মোজাহেদরা অর্ধাহারে অনাহারে থেকে, জীবন, সম্পদ, ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে যে বিরাট ভূখ- এই নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছিল সেই নেতারা এই বিরাট পার্থিব সম্পদের অধিকারী হয়ে সীমাহীন ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পারসিয়ান ও রোমান বাদশাহ কেসরা ও কায়সারদেরকেও ছাড়িয়ে গেল। ধীরে ধীরে জাতি রসুলাল্লাহ ও খোলাফায়ের রাশেদীনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করল, এমন কি তারা আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ পরিত্যাগ করল। জাতির শাসকরা খলিফা পদবি ধারণ করলেও কার্যত আর আল্লাহ রসুলের খলিফা (প্রতিনিধি) রইলেন না। তারা হয়ে গেলেন উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমীয় রাজা বাদশাহ। তাদের সামরিক অভিযানের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো রাজ্যবিস্তার। সাধারণ মুসলিমরা শাসকদের এই আদর্শচ্যুতির বিরুদ্ধে কথা বলতে আরম্ভ করল, শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে লাগল। জাতির মধ্যে ভাঙন ধরল।
জেহাদ যখন ত্যাগ করা হলো, তখন জাতির মূখ্য কাজটিই হারিয়ে গেল, জেহাদ সংক্রান্ত বিপুল কর্মব্যব্যস্ততা হারিয়ে ফেলে সময় অতিবাহিত করার জন্য নতুন নতুন কাজ খুঁজে নিল। এর মধ্যে প্রধান একটি কাজ হলো দীনের বিধি বিধানের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি। জাতির লক্ষ্য ঘুরে গেল ব্যক্তিগত আমলের দিকে, তারা ভাবতে লাগল কিভাবে আরো বেশি পরহেজগার হওয়া যায়। ফরদ নামাজের পরেও আরো বহু বহু রকমের নফল নামাজ বের করা হলো। দীনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় নিয়ে মাসলা মাসায়েল বের করা আরম্ভ হল। মাসলা বের করা হল আদর্শচ্যুত শাসকদের পক্ষে। সেই মাসলার বিপক্ষেও আরেকদল অন্য মাসলা হাজির করতে আরম্ভ করল। এভাবে শুরু হলো দীন নিয়ে মতভেদ। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেল যে, দীনের একটি বিষয়ও রইল না, যেটা নিয়ে কোন বিতর্ক বা দ্বিমত নেই। এভাবে সহজ সরল দীন – শুধু তওহীদ লা- এলাহা এল্লা আল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কারও সার্বভৌমত্ব, হুকুম মানবো না) এবং এই সার্বভৌমত্বকে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর সংগ্রাম জেহাদ- এই সেরাতুল মোস্তাকীমের উপরেই রসুলাল্লাহ উম্মতে মোহাম্মদীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সেই দীনটি পণ্ডিতদের কাজের ফলে হয়ে গেল জটিল ও দুর্বোধ্য।
একটা জাতির মধ্যে জ্ঞানী, চালাক, বোকা, সর্ব রকম মানুষই থাকবে, সব নিয়েই একটি জাতি। সুতরাং লক্ষ্য যদি জটিল হয় তবে সবার তা বোধগম্য হবে না। জাতির যে অংশটুকু শিক্ষিত ও মেধাবী, শুধু তাদেরই বোধগম্য হবে- সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়ে ঐ লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম করতে পারবে না। তাই আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ.) যে জাতি সৃষ্টি করলেন তার ভিত্তি করলেন অতি সহজ ও সরল-তওহীদ, একমাত্র হুকুমদাতা, এলাহ হিসাবে তাঁকেই স্বীকার করে নেওয়া। এবং জাতির লক্ষ্যও স্থির করে দিলেন অতি সহজ ও সরল জীবনব্যবস্থাকে সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। দুটোই বুঝতে সহজ। সহজ বলেই বিশ্বনবীর (দ.) সৃষ্ট অত্যন্ত অশিক্ষিত জাতিটি, যার মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা যেত, যাদের অনেকেই জানতেনও না যে এক হাজারের উপরে সংখ্যা হয়, তারাও ‘ভিত্তি ও লক্ষ্য’ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা থেকে চ্যুত হন নি এবং তারা সফলভাবে আল্লাহ রসুলের (দ.) উদ্দেশ্য অর্জনের পথে বহু দূর অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু অতি বিশ্লেষণের বিষময় ফলে ঐ দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মোস্তাকীম, সহজ-সরল পথ হয়ে গেল অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য এক জীবন-বিধান, যেটা সম্পূর্ণ শিক্ষা করাই মানুষের এক জীবনের মধ্যে সম্ভব নয়- সেটাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো বহু দূরের কথা।
যে কথাটি পূর্বে বলেছিলাম, জাতির নেতৃত্ব যখন জেহাদ ত্যাগ করল তখন আব্বাসীয়, উমাইয়া, ফাতেমীয় ইত্যাদি নামের শাসকরা নিজেদের এই অন্যায় কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ইসলামের বিধি বিধান সম্পর্কে সেই জ্ঞানী লোকদেরকে ঠিক করল, যারা ইতিপূর্বেই জেহাদ ছেড়ে দিয়ে দীনের মাসলা মাসায়েল নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছিল। এই জ্ঞানীদের নতুন কাজ হলো শাসকের সকল অন্যায় কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং সেগুলির একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তাকে জায়েজ করা এবং প্রয়োজনে রসুলাল্লাহর নামে হাদিস তৈরি করা। বিনিময়ে শাসকদের পক্ষ থেকে তারা লাভ করতে লাগল মদদ, উপঢৌকন, ভোগবিলাসের যাবতীয় উপকরণ সর্বোপরি একটি নিরাপদ নিশ্চিত জীবন। শাসকের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে তারা এভাবে হাজার হাজার জাল হাদিস সৃষ্টি করতে লাগল। পরবর্তী যুগে সেই জাল হাদিসগুলির উপর এজমা, কেয়াস করে তৈরি হলো হাজার হাজার মত, পথ, দল। দলের মধ্যে বিভক্তি করে সৃষ্টি হলো উপদল ইত্যাদি। এই জ্ঞানীরাই হলো ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ধর্মজীবি আলেম যাদেরকে প্রচলিত ভাষায় দরবারী আলেম, ওলামায়ে ছু, দুনিয়াদার আলেম ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। এরা অর্থের বিনিময়ে ধর্মীয় কার্যাদি করে দেওয়াকে হাজারো জটিল কুটিল যুক্তি ও উপমা হাজির করে ‘জায়েজ’ বানিয়ে দিলেন। আল্লাহ মানুষকে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন এবং মানুষকে তার নিজের ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করে কাজ করার সুযোগ প্রদান করেন। সেখানে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না, সম্ভবত এ কারণেই সত্যের সাথে, আল্লাহ রসুলের সাথে এই ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও সেই আলেমদের উপর বিধাতার বজ্র নেমে আসে নি।
ইসলামের বিধান হলো, জাতির নেতা বা এমাম সালাতেরও এমামতি করবেন। তবে বিধর্মী রাজা বাদশাহদের অনুকরণে ভোগবিলাসে লিপ্ত শাসকরা এটুকু উপলব্ধি করলেন যে ‘খলিফা’ বা আমীর’ উপাধি তাদের আর সাজে না, তাই তারা সুলতান, মালিক (রাজা বাদশাহ) ইত্যাদি নাম ধারণ করে রাজতন্ত্রের ষোলকলা পূর্ণ করলেন। এ সময় তারা গাফেলতি করে সালাতে এমামতি করার জন্য মসজিদে উপস্থিত হওয়াও ত্যাগ করতে লাগলেন এবং মসজিদে তাদের পক্ষ থেকে সালাহ কায়েম করানোর জন্য বেতনভুক্ত এমামও নিয়োগ দিলেন। এভাবেই ধীরে ধীরে জাতির মধ্যে জন্ম নিল পৃথক একটি গোষ্ঠী যাদের কাছে বাঁধা পড়ল দীনের সকল কর্মকা-। তাদের হাতে পড়ে দীন বিকৃত হতে শুরু করল। এই যে স্বার্থপরবশ হয়ে ইসলামকে বিকৃত করা হলো, এর অনিবার্য পরিণতি জাতি এড়াতে পারল না। প্রথমে হালাকু খান, তৈমুর লঙ এসে তাদেরকে কচুকাটা করল। ক্রুসেডে মার খেল, স্পেন থেকে নির্মূল হয়ে গেল। পরে ব্রিটিশসহ ইউরোপিয়ান ছোট ছোট জাতিগুলো এসে তাদেরকে ক্রীতদাসে পরিণত করল। কয়েক শতাব্দীর গোলামির জীবন কাটানোর পরও তাদের হুঁশ হলো না। এখনও জাতির ঈমান আমল সেই ধর্মব্যবসায়ীদের হাতেই বন্দী।
সেই তেরশ’ বছর পূর্ব থেকে দীন বিকৃত হতে হতে কালের পরিক্রমায় আজ সম্পূর্ণ বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। এখন যে ইসলামটা আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা আল্লাহ-রসুলের সেই সহজ সরল ইসলাম নয়, এটা ধর্মব্যবসায়ীদের কায়েম করে রাখা একটি বিকৃত ইসলাম যাকে তারা রুটি রুজির বাহন হিসাবে ব্যবহার করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে আবার পবিত্র ইসলামকে এই ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে উদ্ধার করে মানবজাতির কল্যাণে প্রয়োগ করবে, কে শয়তানের কবল থেকে ধর্মকে মুক্ত করে মানবজাতিকে শান্তি দেবে?

লেখক: কলামিস্ট ও সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ
যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫,
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...