মোহাম্মদ আসাদ আলী:
রসুলাল্লাহর মক্কা জীবনের একটি ঘটনা। একদিন তিনি কোরাইশ গণ্যমান্য নেতাদের নিয়ে বসেছেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন তারা রসুলাল্লাহর কথাগুলো মনোযোগের সাথে শুনছিল এবং মাঝে মাঝেই ‘ঠিকই তো’ ‘কথা তো সত্য’ এরকম মন্তব্য করছিল। তাদের এমন ইতিবাচক সাড়া দেখে রসুলাল্লাহ আশাবাদী হয়ে উঠলেন। বলা তো যায় না, হয়ত এই মোশরেক গোত্রপতিদের ভাবান্তর হচ্ছে, সন্দেহের মেঘ কেটে গিয়ে সত্যের সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ছে তাদের অন্তকরণে। তাই কিছুটা আশান্বিত হৃদয়ে রসুল (সা.) কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এই সময়ে হঠাৎ সেখানে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মি মাকতূম (রা.) নামক এক অন্ধ সাহাবী উপস্থিত হলেন।
এই সাহাবীর ব্যাপারে বলে রাখি যে, তিনি বহু পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, প্রায়ই তিনি রসুলাল্লাহর (সা.) কাছে হাজির হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর কথাবার্তা শুনতেন, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। সেদিনও তিনি রসুলকে (সা.) প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগলেন। ইবনে উম্মি মাকতুমের (রা.) এই আগমনে ও পরিস্থিতি না বুঝে বাক্যালাপ শুরু করায় আল্লাহর রসুল একটু বিরক্ত হলেন এবং বিরক্তিসূচক তাঁর কিছুটা ‘ভ্রুকুঞ্চিত’ হলো। তবে বিরক্ত হলেও তিনি ইবনে উম্মি মাখদুমকে (রা.) চলে যেতে বললেন না কিংবা ‘আমি এখন কোরাইশ নেতাদের সাথে কথা বলছি, এর মাঝে কথা বল না’ এমন কোনো মন্তব্যও করলেন না।
ঘটনাটি একদিক থেকে দেখলে খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা এবং সেজন্যই ইবনে উম্মি মাকতুম (রা.) এর প্রতি রসুলের ‘ভ্রুকুঞ্চন’ সবার অগোচরেই থেকে গেল। কিন্তু যাঁর কাছে একজন মো’মেনের সম্মান তাঁর ক্বাবারও ঊর্ধ্বে, সেই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এই ঘটনা দেখলেন এবং এই সামান্য ‘ভ্রুকুঞ্চনটুকুও’ তিনি বরদাস্ত করলেন না। পরোক্ষণেই সুরা আবাসা নাজেল করে আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন তাঁর কাছে ঐ অন্ধ ব্যক্তির মর্যাদা ঐসব অহংকারী কোরাইশ গোত্রপতিদের চাইতে অনেক অনেক বেশি। আল্লাহ তাঁর রসুলের (সা.) ঐ ভ্রুকুঞ্চনকে ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘‘তিনি (রসুল) ভ্রƒকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশে তার উপকার হত? পরন্তু যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোন দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে আসলো এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবানী। অতএব, যে ইচ্ছা করবে, সে একে গ্রহণ করবে।’’ (সুরা আবাসা ১-১২)
এই আয়াতগুলো যখন পড়ি তখন নিজের অজান্তেই চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে আসে। নভোম-ল ও ভূম-লের রাজাধিরাজ, অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহ, কোনো কিছু সৃষ্টি ও ধ্বংসের জন্য যার একটি হুকুমই যথেষ্ট, তিনি ভর্ৎসনা করছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবকে এবং তা কেবল এই জন্য যে, তিনি একজন অন্ধ ব্যক্তির প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন! বান্দার প্রতি কতটা সহানুভব থেকে তিনি এই কথাগুলো বলেছেন! একজন মো’মেন বান্দার জন্য কতটা মায়া-মমতা, ¯েœহ-ভালোবাসা মিশে আছে এই কয়টি শব্দের মধ্যে!
সর্বদ্রষ্টা আল্লাহ তো জানতেন আল্লাহর রসুল কেন ইবনে উম্মি মাকতুমের (রা.) কথায় কর্ণপাত করেন নি, কেন ‘ভ্রুকুঞ্চন’ করেছিলেন। সময়টি খেয়াল করুন, মক্কায় তখন রসুলের (সা.) বিরুদ্ধে অবিশ্রান্ত অপপ্রচার চলছে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে প্রবল বিরোধিতা, মারধোর, নির্যাতন, হুমকি-ধামকি। হাতে গোনা কয়েকজন অনুসারী হয়েছে, তাদেরকেও ইসলাম ত্যাগ করানোর জন্য কতই না জোরাজুরি চলছে। কোরাইশ নেতারা, সমাজপতিরা, পুরোহিতরা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যে কোনো উপায়ে তাদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর। এমতাবস্থায় একটি আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার জন্য একজন দক্ষ সংগঠকের যে উদ্যোগটি নেওয়া উচিত আল্লাহর রসুলও তাই নিলেন। তিনি সমাজের বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদেরকে নানাভাবে বোঝাতে লাগলেন তিনি কী চান, কী লক্ষ্যে তাঁর এই আন্দোলন। উদ্দেশ্য বেশিকিছু নয়, অন্তত যেন তাঁর প্রতি কোরাইশ নেতাদের বিদ্বেষভাবটা দূর হয়ে যায়, অপপ্রচার বন্ধ হয় এবং তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীরা আর নির্যাতনের শিকার না হয়। যেদিনকার ঘটনা বললাম সেদিনের আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে আল্লাহর রসুলকে না জানি কতদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে, কতবার সুযোগ এসেও আসে নি, হয়ত তাঁর কথায় কেউ মনোযোগীই হয় নি। এতকিছুর পর যখন তিনি বলার মত উপযুক্ত একটি পরিবেশ পেলেন এবং তাঁর বক্তব্যে কোরাইশ নেতাদেরকে মনোযোগী হতে দেখা গেল ঠিক সেই সময়ে ইবনে উম্মি মাকতুম (রা.) উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং তার ফলে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সুযোগ ভেস্তে যাবার আশঙ্কাতেই রসুল ভ্রুকুঞ্চন করলেন। এতে রিপুজয়ী মহানবীর ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ ছিল না তা তো মহান আল্লাহর অজানা নয়। কিন্তু ঐটুকুও তিনি বরদাস্ত না করে প্রিয় হাবিবকে ভর্ৎসনা করতে ছাড়লেন না এবং পরিষ্কার ভাষায় নির্দেশ দিলেন, এরপর যেন আল্লাহর রসুল এমন কাজ আর না করেন। ইতিহাসে পাই আল্লাহর রসুল তো রসুলই, তাঁর আসহাবদের মধ্যেও প্রত্যেকে উম্মি মাকতুমকে (রা.) আজীবন মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছিলেন। সুরা আবাসার উপরোক্ত আয়াতগুলো নাজেলের পর থেকে আল্লাহর রসুল ইবনে উম্মি মাকতুমকে (রা.) প্রচ- শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাকে আসতে দেখলে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। তাঁর খোঁজ-খবর রাখতেন। অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাঁর কথা শুনতেন। দেখা-সাক্ষাৎ হলে জানতে চাইতেন তাঁর কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা, কোনো কথা বলবেন কিনা। যখন মদীনার বাইরে যেতেন, তখন ইবনে উম্মি মাখদুমকে (রা.) মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে যেতেন। রসুলের শত শত সাহাবী রসুলের অনুপস্থিতিতে উম্মে মাখদুমের (রা.) পেছনে সালাহ কায়েম করতেন।
এই আয়াত নাজেলের পর চিরদিনের জন্য একটি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে, সমাজের প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান, অর্থবিত্তের অধিকারী রুই-কাতলাদের চাইতে সত্যনিষ্ঠ একজন ইবনে উম্মি মাকতুম (রা.) আল্লাহর কাছে বেশি ভালোবাসার পাত্র, বেশি মর্যাদার অধিকারী। এবং এই সত্যনিষ্ঠ মানুষগুলো বংশগৌরবে, শারীরিক সক্ষমতায়, আর্থিক মাপকাঠিতে যেমনই হোক, তাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুঞ্চন করার অধিকার কোনো বনি আদমের তো বটেই, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবেরও নেই। এই হচ্ছেন আমার আল্লাহ, যিনি সমাজের সবচাইতে দুর্বল মানুষটির জন্যও বিচলিত হন। এজন্যই আমার আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দিয়ে আমি গর্বিত হই, আমার আল্লাহর হুকুম মান্য করে ধন্য হই। প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে এজন্যই আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে ঘোষণা করি- ‘আল্লাহু আকবার’ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।