রিয়াদুল হাসান:
ধর্মীয় দর্শন ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের সঙ্গে অন্য সব প্রাণীর মৌলিক তফাত রয়েছে। এবং এটা সর্বজনস্বীকৃত, বৈজ্ঞানিকভাবেও স্বীকৃত। মানুষ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। কোনো প্রাণীর প্রখর ঘ্রাণশক্তি আছে, কিন্তু তার সেরকম প্রখর দৃষ্টিশক্তি নেই। কোনো কোনো প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি সাংঘাতিক কিন্তু সে আবার বর্ণান্ধ। কারো গায়ে অনেক শক্তি কিন্তু তার শ্রবণশক্তি ক্ষীণ। কিন্তু মানুষ হচ্ছে এমন এক সৃষ্টি যার মধ্যে সকল প্রাণীর বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি সমন্বয় ঘটেছে। মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক দিয়ে সে চিন্তা করে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে।
আরেকটি অসাধারণ, বিস্ময়কর সত্ত্বা মানুষের মধ্যে বিরাজ করে সেটা হচ্ছে তার আত্মা যাকে কেউ বলেন বিবেক, চিন্তাশক্তি, উপলব্ধি করার ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, মন। আল্লাহর ভাষায় এটাই হচ্ছে রূহাল্লাহ বা আল্লাহর আত্মা যার মধ্যে আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীর সঙ্গে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিও রয়েছে, যদিও তা অতি ক্ষুদ্র মাত্রায়। বস্তু হলে তা চোখে দেখা যায়, তার আয়তন ভর পরিমাপ করা যায়। কিন্তু যা অবস্তু যেমন কোনো সঙ্কট, তাহলে সেটা কত বড় সঙ্কট, তার ভয়াবহতা কী তা মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হয়, আত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যদি কারো সম্মানের ব্যাপার হয় তাহলে সেই সম্মানের মাহাত্ম্য, উচ্চতা উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে। যে জাতির চিন্তার জগতে স্থবিরতা আসে তাদের মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায়। কিন্তু সমাজের শিক্ষিত শ্রেণিটি আধুনিকতার অহংকারে এতটাই স্ফীত হয়ে আছে যে, তারা এই সভ্যতাকে এই সমাজকে প্রগতিশীল সমাজ বলে। কারণ এই সময়ে মানুষ এত প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে যা দেখে তারা বিমুগ্ধ ও পরিতৃপ্ত হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে যে আমরা এখন সভ্যতার শিখরে উঠে পড়েছি। সে একশ-দেড়শ তলা হাইরাইজ বিল্ডিং বানাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বর্তমানের চেয়ে বেশি স্থবিরতা, সমাজে ও মগজে এত আবদ্ধতা, এত সংকীর্ণতা মানব ইতিহাসে আগে কখনো হয়েছে কিনা সন্দেহ।
এটা মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে যে মানুষের সবচেয়ে বড় পরাজয় কখন? সেটা হচ্ছে যখন মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, ভিতরে প্রতিবাদের চেতনাও জাগ্রত হয় না। যখন দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, মজলুমের উপর জালেমের নির্যাতন মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে না তখন তো তার মনুষ্যত্বের সকল অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা। এমতাবস্থায় সে কীভাবে সভ্যতা ও প্রগতির অহংকার করে? আজকে মানুষ দেশ থেকে বিশ্ব পর্যন্ত সকল প্রবলের সকল অন্যায়ের কাছে দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করেছে। সে অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে। সে তার চোখ, কান, মুখ সব বন্ধ করে ফেলেছে। সে আর দশটা পশুর মতো কেবল জীবনধারণে ব্যস্ত। ব্যক্তিগত আয়ুটাকেই সে জীবন মনে করছে। মানুষ এখন মৃত।
আজকের এই সময়টির দিকে যদি আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, যদি কান পেতে শুনি, যদি আমাদের হৃদয়টি দিয়ে সময়টাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি, যদি আমাদের চিন্তাশক্তি দিয়ে বিবেচনা করি তাহলে আমরা সম্যকভাবে জানতে পারব যে কী অবস্থায় আছি আমি নিজে এবং কী অবস্থায় আছে গোটা মানবজাতি। এই ঘোর অমানিশা, এই দুর্দশা দেখে সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশেহারা। পৃথিবীতে এই মুহুর্তে ষোলো হাজার এটমবোমা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে মানুষ হত্যা করার জন্য। হিরোশিমা-নাগাসাকির ক্ষত এখনও শুকায় নি। সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো নিত্য নতুন ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র তৈরি করে মহড়া দিচ্ছে। তারা প্রতিনিয়ত একে অপরকে পাড়ার মাস্তানের ভাষায় হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। সীমান্তে সীমান্তে চলছে সংঘর্ষ রক্তপাত। সামরিক বিশেষজ্ঞ, নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা যে কোনো মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার কথা উদ্বেগের সঙ্গে প্রকাশ করছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানি, হানাহানি, স্বার্থের রাজনীতি সমস্ত দুনিয়াটাকে একটা নরক কু-ে পরিণত করেছে। এ যেন মহাকবি দান্তের সেই ইনফার্নো।
এই যে ধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে তা থেকে আমাদের এই দেশটিও বিচ্ছিন্ন নয়। এই বাংলার মাটিতে আমি জন্ম নিয়েছি। এ মাটিতে আমার পূর্ব পুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে। ১৯৭১ সালে এর পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের বীর জনতা দেশটাকে স্বাধীন করেছিল। সেই থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হতে চলল। আজকে আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে নিয়েও ভেতরে-বাইরে নানাপ্রকার ষড়যন্ত্র চলছে। এখানে জঙ্গিবাদী তা-ব সৃষ্টি করে, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রদর্শনী ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টির সা¤্রাজ্যবাদী পাঁয়তারা চলছে। সূত্র হচ্ছে এখানেও প্রায় ৯০% মানুষ ধর্মপরিচয়ে মুসলমান, আর বিশ্বজুড়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলামানদেরকে মানবতার শত্রু বলে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে এবং তাদের দেশগুলো একে একে নানা কায়দায় আগ্রাসন চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হচ্ছে, দখল করে নেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের দেশকে নিরাপদ রাখতে হলে আমাদের সকলকেই ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ কোথাও সরকার একা তার দেশকে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে পেরেছে এমন নজির একটিও নেই। ষোলো কোটির এই জাতি যদি দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হয়ে যাবতীয় জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা ইত্যাদি অপশক্তিকে রুখে দেয় তাহলেই সম্ভব হবে দেশকে রক্ষা করা, কেননা সা¤্রাজ্যবাদীরা জাতীয় অনৈক্য ও বিভাজনের সুযোগ নিয়েই সেখানে অনুপ্রবেশ করে থাকে। (চলবে)