প্রতিটি সভ্যতার নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। সভ্যতার অনুসারীরা সেই সংস্কৃতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করে চলে। সংস্কৃতি বলতে আমি বোঝাচ্ছি সেখানকার মানুষ যে কাজগুলো করে সেগুলোকে। প্রতিটি সভ্যতা গড়ে ওঠে কোনো মূলনীতিকে আশ্রয় করে। পাশাপাশি তাদের একটি নিজস্ব জীবনব্যবস্থা থাকতে হয় যা ঐ মূলনীতির সাপেক্ষে গড়ে ওঠে।
যেমন কোনো সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে ব্যক্তিস্বার্থকে ভিত্তি করে। সেখানে কেউ জাতির জন্য কাজ করবে না, করবে নিজের আর্থিক উন্নতি করার জন্য। সেই সমাজে যার হাতে অর্থ বেশি তার সম্মান তত বেশি। এখানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কাজকে মূল্যায়ন করা হবে অর্থের মাপকাঠি দিয়ে। লেখাপড়া শেখা হবে গাড়িঘোড়ায় চড়ার জন্য, বিয়ে করার সময় অপরপক্ষের আর্থিক উচ্চতা মাপা হবে সবার আগে। সেখানে শিশুরা তার বাবার সততা নিয়ে আলোচনা করবে না, কার বাবা বেশি বড়লোক সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে। অর্থাৎ এই সভ্যতার চেহারটাই হবে টাকার মত। টাকা ছাড়া সব কিছুই সেখানে তুচ্ছ। মানুষের চরিত্র সেখানে হবে গৌণ। তার সততাকে বোকামি বলে, পরোপকারকে পাগলামি বলে তামাশা করা হবে। সেখানে মানবতাবোধের চর্চাও করা হবে স্বার্থের জন্য। শিল্পীরা গাইবে টাকার জন্য, বক্তারা বক্তব্য দিবে টাকার জন্য, ধর্মপ্রচারক ধর্মপ্রচার করবে টাকার জন্য, বাবা সন্তানকে বড় করে তুলবে টাকার জন্য। আমরা কি নিজেদেরকে এমনই একটি সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না? এই সমাজে প্রকাশ্যে সর্বরকম অন্যায় করা হয়, এমন কি চলন্ত বাসে যাত্রীদের সামনে নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয় কিন্তু মানুষ প্রতিবাদ না করে সেটা দর্শন করে। হয়ত কেউ কেউ উপভোগও করে। এখানে সুদ ঘুষ কেবল বৈধই নয়, বাধ্যতামূলক। যে এর প্রতিবাদ করবে সে নিজেই সুবিধাবঞ্চিত হবে। এখানে প্রকাশ্যে নারীদের আপাদমস্তক ঢেকে পথচলার ওয়াজ করা হয়, আর মাদ্রাসায় নাবালক ছাত্রদেরকে ধর্ষণ করা হয়। কেউ এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। কারণ করতে গেলে নিজের সময় নষ্ট হবে, নিজের কোনোপ্রকার স্বার্থহানি হবে। তাই এই সমাজে অন্যায়কারী নির্বিঘ্ন, বেপরোয়া। এই সমাজে মানুষ বেঁচে থাকে অপরাধীদের কৃপায়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে থানায় পুলিশের হাতে ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাও এদেশে ঘটেছে।
এভাবে অন্যায়ের ফিরিস্তি দিতে থাকলে সারাজীবনেও শেষ হবে না। কিন্তু এসবের গোড়াটা কোথায় সেটাই হচ্ছে আসল প্রশ্ন। আসলে অন্যায়ের গোড়াটা হচ্ছে বস্তুগত স্বার্থকেই জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড বলে গ্রহণ করা। এই মানদণ্ডের নিরীখে যে কাজে পকেট ভরে সে কাজ দেশের বিরুদ্ধে গেলেও, ধর্মের বিরুদ্ধে গেলেও নির্দ্বধিায় করা যায়, আদালতকে সাক্ষীগোপাল বানিয়ে মিথ্যা মামলায় মানুষকে যাবজ্জীবন জেল খাটানো যায়, আইনের ফাঁক গলে চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকুরের কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া যায়, ওয়াজের মঞ্চে বসে অন্য ধর্মের অবতারদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা যায়, কাউকে হত্যা করা ফরজ বলে ফতোয়া দিয়ে দেওয়া যায়। এভাবে প্রতিদিন তিল তিল করে বেড়ে ওঠা অন্যায়ের বিষবৃক্ষগুলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রের তার শিকড় ও শাখা বিস্তার করে যাচ্ছে। মানুষ দেখেও দেখছে না, সে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত স্বার্থের চক্রে ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্ম স্বার্থপরতায় পূর্ববর্তীদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয় মহামারী আকার ধারণ করছে। যন্ত্রমুখী জীবনে আত্মার কোনো স্থান নেই আর।
তবু আছে ধর্মবিশ্বাস, আছে ধর্মীয় আবেগ। সেই আবেগকে ব্যবহার করা হচ্ছে সন্ত্রাসে, রাজনীতিতে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে, গুজব ছড়াতে। ফলে ধর্মীয় উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ ধর্মান্ধ মানুষ সন্ত্রাস-সহিংসতায় মেতেছে, জাতীর সম্পদ ও ভাবমূর্তি দুটোই ধ্বংস করেছে। শক্তিমানের অন্যায়কে উপেক্ষা করা আমাদের সংস্কৃতি। আর দুর্বলের পান থেকে চুন খসলেই লাথি আথালি পাথালি। এইভাবে আজ সকল প্রকার অন্যায় আমাদের গোটা জাতির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, জীবনব্যবস্থা, মূল্যবোধ সবকিছুকেই গ্রাস করে নিয়েছে। তরান্বিত করছে আমাদের ধ্বংসপ্রক্রিয়া। ধর্ম যখন অধর্মের উৎস হয়ে যায় তখন তাকে আর ধারণ করা যায় না। গণতন্ত্রের নামে যখন জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয় তখন সেই কেতাবি মতবাদকে ছুঁড়ে ফেলতে হয়। অন্যায় যে প্রতিষ্ঠান থেকেই করা হোক তার বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী হতে হয়। ঐক্যবদ্ধ মানুষ যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যায় সেই ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। সবাই যদি শক্তিমানের অন্যায়ের পায়ে আত্মসমর্পণ করে বসে তাহলে মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।
ঠিক বিপরীতক্রমে যদি এমন একটি সভ্যতা গড়ে তোলা যায় যার ভিত্তিই হবে- সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধতা করা তাহলে সেই সভ্যতার প্রতিটি নাগরিক বেড়ে উঠবে অন্যায়বিরোধী হয়ে। সেখানে কেউ অন্যায় করলে অন্যরা তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না, সে তার পারিপার্শ্ব থেকে অন্যায়কাজে উৎসাহিত হবে না। কেউ ওয়াজের ময়দানে হিংসা ছড়ালে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে শ্রোতারা দাঁড়িয়ে যাবে। কেউ দুর্নীতি করলে প্রত্যেকে তাকে বয়কট করবে, এমনকি সে প্রতিবাদের সম্মুখীন হবে তার স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের কাছ থেকে। প্রতিটি গণমাধ্যম শক্তিমানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করবে, কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থ তাকে নিবৃত্ত রাখতে পারবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ অন্যায়কারীদেরকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেবে। দৈনিক বজ্রশক্তি জাতির মানসে এমনই একটি সভ্যতার ভিত্তি রচনা করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ধর্মের নামে, গণতন্ত্রের নামে, পাশ্চাত্য আধুনিকতার নামে যত রকম অন্যায় আমাদের সমাজে কালোছায়া বিস্তার করছে দৈনিক বজ্রশক্তি সেই সকল প্রকার “অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর” হিসাবে সোচ্চার রয়েছে।