মসীহ উর রহমান
ইসলাম নারীদেরকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে সেটা বর্তমান এই ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জালের তৈরি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি জীবনব্যবস্থাগুলোতে দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তেমন স্বাধীনতা এখনও কেউ দিতে পারে নি। আমরা হেযবুত তওহীদ গত ২০ বছর ধরে যে কথাটা বারবার বলে আসছি এবং এনশা’আল্লাহ বলে যাব, সেটা হচ্ছে বর্তমানে সারা দুনিয়ায় যে ইসলামটা চালু আছে, যার বহুরকম রূপ আছে, এর কোনোটাই আল্লাহর দেওয়া ইসলাম নয়। আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম ১৩০০ বছর ধরে বিকৃত হতে হতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। সর্বশেষ বিকৃতি সাধন করে ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। কয়েক শতাব্দী আগে সারা বিশ্বের যে মুসলিম প্রধান দেশগুলো ইউরোপীয় খ্রিস্টান জাতিগুলোর উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল, সে এলাকাগুলোতে খ্রিস্টানরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে তাদের নিজেদের তৈরি করা একটি বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দেয়। এই বিকৃত ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল, এই জাতি যেন দীনের ছোটখাটো বিষয়, ব্যক্তিগত মাসলা-মাসায়েল নিয়ে মতভেদে লিপ্ত থাকে এবং সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে মাথা না ঘামায়। অর্থাৎ ইসলামকে ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের চেয়ে, আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামের চাইতে এখানে দাড়ি-টুপির গুরুত্ব বেশি দেওয়া হলো। সেই ইসলামটিই আজ সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন রূপে চর্চিত হচ্ছে। ফলে আজ সারা দুনিয়াতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, হুকুমদাতার স্বীকৃতি না থাকলেও দাড়ি ঠিকই আছে, কুলুখ ঠিকই আছে।
ইসলামের অন্যান্য সকল দিক যেমন হারিয়ে গেছে তেমনি নারীর সম্পর্কে ইসলামের সঠিক আকিদাও হারিয়ে গেছে। আজকে ইসলামের প্রতিটা দিক বিপরীত। সত্য ইসলামের নারী কেমন ছিল সেটা আজকের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। পরহেজগার নারী বলতেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত একজন নারী, যার সাত চড়েও কোনো রা নেই। সে এতই অবলা, সরলা যে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিলে বাড়ি ফিরে আসতে পারে না, ঐখানে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে, স্বামীর সহায়তা ছাড়া সে এক কদমও চলতে পারে না, বাস থেকে নামতে পারে না, নিজের পোশাকের সঙ্গে আটকে যখন তখন হোঁচট খায়। এই নারীমূর্তি দেখেই মানুষ ভাবছে ইসলাম নারীকে বুঝি এভাবেই অথর্ব, জড়বুদ্ধি, অচল, বিড়ম্বিত করেই রাখতে চায়। এজন্য কথায় কথায় মানুষ ইসলামকে গালি দেয়, ইসলামকে গালি দেওয়ার অর্থই আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে গালি দেওয়া।
তাদের উদ্দেশ্যে আমরা যে কথাটি বলে আসছি বিগত ২০ বছর ধরে, সেটা হলো: আপনারা যে ইসলামকে গালি দিচ্ছেন, মন্দ বলছেন সেটা আল্লাহ রসুলের ইসলাম নয়। আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম আছে হেযবুত তওহীদের কাছে। আজ যেমন সময় এসেছে ইসলামের বিকৃতিগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার, তেমনি সময় এসেছে প্রকৃত ইসলামের অনিন্দ্য সুন্দর রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরার।
আজকের অনেক আলেম-ওলামা-মুফতিরা তাদের ওয়াজ নসিহতে শ্রোতাতের আনন্দ দেওয়ার জন্য নারীদের সম্পর্কে বহু অশ্লীল, অরুচিকর উক্তি করে থাকেন। তাদের কথা শুনে কেউ যেন এটা মনে না করেন যে, এগুলো আল্লাহ-রসুলের কথা। এই আলেমদের সঙ্গে আল্লাহ ও রসুলের কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ তারা যে ইসলামটিকে বিক্রি করে খান, সেটা আল্লাহর-রসুলের ইসলামই নয়, সেটা ব্রিটিশ খ্রিস্টান এবং ১৩ শ’ বছরের হাজার হাজার তথাকথিত ধর্মজীবী আলেম-ওলামাদের করা সম্মিলিত বিকৃতির ফসল। এই বিকৃত ইসলামকে আল্লাহ-রসুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা তাঁদের অপমান। এই সব ভাড়াটে আলেমরা কেবল নারীদের ব্যাপারে নয়, ইসলামের প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই বিকৃত মন্তব্য করে থাকে, বহু অকাট্য সত্য গোপন করে থাকে। এটা সবাই জানেন যে সুদ খাওয়া হারাম। এটা যেমন সত্য, তার থেকেও বড় সত্য হলো ধর্ম ব্যবসা হারাম (সুরা বাকারা ১৭৪ সহ আরও বহু আয়াত)। কিন্তু এটা তারা বলে না ব্যবসায় ধ্বস নামবে বলে। এরকম আরও অনেক আছে।
যাহোক আমাদের কথা হলো নারীদের স্বাধীনতা নিয়ে। যে স্বাধীনতা ইসলাম দিয়েছে সে স্বাধীনতা অন্য কেউ দিতে পারে নাই। প্রকৃত ইসলাম কেমন ছিল তা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিখিত আছে। প্রকৃত ইসলামে নারীদের যে ভূমিকা ছিল তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?
১. নারীরা মহানবীর সামনা সামনি বসে আলোচনা শুনতেন, এ সময় মহানবী ও মেয়েদের মাঝে কোনো কাপড় টাঙ্গানো ছিল এই ব্যাপারে কেউ কোনো দলিল দেখাতে পারবে না। একবার নারী সাহাবীরা রসুলাল্লাহকে অনুরোধ করেছিলেন শুধু তাদেরকে নিয়ে আলোচনা সভা করার। কারণ পুরুষ সাহাবীদের উপস্থিতিতে মেয়েরা অনেক বিষয়ে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করতেন। রসুলাল্লাহর সময় পুরুষ ও নারী একই সঙ্গে সালাহ কায়েম কোরত, নারীদের জন্য বিশেষ কক্ষের বন্দোবস্ত ছিল এমন কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য, মেয়েরা তখন মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে, জুমা’র সালাতে, দুই ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ কোরত। তখনকার জুম্মা এখনকার মত মৃত জুম্মা না। ঐ জুম্মা ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে মহানবী (সা.) বাধ্য করেছেন মেয়েরা যেন জুম্মায় আসে। এমনকি যে সমস্ত মেয়ে বলেছে যে তাদের রজঃকালীন অপবিত্রতা আছে তাদের বলছেন যে, ‘তোমাদের সালাহ কায়েমের দরকার নেই, তবে খোতবা শুনতে হবে।’ কারণ জুম্মা হচ্ছে এই উম্মাহর জাতীয় সম্মেলন।
২. নারীরা মহানবীর (সা.) সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন, শত্র“দের হামলা করেছেন, আহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন, নিহতদের দাফনে সহায়তা করেছেন, যুদ্ধ চলাকালীন সৈন্যদের খাবার, পানীয় ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ করেছেন। যে যোদ্ধাদেরকে তারা চিকিৎসা ও সেবা দিয়েছেন তারা কিন্তু অধিকাংশই ছিলেন আলেমদের ভাষায় “বেগানা পুরুষ”। মসজিদে নববীর এক পাশে তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা। এই বিশেষ চিকিৎসা ইউনিটে অধ্যক্ষ ছিলেন একজন নারী, রুফায়দাহ (রা.)। ওহুদের যুদ্ধে রসুলাল্লাহ যখন সাংঘাতিক আহত হন, তখন কাফেরদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে রসুলাল্লাহকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য তলোয়ার হাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন উম্মে আম্মারা (রা.)। পরবর্তীতে রসুলাল্লাহ বলেছিলেন, ওহুদের দিন যেদিকে তাকাই কেবল উম্মে আম্মারাকেই (রা.) দেখতে পেয়েছি।” পক্ষান্তরে, ব্রিটিশ, আজকে যাদের জীবনব্যবস্থা দিয়ে দুনিয়া চলে তারা নারীদেরকে ভোটের অধিকার দিয়েছে ১৯২৮ সনে, এখনও একশ বছরও হয় নি। তারা সেনাবাহিনীতে মেয়েদের অন্তর্ভুক্ত করেছে তারও একশ বছর হয় নি। যুদ্ধাহতদের সেবা দেওয়ার জন্য ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে নার্সিং জগতে প্রায় দেবীর আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়, তাকে আধুনিক নার্সিং-এর পুরোধা বলা হয়, কিন্তু ১৪০০ বছর আগের রুফায়দাহর (রা.) কথা এই এ জাতিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৪. ১৪০০ বছর আগে নারীরা প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কির মধ্যেও পুরুষদের সঙ্গেই হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কোরত, যেটা এখনও চালু আছে।
৬. তারা কৃষিকাজে, শিল্পকাজে অংশগ্রহণ করেছেন, রসুলাল্লাহর প্রথম স্ত্রী আম্মা খাদিজা (রা.) সে সময়ের একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। ওমর (রা.) এর আমলের সময় বাজারসহ সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন একজন নারী শেফা (রা.)।
মূল কথা হচ্ছে, যেখানে সবচাইতে বিপদ সংকুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অংশগ্রহণ করে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে সেখানে চাকুরী, শিক্ষা, ব্যবসায়, বৈষয়িক অন্যান্য কাজে কর্মে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তো সাধারণ ব্যাপার। মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছে। সালাহ হচ্ছে জেহাদের চরিত্র সৃষ্টির প্রশিক্ষণ অর্থাৎ ট্রেনিং। জেহাদেও মেয়েদের আলাদা করা হয় নি, জেহাদের প্রশিক্ষণ সালাতেও তাদের আলাদা করা হয়নি। কিন্তু এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা মেয়েদের সালাহকে বিকৃত করে ছেলেদের থেকে আলাদা নিয়ম বের করেছে। মেয়েদেরকে সবচেয়ে একেবারে নির্বাসিত করেছে বিকৃত পর্দা বা হেজাবের ফতোয়া দিয়ে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহর পরিষ্কার কথা হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক প্রকাশমান অঙ্গসমূহ খোলা থাকবে, বক্ষ ও গ্রীবা বড় এক খণ্ড কাপড় দিয়ে আবৃত থাকবে এবং তাদেরকে যেন চিনতে পারা যায় (সুরা নুর ৩১, সুরা আহযাব ৫৯)। এই বিধানের বিষয়ে অগণিত হাদিস আছে। সেখানে কিম্ভুতকিমাকার ও ভৌতিক বোরকা পরিয়ে মেয়েদেরকে চলমান তাবুসদৃশ করা হয়েছে, এটা ইসলাম না। সুতরাং এই মোল্লাদের অপপ্রচার, অপব্যাখ্যা ইসলামের ব্যাখ্যা নয়। নারীদের সম্পর্কে প্রকৃত ইসলাম তারা জানে না। ১৩০০ বছরে এটা বিকৃত হয়ে গেছে। সত্যিকারের ইসলাম কোনোটা? হেযবুত তওহীদ উল্লেখ করছে। আসুন সে ইসলামে। আসুন আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমে।