ড. ইউনুস কর্তৃক ‘বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ বর্জনের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে আমাদের কথা:
মো. রিয়াদুল হাসান:
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস গত ২ জুন সোমবার রাজধানীর পুলিশ স্টাফ কলেজের কনভেনশন হলে সামাজিক ব্যবসা একাডেমিয়া ২০১৫ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে যে কথাগুলো বলেছেন তা সমাজের প্রতিটি মানুষের চিন্তায় সাড়া জাগানোর মতো। অত্যন্ত সরল ভাষায় তিনি বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দোষ ত্র“টিগুলো তুলে ধরে একে বর্জন করার যৌক্তিকতা সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, “বর্তমান বিশ্বে ‘ব্যক্তির লাভবান হওয়ার’ ধারণাকেন্দ্রিক যে অর্থনৈতিক কাঠামো চালু রয়েছে তাতে অচল অবস্থা দেখা দিয়েছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বে এই অর্থনৈতিক কাঠামো আর চলতে পারে না। কারণ এ ব্যবস্থা টেকসই নয়। এ ছাড়া বর্তমান জীবনব্যবস্থার সাথেও তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অচলায়তন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
নিঃসন্দেহে খুবই বড় কথা। কারণ মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা এবং তারপরেই অর্থনীতি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যর্থতার ফলস্বরূপ বিকশিত মার্কসীয় অর্থনীতিও ব্যর্থ হয়েছে নিদারুণভাবে। তাই নতুন বোতলে আবার ফিরে এসেছে পুরাতন পুঁজিবাদ। সেটাও এখন ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতেও ৯৯% মানুষকে বঞ্চিত করে ১% মানুষ বিরাট সম্পদের পাহাড়ে বসে আছে। পাশাপাশি ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব ইত্যাদি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখন তাই যুদ্ধ অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছে এবং বিভিন্ন দেশে যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টি করে সেখানে অস্ত্র ব্যবসা করে নিজেদের অর্থনীতিকে বাঁচাতে চাইছে।
কোনো মতামত যুক্তিসিদ্ধ কিনা তা যাচাই করার জন্য যুক্তিবিদ্যায় অভিজ্ঞতার ব্যবহার করা হয়। ১৪০০ বছর আগে প্রকৃত ইসলামের অর্থনীতি কী ফল বয়ে এনেছিল সেই অভিজ্ঞতাটি উল্লেখ করতে পারি। যে এলকাগুলোয় সেই অর্থনীতিক সিস্টেম প্রযুক্ত হয়েছিল সে এলাকাগুলোতে মানুষ এমন স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল যে, উটের পিঠে খাদ্য ও অর্থ বোঝাই করে মানুষ শহরের পথে পথে, মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতো কিন্তু তা গ্রহণের জন্য কাউকে পাওয়া যেত না। পরে মরুভূমিতে গিয়ে যে পথে কাফেলাগুলো যায় সেই পথে গ্রহণকারীর সন্ধান করত। সরাইখানাগুলো স্থানীয় লোকেদের প্রদত্ত ফল ও ফসল উপচে পড়ত। সামাজিক নিরাপত্তা এতদূর গিয়েছিল যে, একটি যুবতী মেয়ে একা দিবসে ও রাতে শত শত ক্রোশ পথ মূল্যবান অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় অতিক্রম করত। তার মনে কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হতো না। রাস্তায় যে কোনো মূল্যবান জিনিস খোয়া গেলে তা নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যেত, কেউ তসরুপ করত না। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনীসহ সে সময়ের লেখকদের লেখা বইগুলো থেকে সোনালি যুগের এ চিত্র দেখা যায়। ড. ইউনুস এমন একটি অর্থনীতির প্রস্তাব করেন যার ফোকাস বা কেন্দ্রবিন্দু হবে ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে জাতির স্বার্থ। ইসলামের অর্থনীতি মূলত সামাজিক দান ভিত্তিক। দান মানে ভিক্ষা প্রদান নয়, দান মানে মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থ অবদান রেখে নিজের মনুষ্যজন্মকে সার্থক করার উপায়।
ইসলামের অর্থনীতির মূল ভিত্তি অর্থাৎ যে নীতির উপর এ ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে সেটা মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী তুলে ধরেছেন। পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্রের নীতি হলো জনসাধারণের সম্পদ সাপটে এনে এক বা একাধিক স্থানে জড়ো করা। সমাজতন্ত্রের নীতি হলো জনসাধারণের সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে তুলে নেওয়া। মূলে একই কথা, দু’টোই জনসাধারণকে বঞ্চিত করা। পুঁজিবাদে দেশের, জাতির সম্পদ পুঞ্জীভূত করে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের হাতে ব্যাংক ইত্যাদির মাধ্যমে। যার ফলভোগ করে অতি অল্পসংখ্যক লোক এবং তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বঞ্চিত করে বিরাট ধনী হয়ে যায়। আর সমাজতন্ত্র দেশের জাতির সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাষ্ট্রের হাতে। জনসাধারণকে দেয় শুধু খাদ্য, পরিধেয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো প্রাথমিক, মৌলিক প্রয়োজনগুলি, যদিও কার্যক্ষেত্রে তাও সুষ্ঠুভাবে করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পদ পুঞ্জীভূত করে হাতে গোনা কতকগুলি কোটিপতি সৃষ্টি হয়, বাকি জনসাধারণ জীবনের প্রাথমিক মৌলিক প্রয়োজনগুলি থেকেও বঞ্চিত হয়। এই ব্যবস্থা যতটুকু পরিধিতে প্রয়োগ করা হবে ততটুকু পরিধিতেই ঐ ফল হবে। একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে (Nation State) এ ব্যবস্থা প্রয়োগ করলে যেমন ঐ রাষ্ট্রের জনসাধারণের ভীষণ দারিদ্র্যের বিনিময়ে মুষ্টিমেয় কোটিপতি সৃষ্টি হবে ঠিক তেমনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পৃথিবীময় প্রয়োগ করলে কয়েকটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র বিপুল ধনী হয়ে যাবে আর অধিকাংশ রাষ্ট্র চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হবে যেমন বর্তমানে হয়েছে। এর কারণ হলো একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রের সম্পদ যেমন সীমিত- তেমনি পৃথিবীর সম্পদও সীমিত। সীমিত যে কোন জিনিসকেই কোথাও একত্রিত করা, পুঞ্জীভূত করা মানেই অন্যস্থানে অভাব সৃষ্টি করা। একটা রাষ্ট্রের ভেতরই হোক, আর সমস্ত পৃথিবীতেই হোক, সেটার সম্পদ, যা সমস্ত মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকার কথা, সেটাকে যদি কোথাও পুঞ্জীভূত করা হয় তবে অন্যত্র অভাব সৃষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী। সমাজবাদী, পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্ট (Socialist, Capital & Communist) এই সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই মানুষের তৈরি ব্যবস্থা। সুতরাং এর পরিণাম অবশ্যই অন্যায়-অবিচার। অন্যদিকে শেষ জীবন-ব্যবস্থায় অর্থনীতির প্রণেতা স্বয়ং স্রষ্টা, আল্লাহ। এই ব্যবস্থার ভিত্তি নীতি হচ্ছে সম্পদকে মানুষের মধ্যে দ্রুত গতিতে চালিত করা, কোথাও সঞ্চিত হতে না দেওয়া। পুঁজিবাদ বলছে সম্পদ খরচ না করে সঞ্চয় কর; সবার সঞ্চয় একত্র কর, পুঞ্জীভূত কর (ব্যাংকে), আল্লাহ কোর’আনে বলছেন খরচ কর, ব্যয় কর, সম্পদ জমা করো না, পুঞ্জীভূত করো না। অর্থাৎ ইসলামের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। একটায় সঞ্চয় কর অন্যটায় ব্যয় কর। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রী সাম্যবাদী অর্থনীতি ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ করে জাতির সমস্ত সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে পুঞ্জীভূত করে। এটাও ইসলামের বিপরীত। কারণ, ইসলাম ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণ স্বীকার করে এবং রাষ্ট্রের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না। এককথায় বললে বলতে হয় ইসলামের অর্থনীতির মূল কথা হচ্ছে সম্পদকে যত দ্রুত সম্ভব চালিত করা, কোথাও যেন সেটা স্থবির-অনঢ় না হতে পারে। এই জন্যই কোর’আনে এই অর্থনীতির প্রণেতা বহুবার তাগিদ দিয়েছেন খরচ কর, ব্যয় কর, কিন্তু বোধহয় একবারও বলেন নি যে, সঞ্চয় কর। যাকাত দেয়া, খারাজ, খুমস ও ওশর দেয়া এবং তার উপর সাদকা দান ইত্যাদিসহ প্রায় চব্বিশ রকম উপায়ে খরচের কথা এতবার তিনি বলেছেন যে, বোধহয় শুধুমাত্র তওহীদ অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহকে প্রভু, হুকুমদাতা, এলাহ বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করা এবং জেহাদ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে এতবার বলেন নি। কারণ, একটা জাতির এবং পরবর্তীতে সমগ্র পৃথিবীতে অর্থাৎ যে কোন পরিধিতে সম্পদ যথাযথ এবং বণ্টনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সঞ্চয় নয়, ব্যয়। একজনের হাতে থেকে অন্য জনের হাতে হস্তান্তর,
অর্থাৎ গতিশীলতা। প্রতিটি হস্তান্তর যত দ্রুত হতে থাকবে তত বেশি সংখ্যক লোক ঐ একই সম্পদ থেকে লাভবান হতে থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ধরুণ একটা এক টাকার নোট। এই নোটটা যার হাতেই পড়লো, সে যথা সম্ভব শীঘ্র সেটা খরচ করে ফেলল। সে খরচ যেমন করেই হোক, কোন কিছু কিনেই হোক বা দান করেই হোক বা কাউকে ধার দিয়েই হোক বা কোন ব্যবসাতে বিনিয়োগ করেই হোক। ঐ নোটটা যদি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দশজন লোকের হাত বদলায় তবে ঐ এক দিনে নোটটা দশজন লোককে লাভবান করবে। আর যদি একশ জনের হাত বদলায় তবে একশ’ জনকে লাভবান করবে। কারণ প্রতিবার হাত বদলাবার সময় দু’জনের মধ্যে একজনকে অবশ্যই লাভবান হতেই হবে। অর্থাৎ ঐ সীমিত সম্পদটা অর্থাৎ ঐ এক টাকার নোটটা যত দ্রুত গতিতে হাত বদলাবে যত দ্রুত গতিতে সমাজের মধ্যে চালিত হবে তত বেশি সংখ্যক লোককে লাভবান করবে; তত বেশি সংখ্যক লোক অর্থনৈতিক উন্নতি করবে এবং পরিণতিতে সমস্ত সমাজকে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত করবে, সম্পদশালী করবে। সেই নোটটা যদি সমস্ত দিনে কোন হস্তান্তর না হয়ে কোন লোকের পকেটে বা কোন ব্যাংকে পড়ে থাকে তবে ওটার আসল মূল্য এক টুকরো বাজে ছেঁড়া কাগজের সমান। কারণ সারাদিনে সেটা সমাজের মানুষের কোন উপকার করতে পারলো না, কারো অথনৈতিক উন্নতি করতে পারলো না। আবার বলছি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের অর্থনীতির বুনিয়াদ-ভিত্তি হলো সম্পদের দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিশীলতা (Fast and still faster circulation of wealth)।
ইসলামি অর্থব্যবস্থায় অর্থ সম্পদের কৃপণতা, অলস পুঞ্জীভূত করণ এবং অনুৎপাদনশীল সঞ্চয় যেমন নিষিদ্ধ তেমনি সম্পদের অপব্যবহার, অপব্যয় এবং অপচয়ও নিষিদ্ধ। আল্লাহ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ বলতে পারেন- কেন? টাকার নোটটা অর্থাৎ সম্পদ পকেটে থেকে গেলে, বাক্সে ভরে রাখলে না হয় বুঝলাম ওটা উৎপাদনহীন, নিষ্ফল হয়ে গেল কিন্তু ব্যাংকে জমা পুঁজি তো বিনিয়োগ করা হয় এবং তা উৎপাদনে লাগে। ঠিক কথা কিন্তু ব্যাংকে জমা করা ঐ পুঁজি বিনিয়োগের গতি স্বাধীন মুক্ত হস্তান্তরের চেয়ে বহু কম, কোন তুলনাই হয় না। ব্যাংকের সম্পদ বিনিয়োগ করতে বহু তদন্ত, আইন-কানুন লাল ফিতার দৌরাÍ এবং তারপরও ঐ বিনিয়োগের সুফল ভোগ করে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ। শুধু ঐ শ্রেণিটি- যে শ্রেণিটি ইতিমধ্যেই সম্পদশালী, জনসাধারণের অনেক ঊর্দ্ধে। ব্যাংক কি যে চায় তাকেই পুঁজি ধার দেয়? অবশ্যই নয়। যে লোক দেখাতে পারবে যে, তার আগে থেকেই যথেষ্ট সম্পদ আছে কিন্তু আরো চাই, শুধু তাকেই ব্যাংক পুঁজি ধার দেয়, এটা সবারই জানা। যার কিছু নেই, যে ব্যাংকের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ বন্ধক দিতে পারবে না তাকে ব্যাংক কখনো পুঁজি ধার দেয় না, দেবে না। এক কথায় তৈলাক্ত মাথায় আরও তেল দেয়া, ধনীকে আরো ধনী করা, গরিবকে আরও গরিব করা। অনেক ব্যাংক, এনজিও ইত্যাদি গরিব মানুষকেও ঋণ দিয়ে থাকে কিন্তু পরবর্তীতে সেটা বহুগুণ সুদে আসলে উসুল করে, প্রয়োজনে ভিটেবাড়ি দখল করে নিয়ে সেই টাকা আদায় করে। সুতরাং ঐ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন অসম্ভব। শেষ ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জনসাধারণকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে হয় নি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো। জনসাধারণকে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে কোন অর্থনৈতিক উদ্যোগ-প্রচেষ্টাকেও নিষিদ্ধ করতে হয় নি। কারণ সম্পদের ঐ দ্রুত গতিই কোথাও সম্পদকে অস্বাভাবিকভাবে পুঞ্জিভূত হতে দেবে না। পানির প্রবল স্রোত যেমন বালির বাঁধ ভেঙ্গে দেয়, সম্পদের স্রোত তেমনি কোথাও সম্পদকে ¯তূপীকৃত হতে দেবে না। অথচ ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রচেষ্টার যে শক্তিশালী সুফল তারও ফল ভোগ করবে সমাজ।
ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থ ও বাণিজ্যনীতি পৃথিবীকে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় বলে ড. ইউনুস অভিমত ব্যক্ত করেছেন যা এক সরল সত্য। তিনি বলেছেন, ব্যক্তিগত মুনাফাকেন্দ্রিক বাণিজ্যনীতি দিয়ে কেউ কোনোদিন বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারবে না। প্রচলিত অর্থব্যবস্থা ও জীবনযাত্রায় গলদ রয়েছে। এর ফলে পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে না। পৃথিবীকে বাসের অনুপযোগী করে তুলছি। পৃথিবীর সম্পদ অশেষ নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ভূমিকার মাধ্যমে এটি বাড়ানো যায়। আমাদের এখনই ঠিক করতে হবে, আমাদের প্রজন্ম কতটুকু ভোগ করবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতটুকু রেখে যাব।
ড. ইউনুস তিনটি পি’র প্রতি উদ্যোক্তাদের নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বিদ্যমান ব্যবসা পদ্ধতিতে ব্যক্তির বা উদ্যোক্তার নজর শুধু একটি পি’তে। এই পি হলো প্রফিট বা লাভ। কিন্তু অপর দুই পি অর্থাৎ পিপল ও প্লানেট বা মানুষ ও পৃথিবীর প্রতি নজর দিতে হবে। তাদের সাফল্যও এ তিন পি বিবেচনায় নিয়ে মাপা দরকার। বন-গাছ আছে বলে পৃথিবী ও মানুষ টিকে আছে। মানুষ সেই বন-গাছ উজাড় করে দিচ্ছে। স্বার্থপর হতে গিয়ে অন্যের সঙ্গে নিজেদেরও ক্ষতি করছে। আমরা অনেক বর্জ্য তৈরি করছি ও সমুদ্রে ফেলছি। সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে বিশাল পরিমাণ বর্জ্য জমে গিয়ে পরিবেশের প্রতি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। কার্বন নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। বিদ্যমান অর্থনীতির কাঠামোতে ধনী বা শক্তিশালী ব্যক্তি আরো বড় হচ্ছে, উপরে উঠছে। আর নিচের মানুষ আরো তলানিতে যাচ্ছে। এ ব্যবস্থা পাল্টাতে হবে। সবার জন্য সুষম না হোক, অন্তত গ্রহণযোগ্য ভোগের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মানুষ শুধু স্বার্থপর নয়, স্বার্থহীনও। বিভিন্ন গুণের অমিত আধার মানুষ। তাই স্বার্থহীনতার গুণ দিয়ে স্বার্থপরতাকে পরাজিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপরকে সুখী করাই সবচেয়ে সুখকর বিষয়।”
তার এ অনুভবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, যে অর্থনীতি পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে সেটি আমাদের কাছে আছে। আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তায় বা তাঁর অসীম জ্ঞানের সম্বন্ধে যারা বিশ্বাসী নন তারা যুক্তি উত্থাপন করতে পারেন যে, চৌদ্দশ’ বছর আগে মানুষ সমাজের যে অবস্থা ছিল সেখানে হয়তো এই জীবনব্যবস্থা কার্য্যকরী হয়েছিল এবং ঐ অকল্পনীয় ফল দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের, প্রযুক্তির যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে জীবনে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এখন ঐ পুরনো ব্যবস্থা আর সেরূপ ফল দেখাতে পারবে না। এ কথায় আমাদের জবাব হচ্ছে, অবস্থার পারিপার্শ্বিকতায় বহু বিষয় বদলে যায়। অনেক বিষয় অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কিন্তু অনেক বিষয় আছে যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত, এর কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন: একটি মানুষের নাকে সজোরে ঘুসি মারলে তার নাক দিয়ে রক্ত বের হবে, লক্ষ বছর আগে এই ঘুষি মারলে তখনও রক্ত বের হোত, আজও বেরোয়, লক্ষ বছর পরেও মানুষের নাকে ঘুষি মারলে রক্ত বেরোবে। এর কোন পরিবর্তন নেই। জীবনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদ ভিত্তিক পূঁজিবাদ মানুষ সমাজে যে ক্ষতি করে, ধনী-দরিদ্রের যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে তা লক্ষ বছর আগেও করত, এখনও করছে এবং আজ থেকে লক্ষ বছর পরেও এই সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি মানবজীবনে প্রয়োগ করলে একই বিষময় ফল সৃষ্টি করবে। এমনি বহু জিনিস আছে যা শাশ্বত অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। সর্বজ্ঞানী আল্লাহ এই শেষ জীবনবিধান (দীন) তেমনি সেইসব অপরিবর্তনীয় শাশ্বত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা পৃথিবীর বাকি আয়ুষ্কালের মধ্যে পরিবর্তন হবে না। এই জন্য এই দীনের এক নাম দীনুল ফেতরাহ বা প্রাকৃতিক দীন (সুরা রূম ৩০)। এই জীবনব্যবস্থার প্রতিটি আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধ তিনি অতি সতর্কতার সঙ্গে ঐ সব অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাতে মানবজাতির বাকি আয়ুষ্কালের মধ্যে কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন না থাকে। কাজেই চৌদ্দশ’ বছর আগে এই জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রয়োগে যে ফল হয়েছিল, বর্তমানে প্রয়োগ করলেও সেই একই ফল হবে এবং লক্ষ বছর পরে প্রয়োগ করলেও সেই অকল্পনীয় ফলই হবে। তবে একটি বিষয় পাঠককে মনে রাখতে হবে, এখানে আমরা যে জীবনব্যবস্থা (দীন) প্রতিষ্ঠার কথা বলছি আর বর্তমানে ইসলাম বলে যে ধর্মটি চালু আছে এই দু’টি এক জিনিস নয়। আমরা সেই প্রকৃত ইসলামের কথা বলছি যা আল্লাহ তাঁর রসুলের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, সেটিই আবার আমরা মাননীয় এমামুযযামানের মাধ্যমে লাভ করেছি এবং যা বর্তমানে অসংখ্য সংকটে নিমজ্জিত মানবজাতিকে উদ্ধার করতে সক্ষম।