মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে:
বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দ:) বোলেছেন, আখেরী যামানায় বিরাট বাহনে চোড়ে এক চক্ষুবিশিষ্ট মহাশক্তিধর এক দানব পৃথিবীতে আবির্ভূত হবে; তার নাম দাজ্জাল। বিশ্বনবী বর্ণিত সেই ভয়ঙ্কর একচোখা দানব ‘দাজ্জাল’ এসে গেছে! আল্লাহর অশেষ করুণায় হেযবুত তওহীদের এমাম, এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী সেই দাজ্জালকে চিহ্নিত কোরেছেন। তিনি রসুলাল্লাহ (দ:) হাদিস থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ কোরেছেন যে, পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ইহুদি খ্রিস্টান যান্ত্রিক ‘সভ্যতা’ই হোচ্ছে বিশ্বনবী বর্ণিত সেই দাজ্জাল, যে দানব ৪৭৬ বছর আগেই জন্ম নিয়ে তার শৈশব, কৈশোর পার হোয়ে বর্তমানে যৌবনে উপনীত হোয়েছে এবং দোর্দণ্ড প্রতাপে সারা পৃথিবীকে পদদলিত কোরে চোলেছে; আজ মোসলেমসহ সমস্ত পৃথিবী অর্থাৎ মানবজাতি তাকে প্রভু বোলে মেনে নিয়ে তার পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে।
দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহর রসুল বোলেছেন নুহ (আঃ) থেকে শুরু কোরে আল্লাহর এমন কোন নবী হন নি যিনি তাঁর উম্মাহকে, অনুসারীদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক কোরে যান নি। আমিও তোমাদের দাজ্জাল সম্পর্কে সাবধান কোরছি। [আবু ওবায়দা বিন যাররাহ (রাঃ) থেকে তিরমিযি, আবু দাউদ]
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হোচ্ছে এই যে, দাজ্জালের আবির্ভাব মানবজাতির জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও বড় ঘটনা হবার কথায় মহানবী বোললেন, আদম (আঃ) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত, কিন্তু সতর্কবাণী দেবার কথায় বোললেন, আদমের (আঃ) বহু পরে নুহ (আঃ) থেকে তাঁর পরবর্তী নবীদের ও তাঁদের উম্মাহদের। অর্থাৎ আদম (আঃ) থেকে নুহের (আঃ) আগে পর্যন্ত যে সব নবী-রসুল (আঃ) এসেছেন তারা তাঁদের উম্মাহদের দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেন নি। ধরে নেয়া যায় যে, প্রয়োজন ছিলো না, নইলে তারা অবশ্যই তা কোরতেন।
প্রশ্ন হোচ্ছে নুহের (আঃ) আগে পর্যন্ত দাজ্জাল সম্বন্ধে মানুষকে সতর্ক করার প্রয়োজন কেন ছিলো না এবং নুহের (আঃ) সময় থেকে সেটার প্রয়োজন কেন আরম্ভ হোল?
এ প্রশ্নের উত্তর আল্লাহই জানেন, তবে আমি যা বুঝি তা হোচ্ছে এই যে, মানবজাতির ইতিহাসকে দুইটি প্রধান ভাগে বা পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগটি আদম (আঃ) থেকে নুহের (আঃ) ঠিক আগে পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ভাগটি নুহ (আঃ) থেকে শুরু কোরে আজও চোলছে। নুহের (আঃ) সময়ে মহাপ্লাবন হোয়ে মানুষসহ সমস্ত পৃথিবীর প্রাণী ধ্বংস হোয়ে যেয়ে নুহ (আঃ) থেকে মানবজাতি আবার আরম্ভ হওয়ায় নুহের (আঃ) এক নাম আদমে সানী অর্থাৎ দ্বিতীয় আদম। নুহ (আঃ) থেকে বনি আদমের, মানুষ জাতির জীবনের, ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব আরম্ভ হোল। কোর’আনে আমরা আদমের (আঃ) পর থেকে নুহ (আঃ) পর্যন্ত কোন নবী-রসুলের নাম পাই না। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, ঐ সময়ের মধ্যে কোন নবী রসুল আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান নি; অবশ্যই তিনি পাঠিয়েছেন এবং বহু সংখ্যায় পাঠিয়েছেন। কারণ এক লাখ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসুলের মধ্যে কোর’আনে আমরা নাম পাই মাত্র জনাত্রিশেক। বাকিরা কোথায়? কবে এসেছেন? কোরআনে আল্লাহও বোলেছেন- আমি পৃথিবীর প্রতি জনপদে, লোকালয়ে আমার নবী পাঠিয়েছি (কোরআন- সুরা ইউনুস, আয়াত ৪৭, সুরা নহ্ল, আয়াত ৩৬, সুরা রা’দ, আয়াত ৭)। এও বোলেছেন- তাদের (পূর্ববর্তী নবী-রসুলদের) কতকের সম্বন্ধে তোমাকে [মোহাম্মদকে (দঃ)] জানালাম, কতকের সম্বন্ধে জানালাম না (কোরআন- সুরা মো’মেন, আয়াত ৭৮)। এই যে মাত্র ত্রিশ জনের মত নবী-রসুলদের নাম আল্লাহ তাঁর শেষ নবীর মাধ্যমে আমাদের জানালেন, তারা সবাই নুহের (আঃ) পর, তাঁর আগের নয়। তার মানে নুহের (আঃ) আগে মানবজাতির মধ্যে বিরাট সংখ্যার নবী-রসুল প্রেরিত হোয়েছেন যাদের নাম এবং কে পৃথিবীর কোথায়, কোন্ জাতি, কোন্ জনপদে প্রেরিত হোয়েছেন তা আমাদের জানা নেই।
হিন্দু শাস্ত্রে মানবজাতির জীবনের আয়ুষ্কালকে চারটি ভাগে ভাগ করা হোয়েছে এবং ভাগগুলিকে এক একটি যুগ বলা হোয়েছে। প্রথম যুগের নাম সত্য যুগ, দ্বিতীয় যুগের নাম ত্রেতা যুগ, তৃতীয় যুগের নাম দ্বাপর যুগ ও চতুর্থ যুগের নাম কলি যুগ এবং তার পরই অর্থাৎ কলি যুগ শেষ হোলেই মহাপ্রলয় অর্থাৎ কেয়ামত হোয়ে মানুষ, পৃথিবী সবই শেষ হোয়ে যাবে। ঐ ধর্মমতে সত্যযুগে সত্য ও মিথ্যার সংঘর্ষ হোলে শতকরা একশ’ বারই সত্য জয়ী হতো, মিথ্যা পরাজিত হতো; ত্রেতা যুগে সত্য ও মিথ্যার সংঘর্ষ হোলে শতকরা পঞ্চাশবার সত্য জয়ী এবং শতকরা পঞ্চাশবার মিথ্যা জয়ী হতো, দ্বাপর যুগে ঐ রকম সংঘর্ষ হোলে মিথ্যা শতকরা পঁচাত্তর বার জয়ী, সত্য পঁচিশবার জয়ী ও শেষ কলিযুগে সত্য-মিথ্যার সংঘর্ষে মিথ্যা শতকরা একশ’ বারই জয়ী ও সত্য একশ’ বারই পরাজিত হবে। এখানে একটি কথা প্রাসঙ্গিক, তা হোল-
প্রকৃতপক্ষে হিন্দু বোলে কোন ধর্ম বা
হিন্দু শাস্ত্র বোলে কোন শাস্ত্র পৃথিবীতে নেই।
বেদ, উপনিষদ, গীতায়, পুরাণে কোথাও হিন্দু শব্দই নেই। শব্দটি এশিয়া মাইনর, খুব সম্ভব তুর্কী দেশ থেকে এসেছে সিন্ধু শব্দের অপভ্রংশ হিসাবে। উপমহাদেশে প্রচলিত এই ধর্মের প্রকৃত নাম সনাতন ধর্ম, কোরআনে যেটাকে বলা হোয়েছে দীনুল কাইয়্যেমা, শাশ্বত, চিরন্তন ধর্ম, অর্থাৎ তওহীদ। (কোরআন- সুরা রূম, আয়াত ৪৩, সুরা বাইয়্যেনা, আয়াত ৫)। এটা একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার যে, হিন্দু ধর্মের আবাসভূমি এই ভারত উপমহাদেশ থেকে বহু দূরে গ্রীক ও রোমানদের প্রাচীন ধর্মেও মানবজাতির আয়ুষ্কালকে চার ভাগে ভাগ করা হোয়েছে। প্রথমটি স্বর্ণ যুগ, দ্বিতীয়টি রৌপ্য যুগ, তৃতীয়টি তাম্র যুগ ও শেষটি লৌহ যুগ। মোটামুটি হিন্দু ধর্মের বিভাগের অনুরূপ। ইসলাম ধর্মে ঠিক অমন পরিষ্কার যুগ বিভাগ না থাকলেও বর্তমান সময় যে শেষ যুগ অর্থাৎ আখেরী যমানা তা সর্বত্র গৃহীত এবং মহানবীর বিভিন্ন হাদিস দিয়ে সমর্থিত। সনাতন ধর্মমতে সত্য যুগে মানুষের আয়ু ছিলো এক লক্ষ বছর, ত্রেতা যুগে দশ হাজার বছর, দ্বাপরে দুই হাজার এবং কলি যুগে অর্থাৎ বর্তমানে একশ’ বিশ বছর। মনে হয় এটা গড়পড়তা আয়ু ছিলো না, ঊর্দ্ধতম আয়ু ছিলো কারণ বর্তমান কলি যুগে মানুষ ঊর্দ্ধতম একশ’ বিশ বছরের মতো বাঁচে দেখা যাচ্ছে।
যা হোক, এখন প্রশ্ন হোচ্ছে নুহ (আঃ) কোন্ যুগের নবী ছিলেন?
কতকগুলি কারণ থেকে আমার মনে হয় তিনি দ্বাপর যুগে জন্মেছিলেন। কোরআনে আল্লাহ বোলেছেনÑ নুহ নয়শ’ পঞ্চাশ বছর তাঁর জাতির মধ্যে ছিলেন (কোরআন- সুরা আন্কাবুত, আয়াত ১৪)। আল্লাহ এখানে শব্দ ব্যবহার কোরেছেন ‘নাকেশ’ অর্থাৎ তাঁর জাতির মধ্যে ছিলেন। এখানে স্পষ্ট নয় যে নুহ (আঃ) তাঁর জাতির মধ্যে মোট সাড়ে নয়শ’ বছর ছিলেন, নাকি নবুয়াত পাবার পর সাড়ে নয়শ’ বছর তাঁর জাতির মধ্যে তওহীদ প্রচার কোরে ব্যর্থ হোয়েছিলেন। যদি ধোরে নেই যে, তিনি তওহীদ প্রচার কোরেছেন সাড়ে নয়শ’ বছর তবে অন্তত আরও চার পাঁচশ’ বছর ওর সাথে যোগ কোরতে হবে, কারণ অবশ্যই তিনি জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবুয়াত পান নি, একটা পরিণত বয়সে পেয়েছেন; অর্থাৎ এই দাঁড়ায় যে, মহাপ্লাবনের সময় তাঁর বয়স ছিলো চৌদ্দশ’ বা পনেরশ’ বছর। তারপর মহাপ্লাবনের পর তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীদের মাঝেও তিনি বেশ কিছুকাল বেঁচেছিলেন। অর্থাৎ মোট দু’হাজার বছরের কাছাকাছি। আর যদি ধরে নেই যে, তিনি তাঁর জাতির মধ্যে মোট সাড়ে নয়শ’ বছর ছিলেন এবং তারপর মহাপ্লাবন হোল, তাহোলেও তিনি প্লাবনোত্তর যে সময়টা তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কাটালেন সেটা যদি তিন, চার বা পাঁচশ’ বছর হোয়ে থাকে তা হোলেও সেই দু’হাজার বছরের কাছাকাছিই যাচ্ছে। দ্বাপর যুগের মানুষের ঊর্দ্ধতম আয়ু ছিলো দেড় দু’হাজার বছর। তাই আমি নুহকে (আঃ) দ্বাপর যুগের নবী মনে কোরি।
এবার আসা যাক দাজ্জালের আবির্ভাবের ও সে সম্বন্ধে সতর্কীকরণের কাজ নুহ (আঃ) থেকে আরম্ভ হবার কারণে।
এর কারণ হোল সত্য ও ত্রেতা যুগে দাজ্জালের জন্মের সম্ভাবনাই ছিলো না। কারণ সত্য ও মিথ্যার যুদ্ধে সত্য যুগে শতকরা একশ’ বার ও ত্রেতা যুগে শতকরা পঞ্চাশ বারই সত্যের যেখানে জয় হতো সেখানে দাজ্জালের জন্মের সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ মূলতঃ দাজ্জাল হোচ্ছে চাকচিক্যময় প্রতারক যাকে আল্লাহর রসুল কায্যাব অর্থাৎ মিথ্যা, মিথ্যাবাদী বোলে আমাদের সঙ্গে পরিচয় কোরিয়ে দিয়েছেন। দ্বাপর যুগে অর্থাৎ নুহের (আঃ) সময় থেকে আরম্ভ হোল দাজ্জালের মতো একটি মিথ্যার আবির্ভাবের সম্ভাবনা, কারণ এই যুগে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে জয় পরাজয়ের অনুপাত হোয়ে দাঁড়ালো শতকরা পঁচাত্তর বার মিথ্যার জয়। তাই নুহ (আঃ) থেকেই আরম্ভ হোল প্রত্যেক নবীর দাজ্জালের আবির্ভাব সম্বন্ধে সতর্কবাণী, যদিও প্রকৃতপক্ষে দাজ্জালের জন্ম হবে ঘোর কলিযুগে, বর্তমানে, তবুও যেহেতু শতকরা পঁচাত্তর ভাগ মিথ্যার জয়ের সময় আরম্ভ হোল দ্বাপর যুগ থেকে, কাজেই তখন থেকেই নবী রসুলদের সতর্কবাণীও শুরু হোল।
বন্দি শৃঙ্খলিত দাজ্জাল প্রসঙ্গ
বিশ্বনবীর যেসব হাদিসে আমরা দাজ্জালের বন্দি হোয়ে থাকার ও যথাসময়ে প্রকাশ হবার কথা পাই সেগুলির প্রকৃত অর্থ এটাই; তখনকার দিনের মানুষকে রূপক অর্থে বলা। কোন অজানা দ্বীপে দাজ্জাল শৃংখলিত হোয়ে থাকাটা তার ঐ সম্ভাবনার কথাই রূপকভাবে বর্ণিত। আদম (আঃ) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত অর্থাৎ মানবজাতির সম্পূর্ণ আয়ুষ্কালের মধ্যে সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হোলেও দাজ্জাল সম্পর্কে সাবধানবাণী আদমের (আঃ) অনেক পরে নুহ (আঃ) থেকে আরম্ভ কেন হোল তার কারণ এই। অর্থাৎ নুহের (আঃ) আগে সত্য ও ত্রেতা যুগে দাজ্জালের মতো এতবড় মিথ্যার প্রকাশ ও তার পৃথিবীকে পদানত করার কোন সম্ভাবনা ছিলো না।
[দাজ্জাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী রচিত ‘দাজ্জাল? ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’! বইটি সংগ্রহ কোরুন।