মোহাম্মদ আসাদ আলী:
ইসলাম হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ দ্বীন। দেহ-আত্মা ও দুনিয়া-পরকালের সুন্দর ভারসাম্য বজায় রেখে আল্লাহ এই দ্বীন তৈরি করেছেন। আবার দ্বীনকে এমন সহজ-সরল করা হয়েছে যাতে চালাক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই নয় কেবল, কম বুদ্ধির লোকও খুব সহজেই এই দ্বীনকে বুঝতে ও ধারণ করতে পারে। তাই ইতিহাসে দেখি, ইসলাম নামক পরশপাথরের ছোঁয়ায় আল্লাহর রসুল যে উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটি গড়ে তুলেছিলেন তাদের অধিকাংশ ব্যক্তিই লেখাপড়া না জানলেও সত্যদ্বীন বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধাই হয় নি। সহজ-সরল ইসলামের আলোয় আলোকিত এই নিরক্ষর ব্যক্তিদের প্রসঙ্গেই আমরা আল্লাহর রসুলকে বলতে শুনি, ‘আমার আসহাবরা উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায়, তাদের যে কাউকে অনুসরণ করলে সঠিক পথ পাবে।’
ইসলাম যদি সহজ-সরল দ্বীন না হত, তাহলে ঐ লেখাপড়া না জানা নিরক্ষর ব্যক্তিদের পক্ষে সম্ভব হত না আল্লাহর দ্বীন বুঝে আল্লাহর রসুলের সংগ্রামী জীবনের সঙ্গী হওয়া। সেই জাতির জীবন ছিল দেহ-আত্মা, ইহকাল-পরকালের ভারসাম্যপূর্ণ, কোর’আনের ভাষায় যারা কিনা ‘উম্মাতা ওয়াসাতা’। কিন্তু দুঃখজনক ইতিহাস হচ্ছে, আল্লাহর রসুলের ইন্তেকালের ৬০/৭০ বছর পরে জাতি তাদের লক্ষ্য হারিয়ে ফেললে ক্রমে ক্রমে এই ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করল। কেউ আধ্যাত্মিক সাধনা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করাকেই নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করল, কেউ আবার অস্বাভাবিক ভোগ-বিলাসিতায় লিপ্ত হলো। আবার একটি শ্রেণি দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সহজ-সরল ইসলামকে জটিল করে তুলতে লাগল। এমনটা যে হবে সে কারণেই হয়ত আল্লাহ ও তাঁর রসুল জাতিকে বারবার সতর্ক করেছিলেন যেন দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা হয়, যতটুকু বলা হয়েছে ততটুকুই করা হয় এবং দ্বীনের সরলতাকে আড়াল করে জটিলতার সৃষ্টি না করা হয়। তেমনি কিছু সতর্কবাণী, যেগুলো আমরা বহু পূর্বেই ভুলে বসে আছি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
১. আল্লাহ বলেন, “বলুন, হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না; এবং যে-সম্প্রদায় অতীতে বিপথগামী হয়েছে এবং অনেককে বিপথগামী করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ করো না”। (৫:৭৭)
২. একদল সাহাবী নিজেদেরকে খোজা করে দরবেশ হয়ে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ব্যক্ত করলে আল্লাহ আয়াত নাজেল করে সাবধান করে দেন। তিনি বলেন, “হে ঈমানদাররা! আল্লাহ যেসব উৎকৃষ্ট বস্তু তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন তাকে তোমরা হারাম করো না এবং সীমালংঘন করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে আহার করো আর আল্লাহকে ভয় করে চলো যাঁর প্রতি তোমরা ঈমান এনেছ।” (৫:৮৭-৮৮)
৩. আল্লাহর রসুল বলেন, “দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি স¤পর্কে সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী (জাতিগোষ্ঠি) এরূপ বাড়াবাড়ির পরিণামে নিশ্চিহ্ন হয়েছে।” (আহমাদ, নাসাই ও ইবনে মাজাহ)
৪. রসুলাল্লাহ বলেন, “তারা অভিশপ্ত, যারা চুল ফাঁড়তে (দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণে) লিপ্ত।” (মুসলিম, আহমাদ ও আবু দাউদ) রসুলাল্লাহ তিনবার এই কথা উচ্চারণ করলেন।
৫. হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ্জের সময় মুজদালিফায় পৌঁছে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কে কিছু প্রস্তরখণ্ড সংগ্রহ করতে বললেন। ইবনে আব্বাস (রা) কিছু প্রস্তরখণ্ড সংগ্রহ করে আনলেন। রসুলাল্লাহ (সা.) পাথরগুলোর আকার দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন: “হ্যাঁ, এই পাথরগুলোর মতোই ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বা জবরদস্তি থেকে সাবধান।” (ইমাম আহমাদ, আন-নাসাই, ইবনে কাছীর ও হাশীম) এ থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুসলমানরা যেন অতি উৎসাহী হয়ে বড় পাথর ব্যবহারের মতো বাড়াবাড়িতে প্রবৃত্ত না হয়।
৬. রসুলাল্লাহ (সা.) বলতেন, “নিজের ওপর এমন অতিরিক্ত বোঝা চাপিও না যাতে তোমার ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তোমাদের পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠী নিজেদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে ধ্বংস হয়েছে। তাদের ধ্বংসাবশেষ পুরাতন মঠ-মন্দিরে খুঁজে পাওয়া যায়।” আবু ইয়ালা তার মসনদে আনাস ইবনে মালিকের বরাতে এবং ইবনে কাছীর সূরা হাদীদের ২৭ আয়াতের তাফসীরে এই হাদীস উল্লেখ করেছেন।
৭. ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “একটি লোক রসুলাল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বললেন: “হে আল্লাহর রসুল, আমি যখনি এই গোশতগুলো খাই তখুনি আমার কামপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তাই আমি গোশত না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এরপর পরই আয়াত নাযিল হয় এবং ঐ ব্যক্তি সতর্ক হয়ে যান।
৮. আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, “একদল লোক নবী সহধর্মিণীদের কাছে এসে রসুলাল্লাহর এবাদত স¤পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। এ ব্যাপারে অবহিত হওয়ার পর তারা তাদের ইবাদত-বন্দেগীকে অপর্যাপ্ত বিবেচনা করে একজন বললেন, আমি সর্বদা সারারাত নামাজ পড়ব; আরেকজন বললেন, আমি সারা বছর রোজা রাখব এবং কখনো ভাঙ্গবো না। এ সময় আল্লাহর নবী তাদের কাছে এলেন এবং বললেন: “আল্লাহর শপথ আল্লাহর প্রতি আনুগত্য আমারই সবচেয়ে বেশী এবং তাঁকে বেশী ভয় করি তোমাদের চেয়ে; তথাপি আমি রোযা রাখি এবং ভাঙ্গিও, আমি ঘুমোই এবং নারীকে বিয়ে করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাহকে অনুসরণ করে না সে আমার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
৯. একবার মহানবী (সা.) সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে জেহাদে যাচ্ছিলেন। পথে এমন একটা স্থানে বিশ্রামের জন্য যাত্রা বিরতি করলেন যে জায়গাটা নির্জন, ছায়া ঘেরা এবং একটি পানির ঝরণা আছে। একজন সাহাবা বললেন- আহ! আমি যদি এই সুন্দর নির্জন জায়গাটায় একা থেকে যেতে পারতাম। (অবশ্যই তিনি ওখানে থেকে আল্লাহর এবাদতের কথা বোঝালেন, কারণ এ নির্জনে বসে তো আর ঘর-সংসার বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বোঝান নি।) আল্লাহর রসুল ঐ কথা শুনে বললেন- আমি ইহুদী বা খ্রীস্টান ধর্ম নিয়ে আসিনি, আমাদের এ পথ নয়। যার হাতে মোহাম্মদের জীবন তার কসম, আল্লাহর রাস্তায় (শান্তি প্রতিষ্ঠার) যুদ্ধের জন্য শুধু সকাল বা বিকাল বেলার (একবেলা) পথ চলা সমস্ত পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার চেয়ে এবং ৬০ বছরের নামাজের চেয়ে বেশি। (হাদীস- আবু ওমামা (রা.) থেকে -আহমদ, মেশকাত)
১০. রসুলাল্লাহ মুয়াজ ও আবু মুসাকে (রা.) ইয়ামানে প্রেরণের প্রাক্কালে এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে, “(জনগণের কাছে ধর্মীয় বিষয়গুলো) সহজ করে তুলে ধরো, কঠিনরূপে নয়। একে অপরকে মান্য করো, বিভেদে লিপ্ত হয়ো না।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)
দুর্ভাগ্যক্রমে আল্লাহ ও রসুলের এত সতর্কবাণী আজ এই জাতির মনে নেই। দ্বীনের ভারসাম্য বহু পূর্বেই হারিয়ে গেছে এবং তার ফলে আমাদের জাতিও ভারসাম্যহীন জনসংখ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। একটি ভাগ আখেরাতের কথা ভুলে ভোগবাদের পেছনে ছুটছে, আরেক ভাগ দুনিয়াবিমুখ হয়ে মসজিদে, হুজরায়, খানকায় ঢুকেছে। আল্লাহ-রসুলের সেই সহজ-সরল ইসলামও এখন নেই, গত ১৩০০ বছরের আলেম-ওলামা, ফকিহ, মোফাসসের, মোহাদ্দীসদের অতি বিশ্লেষণে দ্বীন এতই জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে গেছে যে, তা আর সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী নেই। এমতাবস্থায় অসীম করুণাময় আল্লাহ তাঁর এক বান্দা, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মাধ্যমে সেই সহজ-সরল ভারসাম্যপূর্ণ দ্বীনের জ্ঞান মানবজাতিকে দান করেছেন। সেই প্রকৃত ইসলামের রূপরেখাই সকলের সামনে তুলে ধরছে হেযবুত তওহীদ।