মসীহ উর রহমান:
অনেক মানুষই নিজেকে দেশপ্রেমিক বলে প্রচার করেন যাদের দেশপ্রেম নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তোলে। যখন দেখা যায় তারা এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতি কৃষক, শ্রমিক, কর্মজীবী মানুষের রক্ত পানি করা অর্থ দিয়ে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশুনা করান, সুইসব্যাংকে টাকার পাহাড় জমান, দেশের জনগণের টাকা বিদেশে পাচার করেন। তাদের চরিত্র এ উপমহাদেশ ২০০ বছর শোষণকারী ব্রিটিশদের মতো। সেই ইংরেজদের সাথে তাদের যথেষ্ট মিল আছে। উভয়ের চরিত্রের মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। ইংরেজরা এদেশ দখল করেছিল। তাদের বাড়ি-গাড়ি, পরিবার-পরিজন, বিষয়-সম্পত্তি ছিল সব ইংল্যান্ডে তারা এদেশ শাসন করলেও, এদেশে বাস করলেও, এদেশের মানুষের অর্থ-সম্পদ, সেবা ভোগ করলেও তারা এদেশকে কখনই নিজেদের দেশ মনে করত না। কাজেই তাদের এদেশের প্রতি আর এদেশের মানুষের প্রতি কোন মায়া বা দায়বদ্ধতা ছিল না। বন্যা, খরা জলোচ্ছাসে কে না খেয়ে মারা গেল, দাঙ্গা-ফাসাদে কোন এলাকা ধ্বংস হল এগুলো তাদের চিন্তার বিষয় ছিল না। এগুলোতে তাদের কোন কিছুই আসত যেত না। তাদের জন্য সর্বদা জাহাজ প্রস্তুত থাকত। কোন সমস্যা বা একটু অসুবিধা হলেই তারা জাহাজে চেপে ইংল্যান্ডে চলে যেত। সাথে নিয়ে যেতো অঢেল অর্থ-সম্পদ। ঠিক এখনও দেশপ্রেমিক নামধারী রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও ব্যবসায়ীদের অনেকেরই পাসপোর্ট রেডি থাকে, বিদেশে বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, পুত্র-পরিজন সবই রেডি থাকে দেশে তাদের কোন সমস্যা, মামলা, সরকার পরিবর্তন হলে অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ধস নামলেই চিকিৎসা বা অন্য কোনো অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমান। এককথায় বলা যায় ব্রিটিশরা যেমন এদেশ থেকে অর্থ স¤পদ লুট-পাট করে ইংল্যান্ডে গাড়ি, বাড়ি, জমি-জমা, খামার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতো তারাও ঠিক সেইরকম। এসমস্ত লোকেরা কখনও দেশপ্রেমিক নয়। দেশপ্রেমিক তো তারা যারা দেশের মানুষের জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য, কল্যাণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে, এবং নিজেদের সমস্ত অর্জন সমস্ত আয়, সমস্ত পরিশ্রম সমস্ত কিছু দেশের মাটির জন্য, মানুষের জন্য বিলিয়ে দেয় তারাই হলো দেশপ্রেমিক। এখন এই দেশপ্রেম ও দেশপ্রেমিক একটা দেশের জন্য কতটুকু প্রয়োজন? এ প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে প্রথমেই বলতে হয় দেশের কথা, একজন ব্যক্তি যেমন পরিবারের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ পরিবার ছাড়া যেমন ব্যক্তি অস্তিত্বহীন তেমনি একটি পরিবার, সমাজ, সংঘ ইত্যাদিও রাষ্ট্র তথা দেশের উপর নির্ভরশীল স্ব স্ব অস্তিত্বের জন্য। রাষ্ট্র তথা দেশ ছাড়া এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ দেশ যদি না থাকে তাহলে কোন সমাজ, পরিবার কিছুই থাকবেনা। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। পেয়েছি বাংলাদেশ। এখন আমাদের এই বাংলাদেশের সম্মান, মর্যাদা, প্রকৃত সার্বভৌমত্বের জন্য এর ষোল কোটি মানুষের মাঝে দেশপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে। কেন তা সকলের জানা প্রয়োজন। সবাই যদি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে তাহলে আর কেউ দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কর্মকা-কে মেনে নেবে না এবং স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেদেরকে নিয়োজিত করবে। দেশ থেকে কেবল নেবেই না, দেশকে দেওয়ার মানসিকতাও পোষণ করবে। এটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। দেশপ্রেম স¤পর্কে একটি বহুল উচ্চারিত হাদিস রয়েছে “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ”। কিন্তু বিষয়টি আপেক্ষিক। দেশপ্রেমের মানে এই নয় যে, অন্য দেশের অনাহারী, নিপীড়িত মানুষের প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই। মানবতাবোধ সকল ভৌগোলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে। আধিপত্য কায়েম রাখার জন্য অন্য দেশের মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলে নিজেদের দেশের স্বার্থ রক্ষাকে দেশপ্রেম বলে না, এই দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ নয়। মনে রাখতে হবে মানুষের স্থান সবার ঊর্ধ্বে।
দেশপ্রেমের প্রকৃত অর্থ হলো দেশ ও দেশের মানুষের সুরক্ষা, ন্যায় নীতি, কল্যাণ, নিরাপত্তা, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আত্মনিয়োগ করা। এর জন্য প্রয়োজন সর্বত্র সত্যের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা করা। রসুলাল্লাহ (সা.) মক্কা নগরীকে খুব ভালোবাসতেন যে বিষয়ে আলেমগণ প্রায়ই ওয়াজ করে থাকেন। তিনি মক্কা থেকে মদীনায় হেজরত করার সময় কেমনভাবে অশ্রুবিগলিত কণ্ঠে মক্কাকে বিদায় জানিয়েছিলেন তা মিলাদের মধ্যেও সুর করে গাওয়া হয়। কিন্তু তিনি মদীনাকে রক্ষা করার জন্য যে কঠোর সংগ্রাম করেছেন, পেটে পাথর বেঁধে না খেয়ে থেকেছেন, রক্তক্ষয় ও ত্যাগস্বীকার করেছেন সে কথাগুলো দেশপ্রেমের উদাহরণ হিসাবে দেওয়া হয় না। কারণ প্রতিষ্ঠিত ধারণা হচ্ছে মাতৃভূমিই হচ্ছে দেশ, তাই যেন দেশপ্রেম থাকতে হবে কেবল মাতৃভূমির জন্য। অথচ মক্কা সত্যকে মেনে নেয় নি, তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে, নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। পক্ষান্তরে মদীনাবাসী রসুলাল্লাহর (সা.) আহ্বানকে স্বীকার করে সত্যকে মেনে নিয়ে তাঁকে নিজেদের পরিবারভুক্ত করে নিল, সেই মদীনার প্রতি রসুলাল্লাহর প্রেম মক্কা থেকে কোনো অংশে কম ছিল না, বরং বেশিই ছিল কারণ তিনি মক্কা বিজয়ের পর মক্কায় না থেকে মদীনাতেই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এবং সেখানেই দেহরক্ষা করেছিলেন, তাঁর পবিত্র রওজা সেখানেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মানুষের জীবন থেকে অন্যায় অবিচার, রক্তপাত, হানাহানি নির্মূল করাই ছিল রসুলাল্লাহর জীবনের লক্ষ্য। যারা তাঁর ডাক প্রত্যাখ্যান করেছে তারা যতই রক্তীয় সম্পর্কে আবদ্ধ হোন, তাঁর প্রকৃত আপনজন তারাই যারা তাঁর আদর্শকে গ্রহণ করে নিয়েছে। সেটা হচ্ছে মদীনা। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মক্কার নিজ আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সুতরাং যে ভূখণ্ডে আল্লাহ আমাকে নিজের ঈমান, বিশ্বাস ধারণ করে নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন সেটাই আমার ভূখণ্ড। একে রক্ষা করা আমার ঈমানী কর্তব্য। ঐ ভূখণ্ডকে অন্যায়, অবিচার ও মিথ্যার কলুষমুক্ত করার জন্য যে প্রেরণা সেটাই দেশপ্রেম। তাহলে কিভাবে দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ হবে? সেটা হলো যে দেশে আমার ঈমান (সত্যের প্রতি বিশ্বাস) সংরক্ষিত থাকবে, হেফাযতে থাকবে, যে দেশ হবে সত্যের আধার, মানবতার আধার, যে ভূ-খণ্ড অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না, যে ভূ-খণ্ডে সত্য প্রকাশিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে সবাই সত্য, মানবতা ও শান্তির চর্চা করে সর্বোপরি আল্লাহর আদেশ নিষেধ মান্য করা হয়, সেই ভূ-খণ্ড, মাটি ও দেশকে রক্ষা করা, সে দেশের জন্য কাজ করা প্রত্যেকের ঈমানী দায়িত্ব। যা আমাদের রসুলাল্লাহ মদিনায় করে গেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই বাংলাদেশ কি সত্যের ধারক কিনা, এখানে মানবতা ও শান্তি আছে কিনা? অনেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বলতে পারেন এই দেশে আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নোংরা প্রতিযোগিতা, ধর্মের নামে বিভিন্ন কায়দায় স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এ বিষয়ে আমাদের অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? আমরা মনে করি আমাদের মাননীয় এমামুয্যামানকে আল্লাহ মহাসত্য দান করেছেন এই ভূ-খণ্ডেই, এই বাংলার মাটিতেই। প্রথম দেড়যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে আমাদের দেশের মানুষ কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীসহ নানান শ্রেণিপেশার মানুষ আমাদের বিরোধিতা করেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে ধর্মব্যবসায়ী ও ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়াগুলো সীমাহীন অপপ্রচার চালিয়েছে। যার পরিণামে আমাদেরকে ভোগ করতে হয়েছে অসহনীয় নির্যাতন। আমাদেরকে অধিকাংশ মানুষ ভুল বুঝেছেন কিন্তু আল্লাহর অশেষ দয়ায় আজ সেই সকল শ্রেণি পেশার মানুষই যারা আমাদের বিরোধিতা করতো তারাই আজ হেযবুত তওহীদকে, সত্যকে দু’হাত তুলে সমর্থন করছেন। আল্লাহ দয়া করে তাদের হৃদয়কে সত্যের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন, তাদের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশ এখন আমাদের দৃষ্টিতে সত্যের ভূমি, যেখানে সত্যের আলো তথা ন্যায়-শান্তি-সুবিচার বিকশিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখান থেকেই আল্লাহর প্রেরিত শাশ্বত মহাসত্যের পুনরুত্থান হয়েছে এবং মানুষ তা সাদরে গ্রহণও করছে ও করবে। ইনশা’আল্লাহ এ সত্য একদিন সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করবে। তাই এই দেশকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, দেশের উন্নতি নিয়ে ভাবতে হবে, দেশে যেন অন্যায়, অনাচার, মিথ্যা টিকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ যেন শান্তিতে থাকতে পারে এদেশ যেন কোন বিপদের মুখে না পড়ে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এদেশে জন্মেছি, বড় হয়েছি, এদেশের প্রকৃতি আমাদের লালন করেছে, এই মাটিতে আমরা সেজদা করি, আমাদের পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্বও এদেশে মিশে আছে। কাজেই এই দেশের জন্য, এখানে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের সবাইকে, ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সর্বশ্রেণির মানুষকে একত্রে কাজ করতে হবে। দেশী-বিদেশী কোনো শয়তানী শক্তি যেন আমাদের দেশের উপর কালো থাবা বিস্তার করতে না পারে সে দিকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের সামনে লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশের জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে। সে দেশের মানুষগুলোর আর কোনো বাসস্থান নেই, তারা সব হারিয়ে বিভিন্ন দেশের পথে প্রান্তরে শরণার্থী শিবিরে অবর্ণনীয় দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে। আমাদের এই এক চিলতে মাটি বুকে আগলে ধরে সমস্ত রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। দেশের ক্ষতি হয়, মানুষের ক্ষতি হয় এমন কাজ যেন কেউ করতে না পারে এজন্য সকলকে সত্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যারা দেশপ্রেমিক সেজে, জনসেবার নাম করে দেশের ক্ষতি করে, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে তাদেরকে প্রথমে আমাদের বুঝাতে হবে, যদি তারা সংশোধিত না হয় তবে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ কাজগুলোই আমাদের এবাদত ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।