কাজী আবদাল্লাহ আল মাহফুজ:
—————————-
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ! কথাটা শুনে অনেকেই চমকে উঠেন। আবার অনেকে এর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চান। যারা চমকে উঠেন তাদের যুক্তি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে মানবজাতির কোন অস্তিত্ব থাকবে না। আর যারা উড়িয়ে দিতে চান তাদের যুক্তি মানবজাতি এখন অনেক সভ্য, তারা এমন আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে না। অর্থাৎ উভয়ের যুক্তিতেই রয়েছে মানবজাতির ধ্বংস। উভয়েই শংকিত মানবজাতির অস্তিত্ব নিয়ে। কিন্তু যুদ্ধবাজদের কাছে মানবজাতি কোন বিষয় নয়, বিষয় শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ। আজ এসকল যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে যে পরিমাণ রাসায়নিক, পারমাণবিক ও হাইড্রোজেন বোমার মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে কয়েক মিনিটেই পৃথিবী ধ্বংস করে দেয়া যায়। তাই শত্র“কে মারলে আমিও মরব এই ভয়ই এখন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে তাদের বিরত রেখেছে। এখানে মানবতা নয়, দয়া নয়, ন্যায়ের প্রতি সম্মান নয়, অন্যায়ের প্রতি বিরূপতা নয়, কত কোটি মানুষ, শিশু, পশু নিহত হবে, এসব অনুভূতির কোন স্থান নেই। তার প্রমাণ নাগাসাকি ও হিরোশিমা। তথাপিও অনেকে বলবেন- না, না, মানুষ এমন আত্মহত্যার কাজ করবে না। কিন্তু যে দিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার আগের দিন যদি সমস্ত পৃথিবীতে একটা গণভোট নেয়া হতো যে, যুদ্ধ চাও কি চাওনা? তবে যুদ্ধের পক্ষে মানুষ কোন ভোট দিত না, দিলেও তা শূন্যের কোঠায় থাকত। এমন কি যারা পরের দিন মহাযুদ্ধ আরম্ভ করেছিল তারাও না। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কি বাঁধেনি? সেই যুদ্ধে চার কোটি মানুষ হতাহত হয় নি? তারপর সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মাত্র একুশ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের দিন যদি আবার যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট নেয়া হতো তারও ফল ঐ আগের গণভোটের মতই হত। কিন্তু তাতে কি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বন্ধ হয়েছে? হয় নি- এবং সে যুদ্ধে সাত কোটি মানুষ হতাহত হয়েছে, বিভৎসভাবে পঙ্গু হয়েছে, কোটি কোটি স্ত্রীলোক বিধবা হয়েছে, কোটি কোটি শিশু বাপ-মা হারিয়েছে, কোটি কোটি স্ত্রীলোক ধর্ষিতা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ কেমন করে যুদ্ধ আরম্ভ হলো তা লিখতে যেয়ে লিখেছেন- We all slithered into it” অর্থাৎ আমরা কেমন যেন পিছলিয়ে ওর মধ্যে পড়ে গেলাম। আর এবারও যে একইভাবে পা পিছলে পড়বে না তার কী গ্যারান্টি আছে? কোন গ্যারান্টি নেই বরং সাম্রাজ্যবাদীরা তার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে।
ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলাকালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে মানুষ কিছুদিন চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আর সেটি বিনারক্তপাতে ইতি ঘটায় বিশ্ববাসী ধরে নিয়েছিল বর্তমান সভ্যতার ভোগবাদী মানুষেরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে হয়তো তাদের ধ্বংস করতে চাইবে না। কিন্তু যুদ্ধ যাদের জীবিকা, যুদ্ধ যাদের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার তাদের পক্ষে বেশিদিন নীরব থাকা সম্ভব নয়। আবার যুদ্ধে যারা পরাজিত হয়, তাদের পক্ষেও মার খাওয়ার গ্লানি মুছে ফেলা সহজ নয়। তার প্রমাণ মিলল অল্পদিনেই। বিশেষ করে ঠাণ্ডা যুদ্ধে কমিউনিজমের পতনের পর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সামনে স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিমরা। এক ঢিলে দুই পাখি। ভবিষ্যৎ মুসলিম আধিপত্যকে রোধ করা এবং একইসাথে তেল ও খনিজ সম্পদ লুটে নেয়ার জন্য এক বছরের মধ্যে শুরু হলো উপসাগরীয় যুদ্ধ। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক এ যুদ্ধের মাধ্যমে তারা মুসলিমদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে রচিত হলো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আফগানিস্তানে জঙ্গীবাদের উত্থান এবং তা দমন। তারপর একের পর এক মুসলিম দেশে আক্রমণ ও ভিন্নভাবে সরকার পতনের মাধ্যমে চলল সেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। ধ্বংস হয়ে গেল ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া। উত্থান হলো আইএস’র। এবার আইএস নিয়ে শুরু হলো ইঁদুর বিড়াল খেলা। উঠে এলো সেই পুরনো মারখাওয়া শত্র“ রাশিয়া। মধ্যপ্রাচ্যে এই চরম অস্থিতিশীল অবস্থা পশ্চিমাবিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে আবার শুরু করে দিল আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। কারণ খুব সহজ, আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্রব্যবসা, খনিজ ও তেলসম্পদ। এ আধিপত্য বিস্তারের লড়াই এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে তরান্বিত করছে। এটা কনো অমূলক বিষয় নয়। এ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের তেমন মাথাব্যাথা না থাকলেও বিশ্বব্যাপী চলছে জল্পনা-কল্পনা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও প্রস্তুতি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গা শিউরে ওঠার মতো সংবাদ। পাঠকদের উদ্দেশে সংবাদটি তুলে ধরা হলো-
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধাবে রাশিয়া?
সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। এ যুদ্ধে ‘হাইড্রোজেন বোমা’ ও ‘কিয়ামতের বিমান’ ব্যবহার হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন ‘কেয়ামতের বিমান’ দ্রুত অভিযান-উপযোগী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু ও হাইড্রোজেন বোমার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে স্থলে থাকা নিয়ন্ত্রণ কক্ষও যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে রাশিয়ার ‘কেয়ামতের বিমান’ উড়ন্ত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসেবে কাজ করবে। আর এই বিমানগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যে এদের পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব। এ ধরনের ইলিউশিন টু-৮০ মডেলের বিমানগুলোকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ব্যবহার উপযোগী করার নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন। বিশ্বে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছেই রয়েছে এ ধরনের বিমান। যুক্তরাষ্ট্র এগুলোকে ‘কেয়ামতের বিমান’ বলে থাকে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে এরই মধ্যে বিমানগুলোর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নও সম্পন্ন হয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই যুদ্ধবিমানগুলো ২০১৫ সালের শেষের দিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। কিন্তু পুতিন দুই সপ্তাহের মধ্যে এগুলোকে প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় এমন নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাইড্রোজেন বোমার প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয় মস্কোতে।
হাইড্রোজেন বোমা কী? : পারমাণবিক বোমা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা। নক্ষত্রে যে প্রক্রিয়ায় আলোক তৈরি করে হাইড্রোজেন বোমা ঠিক সেই প্রক্রিয়ায় কাজ করে। হাইড্রোজেন বোমার ভেতরে একটি মিনি সাইজের এটমবোমাও থাকে। বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তে বোমার ভেতরে একীভবনের ক্রিয়াটি শুরু করার জন্যই একে ধরে রাখা হয়। মূল বোমাটি বিস্ফোরণের আগেই এটি বিস্ফোরিত হয়। এএন৬০২ হাইড্রোজেন বোমাকে সংক্ষিপ্তাকারে জার বোমা বা এইচ বোমা নামে ডাকা হয়। ১৯৫৩ সালে এটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়। সোভিয়েত পরমাণুবিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারভ হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার করেন। এই বোমাকে সব বোমার জনক বলে ঘোষণা করা হয়। এ বোমার প্রতি ইঙ্গিত করে ১৯৬০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রকে একহাত দেখিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ১৯৬১ সালের ৩০ অক্টোবর মেরুবৃত্তের ভেতরের দ্বীপ নোভায়া জেমলিয়ায় ৫৮ মেগাটনের এই হাইড্রোজেন বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়ে এই হাউড্রোজেন বোমাটি তিন হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল।
প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট এটমিক আর্কাইভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরমাণু বোমা যেখানে জীবাশ্ম প্রতিক্রিয়ায় কাজ করে, হাইড্রোজেন বোমা সেখানে ধ্বংসাত্মক গলন মিশ্রণ প্রতিক্রিয়া করে। পরমাণু বোমার চেয়ে যা কয়েক গুণ ক্ষতিসাধন করতে পারে। হাইড্রোজেন বোমা বিশ্বের পাঁচটি দেশের (রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন) কাছে রয়েছে।
কেয়ামত বিমান কী? : রাশিয়ার ইলিউশিন টু-৮০ বিমানকে যুক্তরাষ্ট্র ‘ডুমস ডে প্লেন’ বা ‘কেয়ামত বিমান’ বলে অভিহিত করে। রুশ বিমান গবেষণা ও প্রস্তুত প্রকল্পের মহাপরিচালক আলেকসান্দ্র কমিয়াকভ বলেন, এই বিমানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি অজেয়, একে পরাজিত করা যায় না। ভূমিতে কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হলে তা শনাক্ত এবং ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু বিমানকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে আকাশ থেকে নির্দেশ দিলে তা শনাক্ত করা খুবই কঠিন।
নিজেদের মূল কাজ স¤পর্কে কমিয়াকভ বলেন, অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও যোগাযোগটা বজায় রাখাই হচ্ছে এর প্রধান কাজ। মাটিতে থাকা অবকাঠামো যদি ধ্বংসও হয়ে যায়, তবু যেন যুদ্ধ ও পরিকল্পনা ঠিক থাকে, সেটা এখান থেকে লক্ষ্য রাখা হবে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কারা জিতবে? : তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মানবজাতির অস্তিত্ব থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউকে ডেইলি স্টারের একটি জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ২৬ শতাংশ মানুষ মনে করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে আগের দুটোর মতো যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন জয়লাভ করবে। অন্যদিকে অনেকেই মনে করে, রাশিয়া এখন ভাল্লুক। তাকে খেপিয়ে তুললে কেউ টিকবে না। ওই জরিপে আইএসকে তেলাপোকার সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে- বিশ্ব ধ্বংস হলেও তেলাপোকা টিকবে। তবে ৫৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, এ যুদ্ধে কেউই জয়ী হবে না, মানবজাতি ধ্বংস হবে।