হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দানশীলতার প্রতিমূর্তি আম্মা সাওদা (রা.)

আদিবা ইসলাম

সাওদা (রা.) মক্কার বিখ্যাত কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সেই ভাগ্যবতী নারী যাঁকে রাসুল (সা.) উম্মুল মো’মেনীন খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুর পর বিয়ে করেন। শুধু তাঁকে নিয়েই রাসুল (সা.) তিন বছরের বেশি সংসার জীবন অতিবাহিত করেন। জাহেলি যুগে সাওদার প্রথম বিয়ে হয় সাকরান ইবনে আমরের সাথে। সাকরান ছিলেন সাওদার চাচাতো ভাই। আল্লাহর রাসুলের নবুয়াতপ্রাপ্তির প্রথম দিকেই সাওদা এবং তাঁর স্বামী সাকরান ইসলাম গ্রহণ করেন।

সাওদা (রা) তাঁর প্রথম স্বামীর কাছে থাকাকালীন দুইটি স্বপ্ন দেখেন এবং স্বামীকে জানানোর পর স্বামী সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) কাছে এসে একটা পা তাঁর কাঁধে তুলে দিলেন। সাওদার (রা.) স্বামী এই স্বপ্নের কথা শুনে বলেন, “তুমি যদি সত্যিই এই স্বপ্ন দেখে থাক তবে, অচিরেই আমার মৃত্যু হবে এবং আল্লাহর রাসুলের (সা.) সাথে তোমার বিয়ে হবে।” আর একবার স্বপ্নে দেখেন তিনি বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। হঠাৎ আকাশ থেকে চাঁদ ভেঙ্গে তাঁর ওপর এসে পড়ল । স্বামী স্বপ্নের কথা শুনে বলেন, “খুব শীগ্রই আমি মারা যাব, আর আমার মৃত্যুর পর তোমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে।”

সাওদার (রা.) এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা সত্য হয়েছিল। মক্কায় কাফেরদের অত্যাচারে যখন টেকা যাচ্ছিল না তখন একদল সাহাবি রসুলাল্লাহর নির্দেশে আবিসিনিয়াতে হিজরত করেন। তাঁদের সঙ্গে সাওদা (রা.) ও সাকরানও ছিলেন। পরবর্তীতে সাকরান ইসলাম ত্যাগ করে সাগর পাড়ি দিয়ে আবার মক্কায় ফিরে আসেন কিন্তু সাওদা (রা.) আবিসিয়াতেই থেকে যান। কয়েক বছর সাহাবিরা সেখানে অবস্থান করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন, সাওদাও (রা.) তাঁদের সঙ্গে ফিরে আসেন। এরই মধ্যে সাকরান মৃত্যুবরণ করেন।

আম্মা খাদিজা (রা.) ছিলেন রাসুলের প্রথম এবং প্রিয়তম স্ত্রী, রাসুলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এমন একজন স্ত্রীর মৃত্যুতে রাসুল (সা.) দারুণ বিমর্ষ এবং বেদনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। আম্মা খাদিজার (রা.) বিচ্ছেদে রাসুলের জীবনেও বহুবিধ সংকট নেমে আসে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সংসার এবং সন্তানদের লালন-পালন করা রাসুলের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। উসমান ইবনে মাজউন (রা.) নামের একজন সাহাবীর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকীম আল্লাহর রাসুলের (সা.) কাছে সাওদার (রা.) বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন। আল্লাহর রাসুলের (সা.) সম্মতি পেয়ে খাওলা গেলেন সাওদার (রা.) কাছে। তখন সাওদার (রা.) বাবা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাওদার (রা.) পিতার কাছে খাওলা বিয়ের সুসংবাদ জানান। পিতা অত্যন্ত খুশি হয়ে নিজ মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, “সাওদা তুমি কি এই বিয়েতে রাজি?” সাওদা (রা.) বলেন, “হ্যাঁ, রাজি।” এরপর রাসুল (সা.) এর কাছে এই খবর পৌঁছানোর পর তিনি বরবেশে সাওদার (রা.) বাড়িতে উপস্থিত হন এবং বিয়েকার্য সম্পাদন করেন। রাসুল (সা.) সাওদাকে (রা.) ৪০০ দিরহাম মোহরানা দান করেন। জীবনের এক কঠিন, সংকটময় সময়ে সাওদা (রা.) জীবন সঙ্গিনী হিসেবে কঠিন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে আম্মা খাদিজার (রা) শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করেন।

রসুলাল্লাহ (সা.) কী কারণে সওদাকে (রা.) বিয়ে করলেন এটা নিয়ে বিস্মিত মক্কাবাসীর মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত্য ছিল না। কারণ সওদা (রা.) ছিলেন একাধারে বিধবা, বয়স্কা এবং দেখতেও তিনি সুন্দরী ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে রসুলাল্লাহ তাঁর কোরবানি ও দীনের প্রতি অকপট আনুগত্য দেখেই এ বিয়েতে সম্মত হয়েছেন। সওদা (রা.) ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বারবার। তিনি নিজের সকল সম্পদ ফেলে রেখে অতি কষ্টকর মরুপথ পাড়ি দিয়ে অজানা অচেনা দেশ আবিসিনিয়াতে চলে যান কেবলমাত্র নিজের দীনকে ধারণ করার জন্য, তওহীদকে হেফাজত করার জন্য।

আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় করেন তখন তাঁর স্ত্রী ছিলেন সাওদা (রা.)। পরবর্তীতে তিনিও রাসুলের (রা.) সন্তানদের নিয়ে মদিনায় ফিরেন। দশম হিজরির বিদায় হজে আম্মা সাওদা (রা.) রাসুল (সা.) এর সফরসঙ্গী ছিলেন। রাসুলের স্ত্রীদের মধ্যে আম্মা সাওদা (রা.) ছিলেন লম্বা, স্বাস্থ্যবতী এবং চলা ফেরায় খুব ভারী। একদিন আল্লাহর রাসুলের স্ত্রীগণ তাঁর পাশে বসা আছেন। এমন সময় একজন প্রশ্ন করলেন: “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কার মৃত্যু হবে?” রাসুল বললেন, “যার হাত সবচেয়ে বড়।” উপস্থিত সবাই যার যার হাত মেপে দেখলেন সাওদার (রা.) হাত সবচেয়ে বড়। তারা বিশ্বাস করলেন, সাওদার (রা.) সবার আগে মৃত্যু হবে। কিন্তু সবার প্রথম মারা গেলেন যয়নব বিনতে খুজায়মা (রা.)। তখন তাঁরা বুঝলেন যে, হাত লম্বা মানে হলো দানশীলতা। দান করা ছিল আম্মা যয়নবের (রা.) প্রিয় কাজ। আম্মা খাদিজার (রা.) পর, রাসুলের (সা.) স্ত্রীদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম মারা যান।

উম্মুল মো’মেনীন সাওদা (রা.) কে বিয়ে করার মাত্র ১৫ দিন পর প্রিয় নবীজির (সা.) সঙ্গে আয়েশার বাগদান হয়। কিন্তু বাগদানের পর আরো তিন বছর আয়শা (রা.) বাবার গৃহেই ছিলেন। এ তিন বছর আম্মা সাওদা (রা.) রাসুলের (সা.) একমাত্র স্ত্রী হিসেবে সংসার দেখাশোনা করেন। আয়েশা (রা.) যখন নবীজির সংসারে আসেন তখনও বয়স কম হওয়ার কারণে সংসারের কাজকর্ম কিছুই বুঝতেন না। আম্মা সাওদা (রা.) তাকে সাংসারিক কাজকর্মে প্রশিক্ষিত করে তোলেন ও সর্ববিষয়ে পরামর্শ ও সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। আম্মা সাওদা (রা.) ও আম্মা আয়শা (রা.) এর বয়সের মধ্যে বলতে গেলে আকাশ-পাতাল তফাৎ ছিল। তবুও সুসম্পর্কের কারণে তাদের মধ্যে সরস মধুর ব্যবহার ও হাসি-ঠাট্টার অবতারণা হতো, যাতে রাসুল (সা.) এর সংসারে অনাবিল খুশির ধারা বয়ে যেত। তাই আম্মা সাওদা (রা.) সম্পর্কে আম্মা আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘আমি শুধু একজন নারীর কথাই জানি, যার অন্তরে হিংসার ছোঁয়া মোটেই পড়েনি, আর তিনি হলেন সাওদা।’ গৃহস্থালী কাজের বেশিরভাগ বিষয় আম্মা সাওদা (রা.) ছিলেন আয়েশার (রা.) বান্ধবী। আম্মা আয়েশা (রা.) বলেন, “সাওদা ছাড়া আর অন্য কোনো নারীকে দেখে আমার এমন মনে হয় নি যে, তার শরীরে যদি আমার প্রাণটি হতো।”

নবীজির পবিত্র সাহচর্য লাভের ফলে আম্মা সাওদা (রা.) এর মাঝে উদারতা এবং দানশীলতার অপরূপ সমন্বয় ঘটেছিল। নবীজি (সা.) এর মতো আম্মা সাওদা (রা.) এর মনও দয়ায় ভরপুর ছিল।

রাসুল (সা.) এর ওফাতের পর, তখন ওমর (রা.) এর শাসনকাল। একদিন ওমর (রা.) এক বাহককে দিয়ে আম্মা সাওদা (রা.) এর জন্য একটি থলে পাঠালেন। থলেটি ছিল দিরহামে ভরা। তিনি বাহককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘থলেতে কি আছে?’ উত্তরে বাহক বললেন, ‘দিরহাম’। আম্মা সাওদা (রা.) বললেন, “থলেটি দেখতে ঠিক খেজুরের থলের মতো। খেজুরের থলেতে কি দিরহাম থাকতে পারে?” এ কথা বলে তিনি খেজুরের মতো সব দিরহাম অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। তিনি নবীজির খুব অনুগত ছিলেন এবং তাঁর কথামতো সব কাজ করতেন।

আম্মা সাওদা (রা.) খুব সরল একজন মানুষ ছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁর অনেক সরলতাপূর্ণ কথায় আল্লাহর রাসুল (সা.) হেসে দিতেন। একদিন তিনি আল্লাহর রাসুলকে (সা.) বলেন, কাল রাতে আমি আপনার সাথে সালাহ কায়েম করেছি। আপনি এত দীর্ঘ সময় রুকুতে ছিলেন যে, আমার মনে হচ্ছিল আমার নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করছে। এই কারণে দীর্ঘক্ষণ আমি নাক চেপে ধরে রেখেছিলাম। এই কথা শুনে রাসুল (সা.) মৃদু হাসলেন।

আম্মা সাওদার (রা.) সন্তান-সন্ততির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নি। তবে রসুলের (রা.) সাথে তাঁর বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তান হয় নি। তাঁর প্রথম স্বামী সাকরানের পক্ষের একটি ছেলে ছিল যার নাম আবদুর রহমান, তিনি ৬৩৭ সনে জালুলার যুদ্ধে শহীদ হন। রসুলাল্লাহর (রা.) ওফাতের পর তিনি উম্মুল মো’মেনীন হিসাবে যে ভাতা বায়তুল মাল থেকে পেতেন সেটি তিনি দান করে দিতেন। একটা পর্যায়ে তিনি নিজের বাড়িটিও বিক্রি করে দেন। প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রা.) তাঁর মদিনার বাড়িটি সেই যুগে ১,৮০,০০০ দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করে নেন। ৬৭৪ খ্রি. সনের সেপ্টেম্বর কি অক্টোবর মাসে তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...