কিছুদিন আগে (অক্টোবর ২০২১) গোপনে নতুন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে চীন। আর পরমাণু অস্ত্র বহনক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার পর দূরপাল্লার ঘাতক বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে ভারত। কয়েক বছর আগে উত্তর কোরিয়া তাদের পঞ্চম পারমাণবিক বোমাটির পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। পূর্বের বোমাটির পরীক্ষার পর উত্তর কোরিয়া ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা আমেরিকাকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দিতে সক্ষম। এমন প্রায় পঞ্চাশ হাজার বোমা বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তিগুলো মজুদ করে বসে আছে। এদিকে চলছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মহড়া। যে কোনো সময় যে কোনো পরাশক্তি হঠকারিতা করে বা যান্ত্রিক ত্রুটির দরুন বা আত্মরক্ষার জন্য প্রতিপক্ষের উপর এই পরমাণু বোমার ব্যবহার করতে পারে। এটা একটি সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এমন সিদ্ধান্ত যে মানুষ নিতে পারে তার উদাহরণ আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে দেখেছি।
আফ্রিকা জুড়ে যুদ্ধ-রক্তপাত, দুর্ভিক্ষ। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে রক্তের বন্যা, প্রায় প্রতিটি দেশে কোথাও না কোথাও সহিংস হামলা বা বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে। সেখানকার কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা প্রায় শতভাগই মুসলিম। সমস্ত দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ভয় আতঙ্ক ত্রাস। এখানে ওখানে চলছে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি হামলা। সমস্ত ইউরোপ জুড়ে বেকারত্ব, বর্ণবাদী বিক্ষোভ, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, উদ্বাস্তু সংকট, জঙ্গি হামলা, খুন।
পৃথিবীর মানুষ আজ বিক্ষুদ্ধ। বাইরে যত সফলতার অহংকার থাকুক মনের গভীরে মানুষ আজ দেউলিয়া, দিশাহারা। যে কোন দিনের সংবাদপত্র খুলুন, দেখবেন পৃথিবীময় অশান্তি, ক্রোধ, রক্তারক্তি, অন্যায়, অবিচার আর হাহাকারের বর্ণনা। রাষ্ট্রগত ভাবে যুদ্ধ, দলগত ভাবে হানাহানি, ব্যক্তিগতভাবে সংঘাত আর রক্তারক্তির হৃদয়বিদারী বর্ণনা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে, বিশেষ করে যে সব দেশ এই যান্ত্রিক সভ্যতাকে গ্রহণ করেছে, সে গুলোতে প্রতি বছর খুন, যখম, ডাকাতি, ধর্ষণ, বোমাবাজি আর অপহরণের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। এমন কি বেগুনাহ, নিষ্পাপ শিশুরা পর্য্যন্ত এই মানুষরূপী শয়তানদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এক দিক দিয়ে মানুষ যেমন বিজ্ঞানের শিখরে উঠছে অন্য দিক দিয়ে ঠিক তেমনি ভাবে সে সব রকমের অন্যায়ের চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে। মানুষের আত্মা আজ ত্রাহী সুরে চিৎকার কোরছে কেন? কেন মানুষ তার জ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রগতিকে মনুষ্যত্বের উন্নতির পরিবর্তে তাকে অবনতির গভীর অতলে নিয়ে যাচ্ছে? তার যে অতীত ইতিহাসের দিকে মানুষ কৃপার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে তার যে কোন বিশেষ মুহূর্ত আজকের যে কোন বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে তুলনা করলে সে দেখবে যে, মানুষ হিসাবে সে বর্তমানে কত নিচুতে নেমে গেছে। বেশী দূর যেতে হবে না, শুধু এই বিংশ শতাব্দীতে সে যত মানুষের প্রাণ হত্যা করেছে, গত দশ শতাব্দীর সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহে তার ভগ্নাংশও করে নি। শুধু হত্যা নয়, অন্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে তার পূর্ব পুরুষদের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। আত্মার এই নিদারুণ পতনের সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রযুক্তির (Technology) ধ্বংসকারী শক্তির যোগের পরিণতি চিন্তা করে মানুষ আজ শিউরে উঠছে।
মানুষ আজ যে সভ্যতার বড়াই কোরছে সত্যি কি এটা সভ্যতা? আমি বলবো, না, এটা সভ্যতা নয়। এটা আত্মাহীন বিবেকহীন একটা যান্ত্রিক প্রগতি মাত্র, যে প্রগতি মানুষকে যত সে যান্ত্রিকভাবে এগুচ্ছে, তত তাকে মানুষ হিসাবে টেনে নিচে নামাচ্ছে- তাকে কিছুতেই আর যাই হোক সভ্যতা বলে আখ্যা দেয়া যায় না। এই যান্ত্রিক প্রগতি সে এত দূরে নিয়ে গেছে যে, ইতিমধ্যেই তার হাতে আজ যে পারমাণবিক (Nuclear) অস্ত্র জমেছে তা দিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটাকে ভেঙ্গে দেয়া যায়।
আজ পৃথিবীর চারদিক থেকে আর্ত মানুষের হাহাকার উঠছে- শান্তি চাই, শান্তি চাই। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের উপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের উপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের উপর ধুর্তের বঞ্চনায়, পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নিরপরাধ ও শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। এ অবস্থা বিনা কারণে হয় নি। অন্য কোন গ্রহ থেকে কেউ এসে পৃথিবীতে এ অবস্থা সৃষ্টি করে নি। মানুষ নিজেই এই অবস্থার স্রষ্টা। তাই পৃথিবীতে শান্তির জন্য এত চেচামেচি, এত লেখা, এত কথা, এত শান্তির প্রচার- কিছুই হচ্ছে না। শুধু হচ্ছে না নয়, সমস্ত রকম পরিসংখ্যান (Statistics) বলে দিচ্ছে যে, একমাত্র যান্ত্রিক উন্নতি ছাড়া আর সমস্ত দিক দিয়ে মানুষ অবনতির পথে যাচ্ছে- এবং দ্রুত যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে বরং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এমন কোন দেশ নেই যেখানে অপরাধের সংখ্যা কমছে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা।
সমস্ত মানবজাতি এক আত্মাহীন স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী সভ্যতার কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করেছে। সর্বত্র মিথ্যার জয়জয়কার। সত্যের লেশমাত্রও নেই। সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্য শতভাগ পরাজিত। পুঁজিবাদী অর্থনীতির জটিল হিসাব নিকাশ দিয়ে বুভুক্ষ কৃষক শ্রমিক জনতার অর্থ পাচার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবু মানবজাতি মোহাবিষ্ট হয়ে আগুনের অভিমুখে পতঙ্গের মতো চাকচিক্যময় ভোগবাদী বস্তুবাদী সভ্যতার পিছনে ছুটছে।
এ সময়টির কথাই দাজ্জালের রূপক ব্যবহার করে রসুলাল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আখেরী যামানায় বিরাট বাহনে চড়ে এক চক্ষুবিশিষ্ট মহাশক্তিধর এক দানব পৃথিবীতে আবির্ভূত হবে; তার নাম দাজ্জাল। সে আল্লাহর বদলে নিজেকে মানবজাতির প্রভু (রব) বলে দাবী করবে (বোখারী)। বর্তমানে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী আসুরিক শক্তিবলে সমগ্র মানবজাতির প্রভুত্ব অর্জন করেছে এবং তার আদেশে ইচ্ছা হোক বা অনিচ্ছায় সমগ্র মানবজাতি চলতে বাধ্য হচ্ছে।
রসুলাল্লাহ বলেছেন, দাজ্জালের সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের মত দুইটি জিনিস থাকবে। সে যেটাকে জান্নাত বলবে সেটা আসলে হবে জাহান্নাম, আর যেটাকে জাহান্নাম বলবে সেটা আসলে হবে জান্নাত। যারা তাকে প্রভু বলে মেনে নেবে তাদেরকে সে তার জান্নাতে স্থান দেবে (বোখারী, মুসলিম)। বস্তুবাদী সভ্যতার বাণীবৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে, তার প্রযুক্তি আর চাকচিক্যে মোহিত হয়ে মানবজাতি তাকে বরণ করে নিয়েছে কিন্তু পরিণতিতে সে কী নিদারুণ অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ও রক্তপাতে নিমজ্জিত হয়েছে তার আংশিক বিবরণ উপরে দিয়ে এসেছি।
রসুলাল্লাহ বলেছেন, তার কাছে রেযেকের বিশাল ভাণ্ডার থাকবে। যারা তাকে রব বলে মেনে নেবে তাদেরকে সে সেখান থেকে দান করবে। আর যারা তাকে রব বলে অস্বীকার করবে, অর্থাৎ তার আদেশমত চলবে না, তাদের সে তার ভাণ্ডার থেকে দান তো করবেই না বরং তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) ও অবরোধ (Embargo) আরোপ করবে। তার পদতলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের করুণ পরিণতি নেমে আসবে (বোখারী, মুসলিম)।
মহানবী এই দাজ্জালের আবির্ভাবকে আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুতর ও সাংঘাতিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করেছেন (মুসলিম), শুধু তা-ই নয়, এর মহাবিপদ থেকে তিনি নিজে আল্লাহর কাছে পানাহ (আশ্রয়) চেয়েছেন (বোখারী)।
বাইবেলেও দাজ্জালের কথা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। সেখানে তাকে পশু (The Beas.), মিথ্যা নবী (False Messiah), প্রতারক (Deceiver), যিশুবিরোধী (Anti-Chris.), মিথ্যাবাদী (The Lier) ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মেও দাজ্জালের ‘কানা’ হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে, বলা হয়েছে ‘অন্ধক আসুর’। ‘আসুর’ অর্থ পরে আগমনকারী এবং ‘অন্ধক’ অর্থ অন্ধের মতো। হরিবংশ পুরাণে অন্ধক আসুরের বা দাজ্জালের বিষদ বিবরণ রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে “তার একহাজার হাত (সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশালী), হাজার মাথা (বেশি বুদ্ধিশুদ্ধি), দু হাজার পা (ভূ-পৃষ্ঠের সর্বত্র অনায়াসে চলার ক্ষমতা), দু হাজার চোখ (সর্বোচ্চ দৃষ্টিক্ষমতাসম্পন্ন) থাকা সত্ত্বেও সেই শয়তান নিজের অহংকারের কারণে অন্ধের মতো চলছিল। সে জন্য সে ‘অন্ধক আসুর’ নামে আখ্যাত হয়েছে।
বর্তমান যুগটিকে সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে ঘোরকলি, ইসলামে বলা হয়েছে আখেরি যামানা, বাইবেলে বলা হয়েছে The Last Hour যা চরম অন্যায় অশান্তিতে, পাপে পঙ্কিলতায় পূর্ণ থাকবে।
আজ সময় হয়েছে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সকল নবী রসুলদের ভবিষ্যদ্বাণীকৃত এই দাজ্জালকে চিহ্নিত করা। এই পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা চায় বিত্ত, ন্যায়-অন্যায় তাদের বিবেচ্য নয়। ২০১৬ সালে অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে বিশ্বজুড়ে সম্পদগত বৈষম্য বেড়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সহায়তা সংস্থা অক্সফাম প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিশ্ব-জনসংখ্যার দরিদ্রতম অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ কুক্ষিগত রয়েছে মাত্র ৮ জন ধনী ব্যক্তির হাতে। তাদের কোনো ধর্ম নাই, কোন মানবতাবোধ নাই। তারা চায় যুদ্ধ আর নতুন নতুন রণক্ষেত্র। নতুন নতুন মারণাস্ত্র তারা উদ্ভাবন করছে মানুষ হত্যার জন্য, সেগুলো বিক্রি করার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ বাঁধানো। কত দেশ ধ্বংস হলো, কত মানুষ খুন হলো, কত মানুষ উদ্বাস্তু হলো সেটা তাদের চিন্তার কোন বিষয় না। কারণ তারা তো বহু আগেই মানুষের সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে গেছে।
এই পশ্চিমা বস্তুবাদী ধর্মহীন ‘সভ্যতা’-কে দাজ্জাল হিসাবে প্রমাণ করেছেন করেছেন মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তিনি এ বিষয়ে বই লিখেছেন যা ২০০৮ সনে বাংলাদেশে বেস্ট সেলার হয়েছিল। কিন্তু এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী মানুষকে এই দাজ্জালকে চিনতে দেয় নি। তারা অপেক্ষা করে আছে সেই এক চক্ষু দানবের যে বিরাট ঘোড়ায় চড়ে আসবে। মানুষকেও তারা সেই অপেক্ষায় বসিয়ে রেখেছেন। অথচ সকল নবী-রসুল-অবতারদের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই দাজ্জাল ৪৮৪ বছর আগেই জন্ম নিয়ে তার শৈশব কৈশোর পার হয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে সারা পৃথিবীকে পদানত করে রেখেছে। এটাকেই আল্লাহর রসুল বলেছেন যে দুনিয়াটিকে একটি চামড়ার বলের ন্যায় আবৃত করে রাখবে। এই দানবের অত্যাচারে মুসলিম জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষ গত শতাব্দীর দুটো বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, আর এই শতাব্দীতেই কয়েক মিলিয়ন মানুষকে সেই দানব হত্যা করেছে। কতগুলো মুসলিম প্রধান দেশকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। এখন মানবজাতির প্রথম কাজই হচ্ছে এই ভয়াবহ শত্রুকে সঠিকভাবে চেনা এবং একে প্রতিরোধ করা, দাজ্জালের মোহময় প্রতারণার দর্শন ত্যাগ করে ন্যায় ও সত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর।