পত্র-পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতায় বর্তমানে অহরহ যে নামটি শোনা যাচ্ছে, সেটি হলো তালেবান। তালেবান আরবি শব্দ তালেব এর বহুবচন। তালেব অর্থ ছাত্র, আর তালেবান অর্থ ছাত্ররা। দলটির এমন অদ্ভুত নামকরণের কারণ- আফগানিস্তানের এই দলটি যাত্রা শুরু করেছিল ছাত্রদেরকে নিয়ে। মাত্র ৫০ জন মাদ্রাসার ছাত্র নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। মোল্লা ওমর ছিলেন তাদের শিক্ষক ও নেতা। একজন শিক্ষক হঠাৎ করেই তার ছাত্রদেরকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন কেন- তা অগ্রপশ্চাতের ইতিহাস না জানলে বুঝতে পারা সত্যিই কঠিন। কাজেই আলোচনার শুরুতেই আফগানিস্তানের এই সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান-কাহিনীটা জেনে নেওয়া দরকার।
তালেবানের জন্ম
১৯৭৯ সাল। বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত। কমিউনিস্টপন্থী বনাম পুঁজিবাদপন্থী। কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর পুঁজিবাদের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে সোভিয়েতকে আটকানো যায়। সুযোগও এসে গেল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মস্ত এক ভুল করে ফেলল। বলা নেই কওয়া নেই আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসল। ব্যস, ধূর্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় ভয়ংকর বুদ্ধি খেলে গেল। যুক্তরাষ্ট্র দেখল- আফগানিস্তানের মানুষ প্রচণ্ড ধর্মভীরু, কট্টর ইসলামপন্থী। এই ধর্মভীরু মুসলিমদেরকে যে কোনো উপায়ে বোঝাতে হবে যে, ‘কমিউনিস্ট সোভিয়েত বাহিনী কাফের নাস্তিক এবং এদের বিরুদ্ধে প্রত্যেক মুসলিমের জেহাদ করা ফরজ।’
এমনিতেই আফগানরা যুদ্ধবাজ, তার উপর যদি ধর্মীয় অনুভূতির একটা নির্যাস জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে আফগানরা জীবনের পরোয়া করবে না, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সোভিয়েত ইউনিয়ন কঠিন বেকায়দায় পড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, জেহাদের হুজুগ উঠিয়ে দিলে অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশ থেকেও যোদ্ধা রিক্রুট করা সহজ হয়ে যাবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র সৌদি আরব, পাকিস্তান, তুরস্ক ও মিশরকে কাজে লাগাল। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে জেহাদী উন্মাদনা ছড়িয়ে দিল। পাকিস্তানের আইএসআই ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এর যৌথ প্রচেষ্টায়, পশ্চিমা বিশ্বের অর্থে, অস্ত্রে, প্রশিক্ষণে ও পরিকল্পনায় আফগানিস্তানের মাটিতে হানাদার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দশকব্যাপী এক যুদ্ধ চলল, যেটাকে জেহাদ বলা হলেও আসলে তা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছায়াযুদ্ধ। এই যুদ্ধের পশ্চাতে কয়েকটি ঘটনা ঘটল।
- সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিল।
- অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে যেসব যোদ্ধারা “জেহাদ” করার জন্য আফগানিস্তানে এসেছিল তারা বিজয়ের উল্লাস করতে করতে নিজেদের দেশে ফেরত গেল এবং জেহাদের নামে সশস্ত্র দল গঠন করে ওইসব দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরম্ভ করল। দেশে দেশে জন্ম হলো আল কায়েদার মত সশস্ত্র সংগঠন।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তান থেকে যেটা চেয়েছিল সেটা পেয়ে যেতেই আফগানিস্তান ত্যাগ করল। দেশটির পুনর্গঠনের জন্য কেউই এগিয়ে এলো না।
- আফগান জাতিগোষ্ঠীগুলো ক্ষমতা নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। অচীরেই শুরু হলো গৃহযুদ্ধ।
এরপরের আফগানিস্তান হয়ে উঠল আরও ভয়াবহ। এতদিন সোভিয়েত হানাদারদের হাতে রক্ত ঝরত আফগানিস্তানের মুসলিমদের। কিন্তু এবার কথিত জেহাদীরাই একে অপরের রক্ত ঝরাতে শুরু করল। ক্ষমতার কাড়াকাড়ি যেন থামেই না। সুগঠিত সরকারব্যবস্থা নেই। আইন কানুন নেই। বিচার নেই। দুর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি পৌঁছে গেল চরম পর্যায়ে। সাধারণ মানুষ তখন দিশেহারা। এমন সময় তালেবানরা দৃশ্যপটে আবির্ভুত হলো। মোল্লা ওমর অরাজকতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই আরম্ভ করলেন। জনপ্রিয়ও হলেন। পশতু ভাষাভাষী সুন্নিরা এবার তার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখল। বলা বাহুল্য, এই মোল্লা ওমরও ছিলেন সোভিয়েতবিরোধী যোদ্ধা। ওই যুদ্ধে চারবার আহত হন ওমর। এমনকি চোখও হারিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের ওই যুদ্ধে। যাহোক পশতুন গোত্রভিত্তিক সুন্নি তালেবানদের ক্ষমতা দ্রুত বাড়তে থাকল। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখল করে তৎকালীন বোরহানউদ্দিন রাব্বানির সরকার উৎখাত করে তালেবানী শাসন কায়েম করল।
আফগান তালেবানের শাসন কেমন ছিল?
আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান গৃহযুদ্ধকে কিছুটা স্তিমিত করলেও তাদের শাসন আরেক বিতর্কের জন্ম দেয় এবং সারা বিশ্বে প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। এই সমালোচনার শুরু হয় তালেবানদের কাবুল দখলের পর থেকেই। কাবুল দখলের দিনই তালেবানরা প্রাক্তন সোশালিস্ট রাষ্ট্রপতি ডা. নাজিবুল্লাহ ও তার ভাইকে বিনা বিচারে প্রকাশ্যে কাবুলের রাস্তায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় এবং পরে এই লাশ চারদিনের মাথায় গলিত অবস্থায় নামিয়ে আনা হয়। তালেবানের এই ধরনের কার্যকলাপ সারা বিশ্বে ভীতি ছড়িয়ে দেয়, যা পরবর্তীতে আরও বাড়তে থাকে।
তালেবানী শাসনের যে দিকগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. ইসলামের নামে জনগণের উপর জোর-জবরদস্তি চালানো। যেমন- পুরুষদেরকে দাড়ি রাখতে বাধ্য করা ও নারীদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা। কেউ অমান্য করলে চাবুকপেটা করা। ২. জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে গুরুত্ব না দেওয়া। ৩. বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়, প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেওয়া। ৪. শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা। ৫. সরাসরি নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। ৬. সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।
এক কথায় আফগান তালেবানরা ইসলামের নামে এমন কিছু নীতি, আইন ও অনুশাসন জারি করেছিল যা সারা বিশ্বে কেবল তালেবানদেরকেই সমালোচনার পাত্র বানায়নি, ইসলামকেও বিতর্কিত করে তুলেছিল।
তালেবান ও পাকিস্তান
তালেবানের এই উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না, তবে পরোক্ষ সমর্থন ছিল। মূলত তখন আফগানিস্তানের ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের হাতে, আর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিল আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য তালেবানের বিকল্প নেই। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) তার রচিত “তেল-গ্যাস: নব্য উপনিবেশবাদ” বইতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লেখেন, ‘পশতুন গোত্রভিত্তিক সুন্নি মুসলমান তালেবানরা সরাসরি পাকিস্তান সমর্থিত ছিল। এমনকি হাজার হাজার পাকিস্তানি তালেবানদের সমর্থনে কাবুল দখলের যুদ্ধে এবং পরবর্তী সকল যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। বহু পাকিস্তানি প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা এদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন।’ (পৃষ্ঠা: ৪৭) উল্লেখ্য যে, সেই নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত তালেবানের বহু উত্থান-পতন হলেও পাকিস্তানের “তালেবাননীতি”তে বিশেষ একটা পরিবর্তন আসেনি। এখনও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের তালেবানকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ও নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তালেবানের উত্থান ও বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ
এই পর্যায়ে পাঠকদের কাছ থেকে আরেকটু বাড়তি মনোযোগ দাবি করছি। কেননা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান হবার আগে ও পরে সংঘটিত ঘটনাবলির সাথে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের যে যোগসূত্র রয়েছে তা ভালোভাবে না জানলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আমরা বিচার করতে পারব না।
আমরা আগেই জেনেছি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে তাড়ানোর পর বিদেশ থেকে আসা কথিত মুজাহিদিনরা যখন নিজেদের দেশে ফেরত গেল, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারল না। রক্তের নেশা তাদেরকে পেয়ে বসল। জেহাদের জোশ আরও বেড়ে গেল, যদিও জেহাদের সঠিক আকিদাই তারা জানত না। এই আফগানফেরত যোদ্ধারা (সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০,০০০ হাজার) যার যার দেশে ফিরে ছোট ছোট দল গঠন করতে লাগলেন অথবা পূর্বে থাকা কোনো ইসলামী দলে যোগ দিয়ে তার গতিপথকে প্রভাবিত করতে লাগলেন। বিশ্বের যতদেশে মুসলিম আছে মোটামুটি সবদেশেই এমন দলের সৃষ্টি হলো। উইকিপিডিয়ার একটি অসম্পূর্ণ তালিকায় বর্তমানে সক্রিয় সশস্ত্র ইসলামী দলের নাম পাওয়া যায় ১০৪টি। তাদের উদ্দেশ্য প্রধানত ভৌগোলিক স্বাধীনতা হলেও ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রেরণাই তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছে। আফগান জেহাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম আন্দোলন। প্রথম ও দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় প্রায় তিন লক্ষ চেচেন মুসলিম। এছাড়া চীনের জিনজিয়াং প্রদেশেও আফগান ফেরত যোদ্ধারা গিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ আরম্ভ করল, যা দমন করতে গিয়ে আজও উইগুড় মুসলিমদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে চীন সরকার। এছাড়া আফগান যোদ্ধারের মধ্য থেকে দেড় হাজারের একটি দল আলজেরিয়ার সরকারবিরোধী ইসলামী কট্টরপন্থী বলে কথিতদের সাথে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রণের জন্য আলজেরিয়ায় চলে যায়। ১৯৯২-৯৮ পর্যন্ত চলমান এ গৃহযুদ্ধে প্রায় ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) লোকের প্রাণহানি হয়।
এদিকে আফগান ফেরত যোদ্ধারা মিশরে ফিরে আল-জেহাদ এবং আল জামিরার মতো সংগঠনগুলোতে যোগ দেয়। এর মধ্যে প্রায় ২০০ আরব-আমেরিকান স্পেশাল ফোর্স দ্বারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত আফগান জেহাদ ফেরত সদস্যরা নিউ ইয়র্কের নিউজার্সি এরিয়াতে ফিরে আসে। ক্রমেই আল-কায়েদা আর তালেবান একই সূত্রে সমগ্র মধ্য এশিয়ায় জেহাদের প্রতীকরূপে গড়ে ওঠে। এদের যোদ্ধারা আজারবাইজান থেকে শুরু করে চেচনিয়া, নগরনো-কারাবাগ, কিরগিজিস্তান, তাজাকিস্তান, দাগেস্তান এবং উইগুড়সহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আফগান মোজাহেদরাও কোনো না কোনো পর্যায়ে কাশ্মিরে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়লে পাক-ভারত সম্পর্ক অবনতির নিম্নধাপে পৌঁছে। (দেখুন: আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা: আফগানিস্তান হতে আমেরিকা – ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন)
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে যখন তালেবানের উত্থান ঘটল এবং তালেবানরা আফগানিস্তানে তথাকথিত ইসলামী আমিরাত কায়েম করল, তালেবানদের এই উত্থান বহিঃবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া সশস্ত্র দলগুলোকে আরও উজ্জীবিত করে তুলল। ওই দলগুলো ভাবলো- আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ আফগানিস্তানের মোল্লারা যদি যুদ্ধ করে ইসলামিক আমিরাত কায়েম করতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না? দেশে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বিশেষত, যেসব এলাকায় মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছিল, সেখানে জঙ্গিবাদী গুপ্তহামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেল। এইসব সশস্ত্র দলগুলো কেবল আদর্শিকভাবেই তালেবানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তালেবানের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও সহায়তাও পেয়েছে। বিশেষত আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের কথা বলা যায়, যিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলেছিলেন এবং তালেবানের সহায়তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলা পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তালেবান উৎখাত
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় কেঁপে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, এই হামলা চালিয়েছে আল কায়েদা। দেশটি তালেবান সরকারের কাছে আহ্বান জানায় আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে। মোল্লা ওমর তাতে অস্বীকৃতি জানান এবং তার পরোক্ষণেই যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
ভুলে গেলে চলবে না, ২০০১ সালে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ঢাকঢোল পিটিয়ে যুদ্ধ শুরু করল, সেই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর জন্ম কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছিল। দিয়েছিল আফগানিস্তানের মাটিতে। তারপর কীভাবে সেই সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল সেটাও সংক্ষেপে বলে এসেছি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিলারি ক্লিনটনের উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন- “আজকে আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।” (১ জুন, ২০১৪, ফক্স নিউজ, সিএনএন)।
সেই আল কায়েদা ও তালেবানের বিরুদ্ধে এবার যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু হলো। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা শুরু করলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তালেবান সরকারের পতন হয়। তালেবানরা পালিয়ে যায় গ্রামাঞ্চলে ও পার্বত্য দুর্গম এলাকায়। তারপর? ফিরে আসে গেরিলা রূপ নিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধ: (২০০১-২০২১)
যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই জানত তালেবানরা এত সহজে নিঃশেষ হয়ে যাবে না। কিন্তু তাই বলে তালেবানরা বিশ বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলা করে টিকে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে তালেবানের সাথে চুক্তি করে কার্যত একটি হারের লজ্জা নিয়ে নিজেদের দেশে ফেরত যেতে হবে- এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে ছিল? খুব সম্ভবত- না।
এই বিশ বছর আফগানিস্তানের তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধটি ছিল আমেরিকার দীর্ঘতম লড়াই। এই লড়াইতে ২০০১ সাল থেকে সহিংসতায় প্রত্যক্ষভাবে প্রাণ হারিয়েছে ৭১,০০০ বেসামরিক মানুষ। আফগান সৈন্য মারা গেছে ৬৬ থেকে ৬৯ হাজারের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র নেটো বাহিনীর সৈন্য নিহত হয়েছে ৩৫০০-র বেশি। এই সময় বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ৩৮০০-র বেশি কর্মী প্রাণ হারিয়েছে। তালেবান যোদ্ধা মারা গেছে ৮৪,০০০-র বেশি। এসব সহিংসতা চলাকালে অন্তত ২৭ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে অন্যান্য দেশে এবং দেশের মধ্যে আরও অন্তত ৩২ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। আফগানিস্তানে এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত মোট ব্যয় করেছে ২.২৬ লক্ষ কোটি ডলার। কিন্তু চূড়ান্তভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিজয়ী হলো নাকি তালেবান বিজয়ী হলো?
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র এত দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনা করেও আল কায়েদা ও তালেবানকে নির্মূল করতে পারেনি। বরং এই দীর্ঘ সময়ে তালেবান ও আল কায়েদা ছাড়াও আইএসের মত শক্তিশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে দৃশ্যপটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে তালেবান ও আল কায়েদার প্রভাব ও শক্তি এখন অনেক বেশি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ আর চালিয়ে যেতে চাচ্ছে না। তাদের ভিন্ন মতলব থাকতে পারে, কিন্তু খালি চোখে যা দেখা যাচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে যে উদ্দেশ্যে লড়াইটা শুরু করেছিল তা অর্জন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটি বাধ্য হয়েছে তালেবানের সাথে শান্তিচুক্তি করতে। চুক্তি মোতাবেক আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার কার্যক্রম চলছে, যা কিছুদিনের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছিল তা অর্জন না করেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে, যাকে অনেকে পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করতেই পারেন।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করছে, তখন আফগানিস্তানে বইছে তালেবানের উত্থান ঝড়। ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানের প্রায় আশি শতাংশ এলাকা তালেবান দখল করে নিয়েছে। কাবুলের আশরাফ ঘানির সরকারের অবস্থা এখন ১৯৯৬ সালের কাবুলের বোরহানুদ্দিন সরকারের মত। যে কোনো সময় তালেবান কাবুলের দখল নিয়ে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে পারে। আর তা করলে ২০২১ সালের আফগানিস্তান ফেরত যাবে সেই জায়গায়, যেখানে তারা ২০০১ সালে ছিল। এটিকে তালেবানরা বিরাট বিজয় হিসেবেই দেখতে চাচ্ছে।
তালেবানের পুরুত্থান: আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের গতিবিধি দেখে ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসারণের পর এবারের তালেবানী উত্থানকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার পথেই হাঁটছে অন্যান্য দেশগুলো। কিন্তু সেই পুরোনো দুশ্চিন্তা থাকছেই। যেভাবে বিশ বছর আগে আফগানিস্তানের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটছিল এবং আফগানিস্তান বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছিল, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি আবারও ফেরত আসবে কিনা। তালেবানের পক্ষ থেকে যদিও বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তারা বৈদেশিক কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে চায় না, তবে সেটায় আস্থা রাখা মুশকিল। চীনের দুশ্চিন্তা হলো- তালেবানদের সহযোগিতা পেয়ে উইঘুর বিদ্রোহীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তা- আল কায়েদা ও আইএস এর ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান। তবে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ভুগছে সম্ভবত ভারত। তার যৌক্তিক কারণও আছে। আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের রয়েছে গভীর বন্ধুত্ব, যার অর্থ তালেবানের সাথে শত্রুতা। কাজেই তালেবানরা ক্ষমতায় এলে ভারতের সাথে সম্পর্কটা সুখকর হওয়ার কথা নয়।
ভারত চেয়েছিল আফগান সরকারের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানকে কোনঠাসা করে রাখতে। সেজন্য ভারত আফগানিস্তানের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অন্তত ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল, যার পুরোটাই হারাতে হবে যদি তালেবানরা আফগানিস্তানের দখল নেয়। তবে তারচেয়েও বড় আশঙ্কার বিষয় হলো- আফগানিস্তান ভূখণ্ডটি চলে যাবে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই মূলত তালেবানের সাম্প্রতিক উত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে। সুতরাং ভারত আশঙ্কা করছে, আফগানিস্তানের দখল তালেবানের হাতে গেলে পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে নতুন খেলা শুরু করবে। কাশ্মীর সীমান্তে তালেবানকে ব্যবহার করে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যা পুরো ভারতকেই উত্তপ্ত করে তুলবে।
বাংলাদেশের ভাবনা কী?
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে-
- পাকিস্তান যে আফগানিস্তানের তালেবানকে ব্যবহার করে ভারতে গোলোযোগ বাধানোর চেষ্টা করবে এটা অমূলক নয়। সেই উত্তাপের আঁচ ভারত দ্বারা বেষ্টিত ১৬ কোটি মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্র বাংলাদেশেও পড়তে পারে।
- অতীতে আফগানিস্তানে কথিত জেহাদের প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। বাংলাদেশে একাধিক সশস্ত্র জঙ্গিবাদী দল রয়েছে যারা কিনা আফগানিস্তানের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা দেশে ফিরে আফগানিস্তানের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এখানকার হাজার হাজার মুসলিম তরুণকে জঙ্গিবাদের দীক্ষা দিয়েছে। এবারের তালেবান উত্থানের পর্বেও উদ্বেগের সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে- বাংলাদেশ থেকে একটি গোষ্ঠী পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় খবরও বেরিয়েছে।
- আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানরা দেওবন্দ ধারার ইসলামে বিশ্বাসী, আর আমাদের দেশেও এই ধারার অন্তত ২৫ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এসব মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে প্রকাশ্যে আফগানিস্তানের তালেবান শাসনের তারিফ করতে দেখা যায়। প্রথম যখন তালেবানের উত্থান হয়েছিল, আমাদের দেশের রাজপথে মিছিল বেরোয়- বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালেবান। আফগানিস্তানে আবারও তালেবানী শাসন শুরু হলে বাংলাদেশের এই গোষ্ঠীটিও নতুন করে সক্রীয় হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই।
- অনলাইনে কওমী ধারার বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, গ্রুপ ইত্যাদিতে আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও তালেবানের উত্থান নিয়ে একটি গোষ্ঠী প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে যা নিশ্চয়ই গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। তালেবানদের প্রশংসা করে বিভিন্ন ওয়াজের বক্তা ও জুমার খতিবরা বক্তব্য রাখছেন, যে ভিডিও বক্তব্যগুলো ফেসবুক ও ইউটিউবে ভাইরাল হচ্ছে। এসব বক্তব্যের দ্বারা বাংলাদেশের কওমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
- গাজওয়াতুল হিন্দের হাদিসগুলো ব্যবহার করে অতীতে জঙ্গিবাদের পালে হাওয়া দেওয়া হয়েছে। তালেবানের উত্থানে এই হাদিসটির বিকৃত ও সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা আবারও বেড়ে যেতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে চরমভাবে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বাংলাদেশও সেই পরিস্থিতির বাইরে থাকবে না।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে হয়ত উগ্রপন্থার আরেকটি ঢেউ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে, তা শুধু শক্তি প্রয়োগ করে সম্ভব হবে না। প্রয়োজন পড়বে ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে অর্থাৎ কাউন্টার ন্যারেটিভের মাধ্যমে উগ্রবাদীদের মতাদর্শের ভ্রান্তি উন্মোচন করা। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে জঙ্গিদের সক্ষমতা বেড়েছে। কাজেই এখনই সরকারকে সতর্কতার সাথে ভবিষ্যৎ সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত সন্ত্রাসবাদের আদর্শিক মোকাবেলার জায়গাটিকে আরও শক্তিশালী করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে
আফগানিস্তান: পরাশক্তিদের রঙ্গমঞ্চ হয়ে ওঠার গল্প!
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে
আফগানিস্তান: আগুন নিয়ে খেলছিল যুক্তরাষ্ট্র!