আমাদের দেশসহ সমগ্র মানবজাতি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে ভয়াবহ সঙ্কট অতিক্রম করছে। এ সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে, একটার পর একটা জীবনব্যবস্থা ও বিধি-বিধান পরিবর্তন করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং ঐক্য স্থাপিত হচ্ছে না। এ অবস্থার পেছনে ধর্মের অপব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বা নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে। ধর্মের প্রতি অনুভূতিশীল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে বা ঈমানকে এ পর্যন্ত ধর্মব্যবসায়ী একটি শ্রেণি বারবার ভুল পথে পরিচালিত করেছে, যার দ্বারা মানুষের অকল্যাণ সাধিত হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে ব্যতিক্রম কিছু লোক বাদে আমরা সব ধর্মের লোকই স্রষ্টা, নবী-রসুল, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি বিশ্বাস করি। আমাদের এ ধর্মবিশ্বাসকে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী তাদের রাজনীতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। তারা বিভিন্ন ইস্যুতে ধর্মরক্ষার নাম করে মানুষকে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়। কেউবা জেহাদের কথা বলে মানুষকে জঙ্গিবাদে তথা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করে। আবার কেউ মুর্দা-দাফন, নামায পড়ানো, ওয়াজ করা থেকে শুরু করে পরকালে মুক্তি লাভের ওসিলা সেজে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। কিন্তু এর দ্বারা মানুষের কি কোনো উপকার হচ্ছে? না। বরং মানুষ এই বিভিন্ন প্রকার ধর্মব্যবসায়ীর প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এর দ্বারা তারা দুনিয়া আখেরাত উভয়কূলই হারাচ্ছে।
ইসলামকে আজ একটি ব্যক্তিগত ও আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম বলে ধারণা করার ফলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ কিছু আনুষ্ঠানিক বিষয়- নামায, রোযা, ঈদ, কোরবানি, শবে বরাত, আশুরা ইত্যাদি পালন করেই আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন। কিন্তু ইসলাম শব্দটি এসেছে সালাম থেকে আর সালাম মানেই শান্তি। তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনে যদি শান্তি না আসে তাহলে যত নামায, রোযাই করা হোক, ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। এজন্যই আজকের দুনিয়ায় মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, মুসল্লি বা রোযাদারের অভাব নেই, কিন্তু সবচেয়ে অশান্তির মধ্যে আছে মুসলিম নামের এ জনসংখ্যা।
ধর্ম ব্যক্তিগত আর রাষ্ট্র সামষ্টিক এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে। ইউরোপীয়রা ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে নির্বাসন দিয়েছিল কারণ ঈসা (আ.) যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন সেটা ছিল মূলত আত্মিক। জাতীয় জীবন পরিচালনার বিধান তাঁর আনার প্রয়োজন পড়ে নি, সেটা পূর্বের কেতাব তওরাতেই ছিল। কিন্তু ইউরোপে শুধু খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে দণ্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি না থাকায় ধর্মযাজকদের মনগড়া কথাকেই ঈশ্বরের কথা বলে চালিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। তখন সমগ্র ইউরোপেই কয়েক শ’ বছর ধরে রাষ্ট্র ও ধর্মের কথিত ধ্বজাধারীদের মধ্যে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রচণ্ড বিরোধ চলেছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল, মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়েছিল কোটি কোটি মানুষ। উপায়ন্তর না পেয়ে ১৫৩৭ সনে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরির সময়ে ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে আবদ্ধ করা হয়। এই দর্শন ইউরোপে জনপ্রিয়তা পায় এবং গৃহীত হয়। কিন্তু ইসলামে যেহেতু মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিধান আছে, তাই মুসলিমদের ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। তথাপিও ইউরোপীয়রা যে মুসলিম দেশগুলো দখল করে নিয়েছিল সেখানে ইসলামকে ব্যক্তিজীবনে সীমিত করে রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের তৈরি বিধানগুলো চাপিয়ে দিল। কিন্তু আল্লাহ যাকে দুটো সুস্থ পা দিয়েছেন সে কেন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করবে? তাই এ ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা বিগত তিনশ’ বছরে মুসলিমদের উপর যতই চাপানোর চেষ্টা করা হোক সেটা তাদের আত্মায় গৃহীত হলো না। তাদের মধ্যে সামগ্রিক জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার একটি ইচ্ছা জাগ্রত থাকল। কিন্তু তাদের সামনে যে ইসলামটি দেখছে সেটা আর প্রকৃত ইসলাম নেই, সেটা বহু আগেই বিপরীতমুখী হয়ে গেছে, সেটা প্রতিষ্ঠা করলেও আর শান্তি আসবে না। সেই বিকৃত ইসলাম ধর্মব্যবসায়ী, আলেম-মোফাসসেরদের হাতে পড়ে এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, সেটা বোঝার সাধ্য আর সাধারণ মানুষের নেই। তাই ধর্মীয় বিষয়ে তারা ধর্মব্যবসায়ীদের উপর পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। এ সুযোগে ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের ঈমানকে ভুল পথে চালিত করে নানারূপ স্বার্থ হাসিল করতে আরম্ভ করল। পরিণামে ধর্ম হয়ে গেল অশান্তি আর অনৈক্য সৃষ্টির উপাদান।
আমাদেরকে আজ বুঝতে হবে, যে ঈমান মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না, সে ঈমান তাকে জান্নাতেও নিতে পারবে না। আল্লাহ আমাদেরকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন এই বলে যে, “হে আমাদের প্রভু! আমাদের দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর, মঙ্গলময় করো এবং আমাদের আখেরাতের জীবনকেও সুন্দর, মঙ্গলময় করো এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো (সুরা বাকারা ২০১)।” বর্তমানে এ জাতির ঈমান, আমল সবই আছে পরকালের সুন্দর জীবনের আশায় কিন্তু তাদের দুনিয়ার জীবন দুর্দশায় পূর্ণ অর্থাৎ অসুন্দর। কারণ তাদের ধর্মবিশ্বাসকে ধর্মব্যবসায়ীরা ছিনতাই করে নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে আর মানবজাতির অকল্যাণে ব্যবহার করছে। আমরা হেযবুত তওহীদ মানুষের ঈমানকে সঠিক পথে পরিচালিত করে (To right track) জাতির উন্নতি-প্রগতি-সমৃদ্ধির কাজে লাগাতে চাই। এজন্য প্রথমেই ধর্মের কয়েকটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত ভুল ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ধর্ম কী? ধার্মিক কারা?
বস্তুত ধর্ম হচ্ছে কোনো বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণ। আগুনের ধর্ম পোড়ানো, যখন সে পোড়ানোর ক্ষমতা হারাবে তখন সে ধর্মহীন হয়ে যাবে। মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবতা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখ-কষ্ট হৃদয়ে অনুভব করে এবং সেটা দূর করার জন্য সকল বৈধ উপায়ে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে সে-ই ধার্মিক। অথচ আমাদের ধারণা হচ্ছে যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট লেবাস ধারণ করে সুরা কালাম, শাস্ত্র মুখস্থ বলতে পারে, নামায-রোযা, পূজা, প্রার্থনা করে সে-ই ধার্মিক।
এবাদত কী?
আল্লাহর এবাদত করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে (সুরা যারিয়াত ৫৬)। এবাদত হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। গাড়ি তৈরি হয়েছে পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য, এটা করাই গাড়ির এবাদত। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। ধরুন আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিৎকার ভেসে এল। আপনি কী করবেন? দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন। যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি ভাবেন- বিপন্ন ব্যক্তি অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামায-রোযা, পূজা সবই পণ্ডশ্রম।
প্রমাণ: আল্লাহ মুসা (আ.) কে বলছেন, ‘আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোনো এলাহ (হুকুমদাতা) নেই, অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাহ কায়েম কর (সুরা ত্বা-হা: ১৪)। এমন অনেক আয়াতেই আল্লাহ এবাদত ও সালাহ-যাকাতকে আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন। অথচ আমরা নামায-রোযাকেই এবাদত মনে করি। প্রকৃতপক্ষে এবাদত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত কাজ। মুসার (আ.) কাজ অর্থাৎ এবাদত কী ছিল তা কিছু পরেই আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ফেরাউনের নিকট যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে (সুরা ত্বা-হা: ২৪)। আল্লাহ তাঁকে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ইহুদি জাতিকে দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
আমাদের সমাজে যারা ধর্মের ধারক বাহক সেজে আছেন তারা (দু’-এক জন ব্যতিক্রম ছাড়া) সমাজের অশান্তির আগুন নেভাতে কী ভূমিকা পালন করছেন? তারা সমাজকে অপশক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে উপাসনালয়ে ঢুকেছেন, এমন কি সাধারণ মানুষকে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাচ্ছেন। যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো মানুষ পালন করলে ধর্মব্যবসায়ীদের রোজগার ও ভোজনবিলাসের সম্ভাবনা থাকে সেগুলোকেই তারা অধিক উৎসাহিত করছেন। তারা মসজিদে-এতিমখানায় দান করার জন্য দানবাক্স-মাইক নিয়ে সারাদিন ওয়াজ করেন, কিন্তু ব্রিজ কালভার্ট, হাসপাতাল নির্মাণ অর্থাৎ কোনো প্রকার জাতীয় উন্নয়নের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেন না। এজন্য আমরা দেখি, পুণ্য লাভের আশায় মানুষ মসজিদ মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নির্মাণ-সামগ্রী ব্যবহার করে, এগুলো শত শত বছর টিকে থাকে, কিন্তু ব্রিজ, রাস্তাঘাট, জাতীয় স্থাপনাগুলো তৈরির সময় সব ভেজাল সামগ্রী ব্যবহার করা হয়, ফলে সেগুলো দু’ এক বছর না যেতেই ভেঙ্গে পড়ে। যে সমাজে মানুষ ডাস্টবিনে কুকুরের সঙ্গে ক্ষুধার অন্ন কাড়াকাড়ি করে, যেখানে তিন বছরের শিশু ধর্ষিত হয়, মসজিদ থেকে জুতা চুরি হয়, মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না, সেখানে এ পরিস্থিতি পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে শুধু উপাসনা করে আর মক্কা-মদীনায় গিয়ে মানুষ মনে করে তারা বুঝি এবাদত করছে। এবাদতের সঠিক অর্থ না বোঝার কারণে নির্যাতিতের হাহাকার, ক্ষুধার্তের ক্রন্দন এদের কানে প্রবেশ করে না। এগুলোকে দুনিয়াবি কাজ বলে এড়িয়ে যাবার মত পাশবিক মনোবৃত্তি তাদের তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি নামায-রোযা করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আকিদা বুঝে। মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক প্রবণতা, আত্মিক শক্তি সবার থাকে না। এটা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ হচ্ছে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি। যে মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করবে না, অন্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচাতে সম্পদ ব্যয় করবে না, তার তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা, রোযা হবে না খেয়ে থাকা। আল্লাহ রসুল ও তাঁর সাহাবীরা আজীবন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, এটা করতে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সকল ধর্মের অবতার ও মহামানবদের জীবনেও রয়েছে শান্তিময় সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অথচ আজকের সমাজে ধর্মের ঠিকাদারদের জৌলুস দিন দিন বৃদ্ধি পায়, আর চারিত্রিক দিক থেকে যিনি যত বড় ধার্মিক তিনি তত বড় নির্বিরোধী অথবা কাপুরুষ, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চরিত্র তার থাকে না। ইতিহাস বলে, আরবের হানাহানি, রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা লিপ্ত, অশিক্ষা, কুসংস্কারে নিমজ্জিত একটি জাতিকে রসুলাল্লাহ এমন একটি সভ্য জাতিতে পরিণত করেছিলেন যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। একজন যুবতী সারা দেহে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ অতিক্রম করত, তার মনে কোনো ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা জাগ্রত হতো না। মাসের পর মাস আদালতে অপরাধ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আসতো না। সারাদিন খুঁজেও দান গ্রহণ করার মতো কাউকে পাওয়া যেত না। এমন সমাজই হচ্ছে ইসলামের সমাজ। আর আজকে আমরা ইসলাম বলতেই বুঝি গায়ে আরবি লেবাস, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি মেয়েদের গায়ে বোরকা, এগুলি করলেই পাক্কা পরহেজগার। কিন্তু না, যে কাজ করলে মানুষ শান্তি পায়, সেটাই ইসলামের কাজ।
মানুষ ঈমান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রের অনেক উন্নতি করতে পারে। বিরাট বিরাট কাজ যেটা রাষ্ট্রের পক্ষে দুরূহ, সেটা ঈমান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সহজসাধ্য হয়ে উঠতে পারে, প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ আকিদা। ধর্মের প্রকৃত অর্থ যিনি বুঝবেন তিনি মানুষের ব্যবহৃত ব্রিজ-কালভার্ট, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ধ্বংস না করে এগুলো নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করবেন, তিনি বৃক্ষ কর্তন না করে বৃক্ষরোপণকে এবাদত মনে করবেন। রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়। সেই কর আদায়ে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। কিন্তু মানুষকে যদি বোঝানো যায় যে রাষ্ট্রের উন্নয়নে দান করলে সেটা তার আখেরাতের পাথেয় হবে, তাহলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় অর্থ ও শ্রম মানুষ স্বেচ্ছায় প্রদান করবে।
ধর্মকে বাদ দেওয়া যৌক্তিক নয়, সম্ভবও নয়। কেননা মানবসমাজে যেটুকু নীতি-নৈতিকতা আজও অবশিষ্ট আছে সেটা ধর্মের জোরেই আছে। ইতোমধ্যেই ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দেওয়ায় সমাজে সর্বপ্রকার অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যারা মুসলমান নামক জাতির রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধার, তাদের অধিকাংশই আল্লাহ-রসুলের প্রতি ঈমান রাখেন, নামায পড়েন, রোযা রাখেন, হজ্ব করেন- কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্রের ঐক্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি, প্রগতির কাজে লাগাতে পারছেন না। এর মূল কারণ ঐ আকিদা, যে আকিদা বিকৃত হওয়ায় ধর্মের চেহারাই বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে ধর্ম রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে উদ্বোধনী তেলাওয়াত, ইফতার মাহফিল, চেহলাম, কবর জেয়ারতের মধ্যেই আটকে আছে, কোনো উন্নয়নমূলক কাজে আসছে না।
এ গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির উপায় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন যা কাজে লাগিয়ে আমরা ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই যে বিপরীতমুখী পথচলা, এটাকে একমুখী করতে পারি যাতে করে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ধর্মবিশ্বাস হাত ধরাধরি করে পথ চলে জাতিকে উন্নতি অগ্রগতির শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি এ বিষয়টি সর্বস্তরের মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য। এ কাজে আমাদের কোনো আর্থিক বা রাজনীতিক স্বার্থ নেই। এই বাংলাদেশের মাটিতে আমাদের জন্ম, এখানকার আলো-বাতাসে আমরা বড় হয়েছি, এ দেশের কল্যাণে কাজ করা আমাদের সামাজিক, মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব। ঈমানী দায়িত্ব বলছি এ কারণে যে, মানুষের জন্য নিরাপদ ও প্রগতিশীল একটি সমাজ নির্মাণের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টাকে আমরা এবাদত বলে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি, রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়া যেমন সওয়াবের কাজ, তেমনি মানুষ যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে তার জন্য পাহারা দেয়াও সওয়াবের কাজ। আল্লাহ মু’মিনের সংজ্ঞার মধ্যেই শান্তি প্রতিষ্ঠার এ প্রচেষ্টাকে, এই জেহাদকে স্থান দিয়েছেন (সুরা হুজরাত ১৫)। স্রষ্টার সকল হুকুমই ন্যায়, সত্য ও কল্যাণময়। এগুলোকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা জীবনকে উৎসর্গ করল তারাই তো মু’মিন। পক্ষান্তরে যারা শুধু নিজের স্বার্থে জীবন অতিবাহিত করে, সামষ্টিক শান্তির চিন্তা না করে কেবল নিজের সুখ-সমৃদ্ধির কথা ভাবে তারা তো পশুর জীবনযাপন করছে। পশুও খায়, সন্তান জন্ম দেয়, মারা যায়। এদের আগমনে মানুষ কোনো উপকার পায় নি, তাই তাদের মানবজনম ব্যর্থ।
আসুন, আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে পরিচালিত করি। যে কাজ করলে মানুষ শান্তি পাবে, উপকৃত হবে, তাদের অভাব-অনটন, অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর হবে, অনৈক্য-হানাহানি দূর হবে সেই কাজ করি। তাহলেই আমরা বিশ্বের বুকে একটি সম্মানিত ও পরাশক্তিধর জাতি হিসাবে দাঁড়াতে পারব। ষোল কোটি মানুষ ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের উত্থানকে কেউ রুখে দিতে পারবে না এনশা’আল্লাহ।