মোহাম্মদ ইয়ামিন খান:
গত ১৩০০ বছরের কাল পরিক্রমায় রসুলাল্লাহর আনীত সত্যদীন বিকৃত হোতে হোতে এখন যেটা ইসলাম হিসাবে দুনিয়াময় পালিত হোচ্ছে সেটার সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের বাহ্যিক কিছু সাদৃশ্য ব্যতীত আর কোনই মিল নেই। ভেতরে আত্মায়, চরিত্রে সেটা প্রকৃত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রাণহীন মৃত বিকৃত এই ইসলামের অনুসারী মোসলেম নামধারী জনসংখ্যাটি আল্লাহর সর্বব্যাপী সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদ থেকে বিচ্যুত হোয়ে জাতীয় জীবনে আল্লাহর দেয়া বিধান প্রত্যাখ্যান কোরে পাশ্চাত্যের ইহুদি-খ্রিস্টান সভ্যতা দাজ্জালের তৈরি জীবনব্যবস্থা গ্রহণ কোরে কার্যত কাফের-মোশরেকে পরিণত হোয়েছে। প্রকৃত ইসলামের বিপরীতমুখী এই ইসলামটিও আজ ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-পুরোহিত শ্রেণির কুক্ষিগত হোয়ে আছে। তারা আল্লাহর পাঠানো সত্যদীনকে নিজেদের ইচ্ছার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে, ধর্মের প্রকৃত রূপ অর্থাৎ মানবতাকে বিসর্জন দিয়ে এটাকে একটা ব্যবসা-বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত কোরেছে। তাদের এই হীন কর্মকাণ্ড যাতে কেউ জানতে না পারে তার জন্য কোর’আনের যে সমস্ত আয়াতগুলোতে ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করা আছে সেগুলোকে তারা গোপন করে, আর তাদের সুবিধামত কিছু আয়াতকে অর্থের বিনিময়ে আউড়াতে থাকে। এ সমস্ত ধর্মব্যবসায়ী আলেম শ্রেণির সম্পর্কে মহান আল্লাহ বোলেছেন, “আল্লাহ যে কেতাব নাযেল কোরেছেন যারা তা গোপন রাখে ও বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে তারা নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছইু পুরে না। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বোলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও কোরবেন না। তাদের জন্য রোয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারাই সৎ পথের পরিবর্তে ভ্রান্তপথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় কোরেছে; আগুন সহ্য কোরতে তারা কতই না ধৈর্যশীল,” (সুরা বাকারা ১৭৪-১৭৫) অর্থাৎ আল্লাহ ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্ম বিক্রি কোরে টাকা উপার্জন করাকে কেবল হারামই করেন নি তাকে আগুন খাওয়া বোলেছেন। রসুলাল্লাহ আখেরী যামানার এই আলেম নামধারী ধর্মব্যবসায়ীদের সম্পর্কেই বোলেছেন, আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব” [আলী (রা:) থেকে বায়হাকী]।
প্রথমে আমাদের জানা দরকার- মোসলেম নামের বৃহত্তর জনসাধারণ থেকে আলাদা একটি ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি যারা অর্থের বিনিময়ে আমাদের মসজিদগুলিতে নামাজ পড়ান, মিলাদ পড়ান, আমাদের মৃত্যুর পর জানাজা পড়ান, আমাদের পূর্বপুরুষের কবর জেয়ারত করেন, গরু কোরবানি কোরে দেন, বিয়ে পড়িয়ে দেন ইত্যাদি ধর্মীয় কাজগুলি কোরে দেন এই শ্রেণিটির জন্ম হোল কিভাবে। এটা ইতিহাস যে, আল্লাহর রসুলের সময়ে মোসলেম সমাজে ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ বৃহত্তর জনসাধারণ এবং অর্থের বিনিময়ে তাদের ধর্মীয় কাজগুলো কোরে দেয়ার জন্য পুরোহিত শ্রেণির মতো কোন শ্রেণি বিভাজন কখনই ছিলো না। মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম পুরুষ মোহাম্মদকে (দ:) আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন এই কারণে যে, রসুল যেন অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থার উপর তাঁর আনীত দীনকে প্রতিষ্ঠা করেন (সুরা সফ ৯, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা তওবা ৩৩]। রসুলাল্লাহ তাঁর উপর অর্পিত এ বিশাল দায়িত্বকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি কোরতে পেরেছিলেন বোলেই তিনি বোলেছেন, “আমি আদিষ্ট হোয়েছি পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা, এলাহ নেই এবং আমি মোহাম্মদ (দ:) আল্লাহর রসুল, সালাহ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয় [আব্দাল্লাহ এবনে ওমর (রা:) থেকে বোখারী]। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, এত বড় কাজ একা করা সম্ভব নয়। তাই শুরু থেকে তিনি মানুষের মধ্যে হেদায়াতের, তওহীদের আহ্বান প্রচার করতে আরম্ভ কোরলেন। একটি সর্বত্যাগী, আল্লাহর দীনের জন্য পাগলপারা, জীবন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত জাতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর রসুল (দ:) ১৩ বছর মক্কায় কেবল তওহীদের ডাক দিয়ে গেলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ কোরলেন আম্মা খাদিজা (রা:), যায়েদ (রা:), আবুবকর (রা:) প্রমুখ সাহাবীগণ। রসুলাল্লাহ (দ:) ও তাঁর সাহাবীগণ তওহীদের ডাক দিতে গিয়ে ১৩ বছর মক্কায় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। তারপর আল্লাহ যখন তাঁকে মদিনার কর্তৃত্ব দান কোরলেন তখন তিনি সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কোরলেন। তখন এ জাতির মধ্যে এর আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে কোন মতভেদ ছিলো না। উম্মতে মোহাম্মদী ছিলো একটি জাতি এবং তাদের নেতা ছিলেন স্বয়ং রসুলাল্লাহ। আর সেই জাতির উদ্দেশ্য ছিলো সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠা কোরে পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, রক্তপাত অর্থাৎ অশান্তি নির্মূল করা। তাঁর জীবদ্দশায় ঐ জাতিকে সঙ্গে নিয়ে জেহাদ চালিয়ে গেলেন এবং সমস্ত আরব উপদ্বীপে আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থার অধীনে নিয়ে এসে বাকি পৃথিবীকেও আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য স্বীয় উম্মাহকে দায়িত্ব অর্পণ কোরে তাঁর প্রভুর কাছে চোলে গেলেন এবং রেখে গেলেন পাঁচ দফার এক অমূল্য কর্মসূচি যেগুলো হোল:
১) ঐক্যবদ্ধ হওয়া
২) নেতার আদেশ শোনা
৩) নেতার ঐ আদেশ পালন করা
৪) হেজরত করা
৫) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা।
উম্মতে মোহাম্মদী এই কর্মসূচি ও তাদের উপরে তাদের নেতার অর্পিত দায়িত্ব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি কোরেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ এই যে, উম্মাহ বিশ্বনবীর (দ:) ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পার্থিব সমস্ত কোরবান কোরে তাদের নেতার উপরে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ কোরতে তাদের দেশ হতে বের হোয়ে পড়েছিলেন। এক নেতার হুকুমে জীবন উৎসর্গকারী দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতিটির মধ্যে কোনো মতভেদ ছিলো না, আজকের মতো কোর’আনের লাখ লাখ কপি ছিলো না, হাদিসের কোন বই ছিলো না, ফেকাহ, তফসীর, মাসলা-মাসায়েলের কোন কূটতর্ক ছিলো না। তখনও এ জাতির মধ্যে কোন পুরোহিত শ্রেণির জন্ম হয় নি, সবাই ছিলো যোদ্ধা, যিনি ছিলেন যতো বড় মো’মেন তিনি ততো বড় যোদ্ধা, ছোটখাটো বিষয়গুলি নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখা বিশ্লেষণকারী আলাদা কোন শ্রেণির কোন নাম-গন্ধও ঐ জাতির মাঝে ছিলো না।
(চোলবে ইনশা’ল্লাহ…)