মোহাম্মদ আসাদ আলী: এক ভয়াবহ ক্রান্তিলগ্নে উপনীত হয়েছে আমাদের মুসলিম জাতি। পৃথিবীময় খণ্ড-বিখণ্ড আকারে ছড়িয়ে থাকা ১৬০ কোটির এই বিশাল জাতিটির অবস্থা হয়েছে ফুটবলের মত, যে যেখানে পারছে এই জাতির সদস্যদের উপর আঘাত করে যাচ্ছে। তাদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে, হত্যা-ধর্ষণ করছে, বাড়িভিটে থেকে উচ্ছেদ করছে, দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। ছোট ছোট শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। আবার শুধু যে বাইরের শত্রু দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে তাও কিন্তু নয়, নিজেরা নিজেরাও হানাহানি-রক্তপাত করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত এই জাতিটিকে কেউ টেনে নিতে চাইছে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে, আর এরাও আগ-পাছ না ভেবেই অন্ধের মত মৃত্যুখাদের কিনারে পৌঁছে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
আল্লাহর রসুল একটি আদর্শের সাথে আরবদের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতে একটি অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদী জাতি তৈরি করলেন। সেই জাতিকে সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায়, অবিচার, অনিরাপত্তা দূর করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেলেন, এদিকে জাতি সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলতে লাগল। এরপর কেটে গেছে ১৩০০ বছরেরও বেশি সময়। এই সময়ের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- জাতির লক্ষ্য ভুলে যাওয়া এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছেড়ে দেওয়ায় অন্য জাতিগুলার দ্বারা পরাজিত ও গোলামীর জীবনে আবদ্ধ হয়ে পড়া। ১২৫৮ সালে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করল। এই জাতির যাবতীয় সমৃদ্ধি ও গৌরবের কেন্দ্রভূমি তখন বাগদাদ। সেই বাগদাদ আক্রমণ করে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল এবং মুসলমানদের মস্তক দিয়ে পিরামিড বানাল। এমনকি জাতির খলিফাকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলল। কিন্তু লাঞ্ছনাদায়ক এই শাস্তি থেকেও জাতি যখন কোনো শিক্ষাই নিল না, আল্লাহর রসুলের অর্পিত দায়িত্ব তবুও কাঁধে তুলে নিয়ে জাতি পৃথিবীময় সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বেরিয়ে পড়ল না, ঘরে বসে বসে ভোগ-বিলাসে জীবনযাপন করতে লাগল তখন আল্লাহ শাস্তিস্বরূপ এই জাতিকে পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় জাতিগুলোর গোলাম বানিয়ে দিলেন।
এই পরিণতিটি অনিবার্য ছিল, কারণ আল্লাহর রসুল তাদেরকে যে কাজের দায়িত্ব দিলেন সেই কাজ না করে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও অপ্রয়োজনীয় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তর্ক বাহাস করেছে এবং তা থেকে মতবিরোধ তৈরি হয়ে বিভিন্ন ফেরকা-মাজহাব ইত্যাদিতে বিভক্ত হয়ে নিজেরা দুর্বল হয়ে গেছে, আর দ্বীনকেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এভাবে কালপরিক্রমায় যে অন্তর্মুখী ও মাসলা-মাসায়েলের বিতর্কে জর্জরিত জাতিটি তৈরি হয়েছে তাদের দিয়ে আর যাই হোক বড় কোনো লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হত না। জাতির এই অনৈক্য, সংকীর্ণতা ও উদ্দেশ্যহীনতার শাস্তি দিতেই যেন আল্লাহ ইউরোপীয় জাতিগুলোকে পাঠালেন এই জাতিকে পদানত করে গোলাম বানাতে। ইউরোপীয়রা প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে এই উম্মাহকে সামরিক শক্তিবলে পরাজিত করল এবং জাতীয় জীবনে বিকৃতভাবে হলেও যেটুকু আল্লাহর হুকুম চালু ছিল সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে তাদের নিজেদের তৈরি সিস্টেম কার্যকর করল, যেমনটা আমাদের উপমহাদেশে করেছে ব্রিটিশরা। এই পরাজয় ও গোলামীর পরিণতি হলো এই যে, যে জাতির জন্মই হয়েছিল পৃথিবীময় আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে সেই জাতিই ইউরোপীয় দখলদার জাতিগুলোর দ্বারা নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত হয়ে ঐ জাতিগুলোর পায়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। কি নির্মম পরিহাস! উপরন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তুর্কি খেলাফতের নামে নামমাত্র একটি ঐক্যসূত্র থাকলেও যুদ্ধে পরাজয়ের পর সেটাও তছনছ হয়ে যায় আর তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীন মুসলিমপ্রধান দেশগুলো ‘সাইকস-পাইকস’ গোপন চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ, জার্মানি ইত্যাদি শক্তিগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। এক আরব তখন পঁচিশ খণ্ড।
এইভাবে কেবল দু’একটি আরব দেশ ছাড়া সমগ্র মুসলিম জাতিটিই আক্ষরিকভাবেই পাশ্চাত্যের গোলামীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ঐ আরব দেশগুলো যে সরাসরি ইউরোপীয়দের গোলামী থেকে বেঁচে গিয়েছিল তার কারণ এই নয় যে, তারা খুব ভালো মুসলিম ছিল এবং জাতির লক্ষ্য সম্পর্কে খুব সজাগ ও সচেতন ছিল। তা যে নয় তার প্রমাণ এই আরব রাষ্ট্রগুলো সামরিকভাবে ঐ পশ্চিমাদের সরাসরি গোলামী থেকে বেঁচে গেলেও মানসিকভাবে পশ্চিমাদের গোলামী করে যাচ্ছে আজও। সম্ভবত আল্লাহ তাঁর হাবীবের রওজা মোবারকের সম্মান রক্ষার্থে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর থাবা থেকে ঐ আরব ভূমিটুকু রক্ষা করেছিলেন মাত্র, যদিও ভ্রাতৃঘাতী কোন্দল ও যুদ্ধ-রক্তপাতের কারণে কতদিন সেই ভূ-খণ্ডটুকুও সুরক্ষিত থাকে তা বলা যাচ্ছে না।
একটা সময় পৃথিবীময় ইহুদিরা মার খেয়ে বেড়াত। যেখানে যেত অপমান আর নিগ্রহ তাদের পেছনে পেছনে যেত। গোলামীর জীবনই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ তাদেরকে আল্লাহর নবী ঈসা (সা.) ও দাউদ (আ.) লানত দিয়েছিলেন। আজ আমাদের করুণ বাস্তবতা এই যে, আমাদের পরাজয়, গোলামী, অপমান আর নিগ্রহের বেদনাদায়ক ইতিহাস ঐ ইহুদিদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে। তারা মার খেয়েছে ইউরোপে আর এই জাতি মার খাচ্ছে সারা দুনিয়ায়। আজ এই জাতির অবস্থা কী?
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা হাজার বছর ধরে দেশটিতে বসবাস করে আসলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে বিদেশি আখ্যা দিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, আর একাজে ধর্ষণকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নারী-শিশুকে ঘরে তালাবদ্ধ রেখে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষদেরকে গুলি করে ও জবাই দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের না আছে থাকার জায়গা, না আছে পালানোর জায়গা। কিন্তু পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান তাদের সাহায্যার্থে কিছুই করতে পারল না। যারা নিজেদের মুসলমান পরিচয় নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন, নিজেদেরকে খুব মানবিক বলে তুলে ধরতে চান এবং পাশ্চাত্যের যে মানবতার ফেরিওয়ালারা দেশে দেশে মানবতা আর মানবাধিকার রপ্তানি করে বেড়ান তাদের কেউ মুসলমানদের পক্ষে একটা আঙ্গুলও তুলল না। কেবল মানবিক কারণে বাংলাদেশ কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যদিও তার জন্য নানামুখী সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
কম্যুনিস্ট বিপ্লব হবার পর থেকে চীনে মুসলমানরা মার খাচ্ছে। রোজা রাখা, আজান দেওয়ার অধিকারটুকুও তাদের নেই। বিগত রমজানে রোজা রাখার অপরাধে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে ১০০ মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যা, নির্যাতন, জেল, ফাঁসি তো রোজকার ঘটনা।
আফগানিস্তান গত কয়েক দশক ধরে যুদ্ধের দাবানল জ্বলছে। যুদ্ধ, রক্তপাতটাই সেখানকার স্বাভাবিক চিত্র। লাখো মুসলমানের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে একবার দেশটি কম্যুনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে যায়, পরোক্ষণেই জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, আবার আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে যায়। সর্বক্ষেত্রই প্রাণ হারায় মুসলমান, ধ্বংস হয় মুসলমানের দেশ।
সত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিনের মাটিতে ফিলিস্তিনীদেরকেই নিধন করছে ইহুদিবাদী ইজরাইল। বেছে বেছে মুসলিম শিশুদেরকে গুলি করে মারা হচ্ছে। শক্তিধর ইজরাইলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে ফিলিস্তিনিরা এখন নিশ্চিহ্ন হবার পথে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচাইতে বড় গণহত্যাটি হয়েছে যেখানে সেটা হচ্ছে বসনিয়া। বসনিয়ায় খ্রিস্টান সার্বরা যা করেছে তার নজীর মানুষের ইতিহাসে নেই। সার্বরা ৭০ হাজার মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেছে, তাদের সাত মাস পর্যন্ত আটকে রেখেছে যাতে তারা খ্রিস্টানদের ঔরসজাত সন্তানগুলো গর্ভপাত করে ফেলে দিতে না পারে।
একইভাবে চেচনিয়ায় মুসলিমদেরকে গুলি করে, ধারাল অস্ত্র দিয়ে, ট্যাঙ্ক দিয়ে পিষে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যেয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে নয়ত বেশ্যালয়ে বিক্রি করা হয়েছে।
এদিকে ৭০ বছর ধরে উত্তাল কাশ্মীর। আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে কাশ্মীরীরা যেন দাবার ঘুঁটি। সেই ঘুঁটি যেদিকেই চালা হোক কাশ্মীরী মুসলমানদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সেখানে এমন পরিবার কমই আছে যাদের কেউ না কেউ অন্যায়ভাবে প্রাণ হারায় নি।
ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন উপনিবেশিক শক্তি আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশ দখল করে নির্যাতন-নিপীড়ন-খুন-ধর্ষণ ও সেই সাথে অবাধ শোষণ আর লুটতরাজ চালিয়ে দেশগুলোকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আফ্রিকানদের স্বর্ণ ও হীরার ক্ষণি এখন ইউরোপকে সমৃদ্ধ করছে, আর আফ্রিকান কঙ্কালসার মানুষগুলো না খেয়ে মারা যাচ্ছে।
লিবিয়াকে বলা হত আফ্রিকার ত্রাতা। কথিত আরব বসন্তের কাঁধে সওয়ার হয়ে পশ্চিমারা সেই লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে এখন মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে ছেড়েছে। আকাশ থেকে বিমান হামলা করে খুব সহজেই মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দিয়েছে এবং দেশটির তেলের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা মরল কি বাঁচল, খেতে পেল কি অভুক্ত রইল সেদিকে কেউ ফিরেও তাকায় নি। এখন যখন সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া থেকে মুসলমান পরিবারগুলো জীবন বাজি রেখে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছে, কিংবা আমেরিকার ভিসা খুঁজছে, তখন ইউরোপীয়রা রে রে করে তেড়ে আসছে, আর আমেরিকার মুসলিমবিদ্বেষী প্রেসিডেন্ট নির্দেশ জারি করছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মুসলমানদের অধিকার নেই আমেরিকার মাটিতে পদস্পর্শ করার। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে পানিতে ডুবেই প্রাণ হারিয়েছে দশ হাজার মুসলিম শরণার্থী। ইহুদীদেরও আল্লাহ এমন শাস্তি দেন নাই।
পৃথিবীর বড় বড় জাতিগুলি দিয়ে শাস্তি দিয়েও খুশী না হয়ে আল্লাহ অপমানের চূড়ান্ত করার জন্য ভারতের আসামের গাছ-পাথর উপাসক একটি পাহাড়ী উপজাতি দিয়ে মুসলিম নামধারী এই জাতিকে গুলি করে, তীরবিদ্ধ করিয়ে, কুপিয়ে হত্যা করাচ্ছেন, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করাচ্ছেন।
এই গেল অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর হাতে এই জাতির নির্যাতিত হবার বর্ণনা, যে বর্ণনার কোনো শেষ নেই, একটা বিশাল পুস্তকেও যার সম্পূর্ণটা তুলে ধরা সম্ভব নয়। এবার দেখা যাক ভেতরের চিত্র।
জাতি যে আল্লাহর অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে এবং তার ফলে নিজেদের কমন সেন্সটুকুও হারিয়ে নির্বোধ জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছে তার একটি বড় প্রমাণ হচ্ছে বিশ্বময় অন্যান্য জাতিগুলো যখন আদাজল খেয়ে নেমেছে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তখন এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হবার বদলে নিজেদের মধ্যে বিভেদের নালাকেই প্রসারিত করে সাগরে পরিণত করছে এবং তার দ্বারা ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের কাজটাকে পানির মত সহজ করে দিচ্ছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নিরা জোট করেছে, আর ইরানের নেতৃত্বে শিয়ারা। এই সুন্নিরা শিয়াদেরকে যতটা ঘৃণা করে ততটা পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেও করে না, একইরকম ঘৃণা শিয়ারাও লালন করে সুন্নিদের প্রতি। এই সুযোগটাই নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো। তারা কেউ ‘শিয়াজুজু’র ভয় দেখিয়ে সুন্নি জোটের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, আর কেউ ‘সুন্নিজুজু’র ভয় দেখিয়ে শিয়াদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। গোপনে গোপনে উভয়পক্ষকেই কুমন্ত্রণা দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লাগিয়ে রাখছে, উভয়পক্ষের কাছেই অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং অস্ত্রব্যবসা করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। আর এই উম্মাহ বলির পাঁঠা হয়ে প্রভু সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা ধ্বংস হচ্ছে। আজকে তাদের শিয়া-সুন্নি বিরোধের খেসারত দিতে হচ্ছে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনের লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে বোমায় লণ্ডভণ্ড হয়ে, ঘরবাড়ি হারিয়ে, অভুক্ত-অনাহারী থেকে। সিরিয়ায় গত ছয় বছরে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে যাদের সবাই মুসলিম, আর উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি হবে, অন্তত এক কোটি। ইরাকে চলছে মরার উপর খারার ঘা। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়েমেন সবচাইতে বড় দুর্ভিক্ষের মুখোমুখী হতে চলেছে কেবলই শিয়া-সুন্নি বিরোধ ও সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে। এই নেতারা কী জবাব দিবেন আল্লাহর কাছে তা একমাত্র তারাই জানেন। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মুসলিমের প্রাণ ঝরে যাওয়ার পেছনে নিজেদের দায় একজনও অস্বীকার করতে পারবেন না।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করবার জন্য সৌদি নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল কথিত ইসলামী সামরিক জোট, এই জোটে আমাদের বাংলাদেশও অংশ নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি সফরের পর সেই জোট ভোল পাল্টে শিয়াবিরোধী সুন্নি জোটে রূপ নিয়েছে এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শিয়াদেরকে কুপোকাত করতে এই জোটকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি কাতারের সাথে সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশের সম্পর্ক ছিন্নকরণের ঘটনাও এই সূত্রে গাঁথা। কাতারের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগের ফিরিস্তি রচনা করেছে সৌদি আরব, কিন্তু বিরোধের মূল কারণ বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না। সুন্নি রাষ্ট্র হবার পরও কাতার কেন শিয়া রাষ্ট্র ইরানের সাথে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলে- এটাই হয়েছে কাতারের বড় অপরাধ! যুক্তিসঙ্গত অভিযোগই বটে! কারণ যে পরিমাণ শত্রুতা তারা একে অপরের প্রতি লালন করেন তাতে শিয়া হবারও দরকার নেই, শিয়া রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক থাকাটাই সুন্নিদের শত্রু বলে বিবেচিত হবার জন্য যথেষ্ট এবং এহেন শত্রুতার চর্চা কোনো একদিক থেকে নয় কেবল, এই চর্চা হয়ে আসছে উভয়দিক থেকেই। উভয় ফেরকাই চায় পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানকে হত্যা করে হলেও প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে ফেলতে। যদিও বিষয়টি ওপেন সিক্রেট তবে সবসময় ওপেন সিক্রেটও থাকে না, সহনশীলতার ঝাঁপি খুলে প্রায়ই নিজেদের উগ্রমূর্তিকে ‘ওপেন’ করে ফেলেন তারা। এই তো কিছুদিন পূর্বেই সৌদি আরবের যুবরাজ মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধ ইরানে নিয়ে যাবার ঘোষণা দেওয়ার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমকি দিলেন মক্কা ও মদীনা ছাড়া গোটা সৌদি আরবকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। এই ধ্বংসলীলা একবার যদি শুরু হয় তা থেকে আমাদের মত দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোও কি মুক্ত থাকবে? মুক্ত যে থাকবে না তার প্রমাণ- যেইমাত্র সৌদি ধ্বংস করার হুমকি দেওয়া হলো পরোক্ষণেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, ‘যদি মক্কা ও মদীনা আক্রান্ত হয় তবে বাংলাদেশ সেনা পাঠাবে।’ হয়ত এভাবেই একদিন মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নি যুদ্ধের বলয়ে ঢুকে শিল-পাটার ঘষায় মরিচবাঁটা হবে আমাদের মত গরীব মুসলমান দেশগুলো। আমরা জানি না আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকরা ওদের যাবতীয় হুমকি-ধামকিকে কেবল তাদের রাজনৈতিক ভাষা মনে করছে কিনা, করলে ভুল হবে। ওটা ওদের একেবারে অন্তরের ভাষা, যুদ্ধ ওরা করছে এবং করবে, কারণ একে অপরকে ধ্বংস করতে উভয়পক্ষই মরীয়া হয়ে আছে, তাতে কয়টা মুসলিম দেশ ধ্বংস হলো, কত লক্ষ মুসলমানের প্রাণ গেল, কত কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু হলো সে হিসাব ঘুনাক্ষরেও কেউ করবে না।
আজকে পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, যে কাতারের সাথে সৌদি আরবের বিরোধের পেছনে বসে কলকাঠি নাড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেই কাতারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ বিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তি সাক্ষরিত হলো এই সেদিন। অন্যদিকে সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচাইতে বড় একক অস্ত্রচুক্তি তো রয়েছেই। সুতরাং আজ বাদে কাল এই বিরোধ তুঙ্গে উঠলে ক্ষতি যদি হয় সে মুসলমানদের হবে, আর অস্ত্রব্যবসা করে লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা যখন যুদ্ধ বলতেই দেখি অশ্রু আর রক্তের জোয়ার, তারা দেখে অস্ত্রব্যবসার অবারিত সুযোগ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তেল-গ্যাসের উপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ। তাই তাদের যুদ্ধ দরকার। সেই যুদ্ধক্ষেত্রটা যদি হয় ইরাক, সিরিয়ার পাশাপাশি কাতারের মত ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলমানদের কোনো দেশ তাহলে তো সোনায় সোহাগা। যেমন চলমান সিরিয়া যুদ্ধ।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়া দেশটির উপর কী নির্যাতনটাই না চলছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, আঞ্চলিক শক্তিগুলো, এছাড়াও ছোট ছোট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সবাই সিরিয়ায় নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে মেতে আছে এবং তা করতে গিয়ে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের প্রাণ গেছে। কিন্তু গোড়ায় গেলে দেখি সিরিয়া এখন কারো নয়, ঐ আসাদ সরকারেরও নয় ঐ বিদ্রোহীদেরও নয়, ঐ শিয়ারও নয় ঐ সুন্নিরও নয়, সিরিয়া এখন রাশিয়া এবং আমেরিকার। সিরিয়া ভাগ হয়ে টুকরো টুকরো হবে নাকি অখ- থাকবে, যুদ্ধ বন্ধ হবে নাকি পরাশক্তিগুলোর ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা করবার স্থান হবে সেই সিদ্ধান্তও নেবার ক্ষমতা ঐ রাশিয়া এবং আমেরিকার হাতে। তাহলে শিয়া-সুন্নি বিরোধ জাতিকে কী দিল? দিল সেই পরাজয়, অপমান, লাঞ্ছনা আর গোলামী যেটা তারা পৃথিবীময় কয়েক শতাব্দী ধরে ভোগ করে আসছে। একই অবস্থা লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য যুদ্ধবিধ্বস্ত মুসলিম দেশগুলোর। জাতির যে অংশটি এখনও এই বিভীষিকার বাইরে আছে এবং পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে নিজ জাতির দুর্বিসহ জীবনের চিত্র দেখেও নির্বিকারভাবে খাচ্ছে দাচ্ছে, বংশবিস্তার করছে, চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছে, আর ভাবছে এ সমস্যা তাদের নয়, তাদের এই আত্মতৃপ্তির বেলুনও একদিন ফুটো হবে তাতে সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যেই প্রত্যেকটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করলে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে বোঝানো হচ্ছে ইসলামের প্রতি আঘাত হিসেবে। দেশে দেশে দানা বাঁধছে গণঅসন্তোষ। সরকার ও জনগণ দুই মেরুতে সরে যাচ্ছে। অস্থিতিশীলতা সর্বত্র। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের বলয়ে ইচ্ছে না থাকলেও জড়িয়ে পড়ছে সকল মুসলিমপ্রধান দেশ। আর সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ীরা তো বসেই আছে মুসলমানদের অনৈক্যের নালাকে সাগর বানিয়ে সেই সাগরে জাতিটিকে ডুবিয়ে মারতে। মনে রাখতে হবে, সিরিয়ার মুসলমানরাও একদিন ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের খবর পড়ে নির্বিকার থাকত, আজ তাদের শিশু সন্তানরা ‘শবযাত্রা শবযাত্রা’ খেলা করে। এই করুণ বাস্তবতা আজও যদি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে কবে উপলব্ধি করব? এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে আমাদের ভবিষ্যতকে চালিত করব। আমরা কি এভাবেই সমূলে বিনাশ হয়ে যাব নাকি পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
লেখক: কলামিস্ট ও সহকারী সাহিত্য সম্পাদক,হেযবুত তওহীদ
যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫,
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]