দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দু’টো সমাধান আছে-
প্রথম সমাধান হলো- যে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, সেই পণ্যের যোগান বাড়ানোর চেষ্টা করা। অর্থাৎ পণ্যটা যাতে বাজারে পর্যাপ্ত থাকে তা নিশ্চিত করা। এই যোগান বাড়ানো যেতে পারে দুইভাবে- উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অথবা আমদানির মাধ্যমে। বাজারে পণ্যটার যোগান ঠিক রাখা গেলে, দোকানে সরবরাহ ঠিক থাকলে, আর অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মজুদ করতে না পারলে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই সহজ। কিন্তু যদি পণ্যটা আমদানি বা উৎপাদন করা সম্ভব না হয়?
ধরুন বাংলাদেশে যে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, সেই পণ্যটা পাওয়া যায় ইউক্রেনে। এতদিন ইউক্রেন থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্যটা আমদানি করত। এখন যুদ্ধের কারণে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। কিংবা ধরুন, পণ্যটা এতদিন আমদানি করা হতো রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ায় এখন আর দেশটি থেকে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। আবার বাংলাদেশে সেই পণ্যটা ব্যাপকভাবে উৎপাদন করাও যাচ্ছে না, কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়া জলবায়ু এই পণ্য উৎপাদনের সহায়ক নয়, দক্ষ জনশক্তিও নাই। তখন কী করণীয়?
তখন রয়েছে দ্বিতীয় উপায়। সেটা হলো- পণ্যটার চাহিদাও কমিয়ে ফেলা। মনে রাখতে হবে জনগণ যে জিনিস কিনবে না, সেটার দাম এমনিতেই কমে যাবে। ধরা যাক সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাবার পর জনগণ সয়াবিন তেল খাওয়া বাদ দিয়ে সরিষা তেল খাওয়া শুরু করল, কিংবা সয়াবিন তেল যারা খাচ্ছে খুবই অল্প পরিমাণে খাচ্ছে। এতে কিছুদিনের মধ্যেই সয়াবিন তেলের যোগান বেড়ে যাবে এবং তার ফলে দাম কমতে শুরু করবে। তবে সাধারণত এভাবে চাহিদা কমানোর মাধ্যমে দাম কমানোর নজির খুবই কম। কেননা জনগণ কখনই ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো পণ্যের ব্যবহার বন্ধ করতে পারে না। জনগণ ঐক্যবদ্ধ নয়।
আরেকটা কথা জেনে রাখা আবশ্যক- যে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে সেটার চাহিদা এমনিতেও কিছুটা কমে যায়, তবে সেটা আশানুরূপ নয়। অর্থাৎ যতটা চাহিদা কমলে দাম কমে যাবে ততটা চাহিদা কমে না। বিশেষ করে পণ্যটা যদি নিত্য প্রয়োজনীয় কোনোকিছু হয়, তাহলে চাহিদা কমে না বরং চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তখন সবার মধ্যেই পণ্যটা মজুদ করে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়। কিছুদিন পূর্বে লবনের দাম নিয়ে গুজব রটার পর দেখা গিয়েছিল অবিশ্বাস্য রেটে সাধারণ মানুষ লবন কিনে বাড়িতে জমা করে রাখছে। অর্থাৎ দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চাহিদাও যেন বেড়ে গিয়েছিল!
এদিকে জাতির ধনীক শ্রেণির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই- নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো ভোগ্যবস্তুর দাম বেড়ে গেলেও জনগণের এই অংশকে কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয় না, বা চাহিদা কমানোর কথা ভাবতে হয় না। দাম বাড়ার পরও ধনীরা সেই পণ্যটা যত ইচ্ছা কিনতে থাকে ও ভোগ করতে থাকে। যেহেতু বাজারে বেশি দামে অনেকে কিনছেই, তাই সেই পণ্যটার দাম কমার সম্ভাবনাও আর থাকে না। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ঠিক থাকে, উচ্চবিত্তদের জীবন-জীবিকাও ঠিক থাকে, উৎপাদকরাও সীমিত উৎপাদন দিয়েই প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে থাকে, শুধু মানবিক বিপর্যয়ে পড়ে যায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী!
এই কারণেই মূলত ভোগবাদী সমাজে চাহিদা কমানোর মাধ্যমে পণ্যের দাম কমানোর কথা চিন্তাও করা যায় না। একটা ভোগবাদী সমাজে মানুষ বেঁচেই থাকে ভোগ করার জন্য। যার বেশি সামর্থ্য সে বেশি ভোগ করে, অল্প সামর্থ্য থাকলে অল্প ভোগ করে। কিন্তু সামর্থ্য থাকার পরও বৃহত্তর স্বার্থে ভোগ না করার মানসিকতা এই সমাজে কখনই গড়ে ওঠে না। দেশের আর্থসামাজিক হালচাল যা-ই হোক, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আগের চেয়ে একটু কম খাওয়া, একটু কম মানের পোশাক পরা, একটু কম খরচের চেষ্টা করার কথা ভাবতেও পারে না ভোগবাদী সমাজের মানুষ। তাই এই দিকটা নিয়ে বর্তমানের পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারক-বাহকরা তেমন একটা আশাবাদী হতে পারেন না। যারা সরকারের নীতিনির্ধারণ করেন, তারাও ভালোভাবেই জানেন একটা পণ্যের দাম ১০গুণ বেড়ে গেলেও জনগণের একাংশ সেই পণ্য কিনবেই। প্রধানমন্ত্রীও যদি পণ্যটি না খাওয়ার জন্য বা কম খাওয়ার জন্য জাতিকে আহ্বান করেন, জাতি সেই আহ্বান মানবে না। তাই নীতি-নির্ধারকরা পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সমাধান হিসেবে সবসময় যোগান বাড়ানো, আমদানি বাড়ানো, শুল্ক কমানো, ভ্যাট কমানো ইত্যাদি গতানুগতিক চিন্তাকেই বেছে নেন। এসবে কাজের কাজ কিছুই হয় না তা সবাই জানেন।
অথচ আমরা যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করি, আমাদের সমাজে দ্বিতীয় সূত্রটাই কিন্তু বেশি ফলপ্রসূ হবার কথা ছিল। আমাদের সমাজের ধনীক শ্রেণির কথাই বলি কিংবা গরীব শ্রেণির কথাই বলি- তাদের কিন্তু ভোগবাদী ও বস্তুবাদী হবার কথা ছিল না। বরং কথা ছিল তারা নিজেরা না খেয়ে অন্যকে খাওয়াবে। তাদের ঘরে যদিও ফ্রিজভর্তি খাবার থাকে, লকারভর্তি টাকা থাকে, তথাপি তারা নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, সংযমে রাখবে। এই সংযম যদি কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে থাকে তাহলে সেখানে খুব সহজেই অর্থনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করা সম্ভব, আবার এই সংযম না থাকলে শত আন্তরিক প্রচেষ্টাতেও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়।
রমজান মাসে মুসলিমদের ফরজ আমল হলো সওম। সওম মানেই আত্মসংযম। আল্লাহ বারোটা মাসের মধ্যে একটামাস নির্ধারণ করেছেন যেই মাসে মুসলিম জনসাধারণ নিজেদের জীবনে সংযমের শিক্ষা অর্জন করবে। নিজেদের নফসকে নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন করবে। তারপর যেই সংযম সে অর্জন করতে পারল, সেটার প্রতিফলন ঘটাবে বাকি এগারো মাসের জীবন-যাপনে। রমজান মাসে একজন মুসলিমের পেটে ক্ষুধা থাকে, টেবিলে খাবার থাকে, কিন্তু সে থাকে না খেয়ে। এই না খাওয়াটা নিজের জন্য নয়, আল্লাহর জন্য। ঠিক তেমনি রমজান মাস ছাড়াও একজন মুসলিম বহুকিছু খাবে না, বহু খরচ করবে না শুধুই আল্লাহর জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য। সওম যেমন ধনী-দরিদ্র সবার জন্য ফরজ, তেমনি সমাজের স্বার্থের জন্য নিজের চাহিদাকে কমিয়ে আনার দায়িত্বও ধনী-দরিদ্র সবাইকেই পালন করতে হবে।
আমাদের সওম যদি সত্যিকারের সওম হতো তাহলে একটা সওমই যথেষ্ট হতো বহু অর্থনৈতিক সঙ্কটের সমাধান এনে দেওয়ার জন্য। সমস্যা হলো- আমরা সওম পালন করি, কিন্তু সওমের উদ্দেশ্য বুঝি না এবং সওমের শিক্ষা চরিত্রে ধারণ করারও চেষ্টা করি না। আমরা সওমের নামে শুধু না খেয়ে থাকি। আর মনে করি- সওমে না খেয়ে কষ্ট পাওয়ার মধ্যেই আছে সওয়াব। সন্ধ্যা পর্যন্ত সওয়াব অর্জনের পর মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংযমের লাগাম ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে ভোগবাদী আসল চেহারাটা! একবেলা না খেয়ে থাকার পর আরেকবেলায় দুইগুণ বেশি খাবার খেয়ে কষ্টের মাশুল আদায় করি! ফল হয় এই যে, রমজান মাস এলে দ্রব্যমূল্য কমার বদলে বেড়ে যায় কয়েকগুণ। পরিহাস আর কাকে বলে!