দাসপ্রথা মানব ইতিহাসের অন্যতম বর্বর ও কলঙ্কজনক অধ্যায়ের নাম। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে পশু বা পণ্যের ন্যায় নিলামে তুলে কেনাবেচা ও জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। বিনিময়ে তাদের কপালে ঠিকমত দু’বেলা আহার এবং পরিধেয় পোশাকও জুটতো না। গৃহপালিত পশুর যেমন স্বাধীনতা কুক্ষিগত থাকত মনিবের কাছে, ঠিক তেমনি একজন ক্রীতদাসের শ্বাস-প্রশ্বাসেও যেন মনিবের সম্পূর্ণ অধিকার সংরক্ষিত ছিল। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে, এমনকি জোরপূর্বক একজন স্বাধীন মানুষকে দাসে পরিণত করা হত। দাসদের সন্তানেরাও দাস হিসেবে গণ্য হত। দাস বণিকেরা দাসদের পিঠে উত্তপ্ত লোহার সীল লাগিয়ে তাদের ব্র্যান্ডিং প্রকাশ করত। একজন দাস একাধিকবার বিক্রি হত। আর এই সীলই মনে করিয়ে দিত যে দাস স্রেফ একটা পণ্য। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও প্রতিনিয়ত অবমূল্যায়ন এবং ন্যূনতম অধিকার-বঞ্চিত এই মানুষগুলোর ইতিহাস যতটা হৃদয়বিদারক, ততটাই মানবসভ্যতার ঘৃণ্য পরিচায়ক।
দাসপ্রথার ইতিহাস বেশ পুরনো। ঠিক কবে থেকে দাসপ্রথার প্রচলন সে সম্পর্কে বিতর্ক ও সমালোচনা থাকলেও এটা সর্বজনস্বীকৃত যে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, এশিয়া থেকে ইউরোপ পৃথিবীর সর্বত্রই দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। মানব সভ্যতার যেখানেই প্রতিষ্ঠিত ছিল অথনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য, সেখানেই প্রচলিত ছিল সামাজিক ও প্রচলিত আইনানুগভাবে অনুমোদিত দাসবাণিজ্য। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে শুরু করে মিশর, চীন, রোমান, গ্রীক, আরব সভ্যতায় রাষ্ট্রীয় সম্মতিক্রমেই চালু ছিল দাসপ্রথা। মিশরের পিরামিড, চীনের মহাপ্রাচীরসহ পৃথিবীর প্রায় সকল বৃহৎ স্থাপনাগুলোতে মিশে আছে দাসদের রক্তমাখা ইতিহাস। সম্প্রতি দাসপ্রথার বর্বরতম ইতিহাসের সাক্ষী হল ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ-আমেরিকার ইতিহাস।
১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর তা ইউরোপীয়ানদের হাতে চলে আসে এবং এই বৃহৎ ভূখণ্ড আবাদযোগ্য করে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আর এজন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর লোকবল। তাই আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে পর্তুগিজদের দ্বারা লুণ্ঠিত মানুষদের জোর করে দাস বানিয়ে আমেরিকায় পাঠানো হত (যদিও পর্তুগিজদের এই লুণ্ঠন অনেক আগে থেকেই চালু ছিল এবং তারা ইউরোপে দাস চালান করত)। আফ্রিকান দাসরা আমেরিকায় এসে জমিগুলোকে আবাদযোগ্য করে তুলতে লাগল। সেখানে প্রচুর পরিমাণে আখ, তামাক, ধান, তুলা, নীল উৎপাদন হতে লাগল। ঠিক এসময়টাতে ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার মধ্যে নতুন এক বাণিজ্যিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে। ইউরোপ থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য যেমন কাপড়, বন্দুক ও বন্দুকের সরঞ্জাম, ছুরি, তামার জিনিসপত্র, গয়না ইত্যাদি পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে সরবরাহ করা হত। বিনিময়ে অর্থ নয় বরং ইউরোপীয়ান বণিকেরা আফ্রিকার নিগ্রোদের দাস হিসেবে নিয়ে যেত। এই দাসদের জাহাজের ডেকে ভরে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পাঠানো হত কৃষিকাজের জন্য। আর আমেরিকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য ইউরোপের চাহিদা পূরণ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পাঠানো হত কৃষিকাজের জন্য। আর আমেরিকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য ইউরোপের চাহিদা পূরণ করত। একই জাহাজ ইউরোপ থেকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ও পশ্চিম উপকূল থেকে আমেরিকা এবং আমেরিকা থেকে পুনরায় ইউরোপে কৃষিপণ্য নিয়ে ফেরত যাওয়ার এই বাণিজ্যকে ইতিহাসবিদরা ট্রান্সআটলান্টিক দাস-বাণিজ্য (Trans-Atlantic Slave Trade) বা ইউরো-আমেরিকান দাস-বাণিজ্য (Euro-American Slave Trade) নামে অভিহিত করেন। এটি ছিল মূলত ট্রায়াঙ্গুলার বা ত্রিভুজাকার বাণিজ্যিক (Triangular trade) ব্যবস্থা। প্রথমদিকে ইউরোপের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও পরবর্তীতে ইউরোপকে বাদ দিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমের ৬ টি রাজ্য নিয়ে গঠিত নিউ ইংল্যান্ড।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও দাসপ্রথা বিষয়ে লেখা একাধিক জনপ্রিয় বইয়ের লেখক প্রফেসর জেমস ওয়ালভিনের ভাষ্যমতে, এসময়টাতে বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় ট্রান্সআটলান্টিক দাস-বাণিজ্য পিরিয়ডে অপেক্ষাকৃত অধিক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়। আর এই সামগ্রিক ব্যবস্থায় দাসপ্রথা লুব্রিকেন্টের ভূমিকা রাখে। ফলে দাসবাণিজ্য ইতিহাসের অন্যান্য পিরিয়ডের তুলনায় এ সময়ে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ও বৃহৎ পরিসরে বিস্তার লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীদের কাছে দাসদের চাহিদা বেড়ে যায়।
জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুসারে ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকের এই ট্রান্সআটলান্টিক দাস-বাণিজ্য পিরিয়ডে আনুমানিক ১৫ মিলিয়নের (১.৫ কোটি) বেশি সংখ্যক আফ্রিকান নারী, পুরুষ ও শিশুদের দাস বানিয়ে আমেরিকায় পাঠানো হয়। এসময় আমেরিকান এবং ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীদের দ্বারা ৩৫,০০০ টি আটলান্টিক জাহাজে এই আফ্রিকান দাসদের অত্যন্ত বর্বরভাবে জাহাজের ডেকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হত। দাসবহনকারী এই জাহাজগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে অল্প জায়গায় বেশি সংখ্যক দাস বহন করা যায়। ডেকের উচ্চতা ছিল মাত্র ২ ফুট ৭ ইঞ্চি। ডেকের মধ্যে প্যাকেট হয়ে গাদাগাদি হয়ে থাকতে হত মাসের পর মাস। নড়াচড়ার সুযোগ ছিল না। প্রস্রাব-পায়খানার আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ভয়, কান্না, দুর্গন্ধ, অন্ধকার সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ ডেক হয়ে উঠত বিভীষিকাময় নরকতুল্য।
এবার ফিরে যাই ট্রান্সআটলান্টিক দাস বাণিজ্যযুগের প্রায় এক হাজার বছর আগের আরবের সেই সময়টাতে, যে সময়টাকে ‘অন্ধাকারাচ্ছন্ন যুগ’ বলা হত। এমন কোনো অন্যায়-অবিচার ছিল না যা তৎকালীন আরবে ঘটেনি। জীবন্ত মানুষের কেনাবেচা, কন্যাশিশু হত্যা, গোত্রে গোত্রে সংঘাত-লড়াই, লুণ্ঠন-রাহাজানিসহ সকল ধরনের অপরাধে ছয়লাব ছিল আরবের মরুভূমি। দাসদের কেনাবেচা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অন্যান্য পণ্যের সাথে দাসদেরও সেখানে নিয়ে চলত বাণিজ্য, দরদাম। আরবের অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারগুলোতে দাস-দাসী রাখা হত। আরবের এমন পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেন ইসলামের শেষ নবী ও রসূল মুহাম্মদ (দ.)। অর্থাৎ রসুলাল্লাহর আগমনের আগে থেকেই আরবে দাসপ্রথা বেশ শক্তপোক্তভাবেই প্রচলিত ছিল। তিনি এসেই সকল ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি, আইন প্রস্তাব করেননি। তিনি সবার আগে এক স্রষ্টার ভিত্তিতে মানুষের মানবিকসত্তা ও আত্মিকসত্তাকে জাগিয়ে তুলেন, ঐক্যবদ্ধ করেন। রাষ্ট্রক্ষমতা অধিষ্ঠানের পর সময় ও সুযোগের প্রেক্ষিতে একে একে আইনের প্রয়োগ করেন কিন্তু সেটাও ছিল আত্মিক ও দৈহিক ভারসাম্যে প্রতিষ্ঠিত। ন্যায়-অন্যায়ের মূল্যবোধ সৃষ্টির পাশাপাশি শাসনের সুযোগ রেখেছিলেন। ফলে একটা সময় দেখা গেছে অপরাধী অপরাধ করার পর স্বেচ্ছায় রসুলাল্লাহর সামনে এসে শাস্তি চেয়েছে। রসুলাল্লাহ শাস্তির পরিবর্তে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই শাস্তি গ্রহণের জন্য এতবেশি চাপ প্রয়োগ করতেন যে রসুলাল্লাহ বাধ্য হয়ে শাস্তি দিয়েছেন। শাসনের ভয়ে হয়ত সাময়িকভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু অপরাধপ্রবণতা দূর করা যায় না, একজন অপরাধীকে সম্পূর্ণ বদলিয়ে ভালো মানুষে পরিণত করা যায় না।
চারিত্রিকভাবে মানুষের আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমেই তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তন করছেন। শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত নিয়ামক যেমন রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। অর্থের সুষমবণ্টন, ক্ষমতার নির্মোহ রাজনীতির উদাহরণ তিনি নিজে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন। ফলস্বরূপ যে আরব ছিল একসময় বর্বর, বর্ণবাদ, অশিক্ষা, অপরাধ ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত, সে আরব অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠে, যেখানে যাকাত গ্রহণের মত একটি লোককেও খুঁজে পাওয়া যেত না।
দাসপ্রথা নিমূলের রসুল (দ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ইসলাম কোনো রাতারাতি বিপ¬ব ও সংস্কারের নাম নয়। অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে মানবিকসত্তাকে জাগানোর পাশাপাশি সময়ের প্রেক্ষিতে আইনের শাসনের মাধ্যমে অপরাধ নির্মূল ও অপরাধীর সংশোধনই হচ্ছে ইসলামের একটি আদর্শ। পাশাপাশি অন্যান্য পরিপূরক ও নিয়ামকগুলোর উন্নয়ন ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা। রসুল (দ.) কোনো আইন প্রতিষ্ঠা করতে আসেনি। যদি আসতেন তবে কোর’আনের পরিবর্তে কেবল আইনের ধারা সম্বলিত একটা আইনগ্রন্থ পেত বিশ্ব। কিন্তু সমগ্র কোর’আন চষে কেবলমাত্র আইনের কয়েকটি হুকুমই পাওয়া যায়, সেগুলোতেও তওবাভিত্তিক ক্ষমার সুযোগ রয়েছে। মূলত রসুল (দ.) এসেছিলেন ভারসাম্যপূর্ণ একটি আদর্শিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। এই জীবনব্যবস্থা একটা ভালো মানুষের ভালো থাকার যেমন দায় নেয়, তেমনি একটি খারাপ মানুষের ভালো হওয়ার পথ সুগম করে। এই আদর্শ যেমন ধনীর অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, তেমনি অর্থনৈতিক সাম্যের মাধ্যমে দারিদ্র্য নির্মূল করে। সেকথা বলে এসেছি। ঠিক একই নীতি তিনি প্রয়োগ হয়েছে দাসপ্রথার ক্ষেত্রেও। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই বর্বর দাসপ্রথাকে তিনি আইনের মাধ্যমে সরাসরি নিষিদ্ধ করেননি বরং ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
মক্কায় নবী মুহাম্মদ (দ.) এমন একটি দীনের দিকে আহ্বান করছেন, যেখানে এক আল্লাহ ব্যতীত আর দ্বিতীয় কোনো হুকুমদাতা, সার্বভৌম মনিব তথা ইলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)। এই একটি বাক্য শুনার পরপরই দাসরা গোপনে মুহাম্মদের (দ.) দীনে শামিল হতে লাগল। কারণ, একমাত্র দাসরাই বুঝত মালিক-গোলামের সম্পর্কটা। মানুষ যখন মানুষের মালিক হয়ে যায়, তখন সেটা হয় বর্বরতা, পরাধীনতা। আর আল্লাহ যখন মানুষের একমাত্র মনিব হয়ে যায়, তখন সেটা হয় মানুষের মুক্তির আহ্বান, দাসপ্রথার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া, নিদারুণ চপটেঘাত। কারণ একটি দাসের একাধিক মনিব থাকতে পারে না। এই চপটেঘাতের চূড়ান্তরূপ প্রকাশ হয় যখন আল্লাহর রসুল (দ.) দাস বেলালকে (রা.) মুক্ত করে ক্বাবার উপরে উঠিয়ে আযান দিতে বলেন। পবিত্র ক্বাবার উপরে আরোহণ করে একজন সাবেক ক্রীতদাস মক্কার বাকি সকল মানুষকে আহ্বান করছে, যে মানুষগুলোর মধ্যে মক্বার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ও তার সাবেক মনিবও ছিল। এই দৃশ্যটা একবার নিরপেক্ষভাবে কল্পনা করুন। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে এত বড় সাহসী উদ্যোগ না অতীতে, না এ পর্যন্ত কেউ গ্রহণ করেছে। ইসলামের প্রথম শহিদ সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত (রা.) ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ দাসী। একজন দাসী হয়েও মুহাম্মদের দীন গ্রহণ করায় তা মেনে নিতে পারেনি আবু জাহেল। আবু জাহেলের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁকে স্বামী ও ছেলেসহ মরতে হয়েছে। মক্কায় মুহাম্মদ এমন কোন আদর্শের প্রচার করেছিল যার কারণে দাস-দাসীরা স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করেছেন কিন্তু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি! নিশ্চয় সেই আদর্শ দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রাম ছিল।
রসুলাল্লাহ তদানীন্তন সমাজে প্রচলিত দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি সংগ্রাম করেছেন মূলত দাসদের সঙ্গে নিয়ে। দাসীকে মায়ের মর্যাদা দিয়েছেন ও মা বলে ডেকেছেন। দাসকে পালকপুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছেন। দাস ও দাসের পুত্রকে সেনাপতি বানিয়েছেন। দাসকে মসজিদে নববীর মোয়াজ্জিন বানিয়েছেন। দাসকে কাবার উপরে উঠিয়ে তিনি দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছেন। যুদ্ধবন্দী নারীকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। এমনকি বাইজেন্টিয়াম গভর্নর মকোকাসের থেকে উপহার পাওয়া দাসীকে মুক্তি দিয়ে দেনমোহর প্রদান করে বিয়ে করেছেন। দাসদেরকে ভাই হিসাবে ঘোষণা করেছেন।
কেবল মুখে বলে নয় বরং দাসপ্রথার প্রতি উঁনার দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর সুন্নাহ (নীতি) নিজে বাস্তবে প্রমাণ করেই জোরালোভাবে প্রকাশ করেছেন। এর বাইরে তিনি যে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছেন তা হল, তাঁর অনুসারীদের এই নির্দেশ দেয়া যে, দাসমুক্তি অন্যতম একটি আমল (পুণ্যকাজ) এবং সেই আমল পালন করা। শুধু তাই নয়, সওম ভঙ্গ, স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, কোনো শপথ ভঙ্গ করলেও দাসমুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ এই ভুলগুলো স্বাভাবিকভাবেই হওয়ার কথা এবং তিনি তা জানতেনও। এজন্যই দাসমুক্তির কথা বলেছেন। যাকাতের ৮টি খাতের মধ্যে একটি হল দাসমুক্তির জন্য দান। অর্থাৎ একজন দাসমুক্তির জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তার সমমান অথবা দাসমুক্তির ফান্ডে আংশিক অর্থ প্রদান করে দাসকে তার মনিবের কাছ থেকে ক্রয় করে সেই দাসমুক্তিতে অংশগ্রহণ করা। এমনকি রসুলের (দ.) কাছে কেউ জান্নাতের উপায় ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কথা জানতে চাইলেও তিনি দাসমুক্তির কথাই টেনে এনেছেন (বারা ইবনু আযেব (রা.) হতে বর্ণিত, মুসনাদে আহমাদ)। দাসপ্রথা নির্মূলে এর চেয়ে সহজ ও কৌশলী কোনো উপায় আছে কি!
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমি যে সময়টার কথা বলছি সেটা ইউরোপ-আমেরিকার দাসপ্রথার প্রায় এক হাজার বছর আগের কথা। ঐ সময়টাতে ইসলামের আদর্শে যেসব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই আদর্শ যদি অবিকৃতভাবে গোটা ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত, হয়ত উনিশ শতকের নির্মম দাসপ্রথার ইতিহাস না-ও লেখা হতে পারত। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মানবতার পুরোহিত ইউরোপ-আমেরিকায় দাসপ্রথা সামাজিকভাবে টিকে ছিল। আজও সেখানে সাদাকালো বিতর্ক ও সহিংসতা চলমান আছে। কিছুদিন আগেও নাসায় কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদাভাবে দেখা হত। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল পৃথক স্যানিটেশন ব্যবস্থা, অফিস ও পদমর্যাদা। যে কৃষ্ণাঙ্গদের তাদের পূর্বপুরুষরা দাস হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে, তাদের পাশাপাশি মেনে নিতে আজও তাদের সংকোচ, মগজভর্তি ঘৃণা। অথচ ইসলাম সেই ভেদাভেদ কবেই ঘুচিয়েছে।
তারপরও ইসলাম বললেই যারা দাসপ্রথার পুনরাবর্তনের ভয় দেখান তারা আসলে নিরপেক্ষ নন, বায়াসড। নিরপেক্ষভাবে ইসলামকে মূল্যায়ন করার অবস্থায় নেই। পরবর্তীকালে মুসলিম নামধারী শাসকরা আবার দাসপ্রথার প্রচলন ঘটিয়েছেন; সেটা ইসলাম নয়। তারা মদ্যপান করেছেন, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ভোগবিলাসে মেতেছিলেন সেগুলোও ইসলাম নয়। তাদের দায় থেকে আল্লাহ, রসুল (সা.) ও ইসলাম মুক্ত।