জিনাত ফেরদাউস
শিশু-কিশোর ও তরুণদের মানসিক বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে অনলাইন গেমস পাবজি ফ্রি ফায়ার ইত্যাদির কারণে। মোবাইল ডিভাইস ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় এবং স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শিশু কিশোর অনলাইন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মানসিক বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে, এমনকি অনলাইন গেমসের জের ধরে খুন-খারাবির মত ঘটনাও ঘটছে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ জারি করেছিল পাবজি ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর গেমসগুলো বাংলাদেশে বন্ধ করার। কিন্তু সেটাও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে কার্যকরী করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। সরকারিভাবে পাবজি, ফ্রি ফায়ার বন্ধ করলেও বিকল্প পদ্ধতিতে শিশু কিশোররা গেমসগুলো চালিয়ে যেতে পারছে সহজেই।
অনলাইন গেমসের আসক্তি ভয়াবহ পর্যায়ে
আসক্তি বলতে বোঝায় সাময়িক প্রশান্তির জন্য মানুষ বারবার যার দ্বারস্থ হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের পরে তার ভেতরে সেটার জন্য আবারও চাহিদা তৈরি হয়। আসক্তি বহুরকম হতে পারে- যেমন যৌনতা, জুয়া, শপিং, ইন্টারনেটে গেমস খেলা, মাদক ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে- ইন্টারনেটে পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ বহু গেমসের প্রতি শিশু কিশোররা আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা মাদকাসক্তির মতই তরুণ সমাজকে বিপথে চালিত করার হুমকি তৈরি করেছে।
এমনকি পাবজি, ফ্রি-ফায়ার ইত্যাদি গেমসের কারণে খুনের ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এই অনলাইন গেমগুলো এখন প্রায় মাদক দ্রব্যের মতো কাজ করছে। অনেকে এগুলোকে ‘ডিটিজাল ড্রাগস’ আখ্যা দিচ্ছেন। লাখ লাখ ছেলে মেয়ে এসব গেমসে আসক্ত হয়ে গেছে এবং তাদের নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।
গত দু’মাসে অনলাইনে গেম খেলাকে কেন্দ্র করে বহু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনা পত্রিকায় এসেছে, যা চিন্তাশীল মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। যেমন, পাবজি গেম খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে নবম শ্রেণির ছাত্র খুন হবার ঘটনা কিংবা পাবজি গেম খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে বন্ধুর বাবাকে ছুরিকাঘাতের ঘটনা। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও এই গেম ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে।
গত ২৯ আগস্ট ভারতের পাঞ্জাবে পাবজি খেলার নেশায় বাবা-মায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে ১৬ লক্ষ টাকা খরচ করেছে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। লকডাউনে অনলাইন ক্লাস করবে বলে মায়ের মোবাইল ব্যবহার করত সে। স্মার্টফোনে কার্ড ও ব্যাংক ডিটেইলস সেভ থাকায় টাকা তুলতে সমস্যা হয়নি তার। অথচ সেই টাকাটি তার বাবার চিকিৎসার জন্য রাখা হয়েছিল। এছাড়া সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভারতের মধ্যপ্রদেশের একটি ঘটনাও সবার দৃষ্টি কেড়েছে। মধ্যেপ্রদেশের ছাতারপুর জেলায় অনলাইনে মোবাইলে গেমস খেলে ৪০ হাজার টাকা খুইয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর। মোবাইলের একাউন্ট থেকে টাকা নেওয়ার মেসেজ পেয়ে ছেলেকে ফোন করে বকাবকি করেন কিশোরের মা। যা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে ওই কিশোর।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে এসব অনলাইন গেমসের আসক্তি কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কোমলমতি ছেলে মেয়েদেরকে এসব অনলাইন গেমস এমন এক নেশার জগতে নিয়ে গিয়েছে যেখানে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা তাদের থাকছে না।
২০০৮ সালের জুন মাসে শিশু-কিশোরের এই সমস্যার উপর দীর্ঘদিন জরিপ করে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা গেমিং অ্যাডিকশনকে মনঃস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অনেকে বলছেন এটা একটা মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। ইদানীং দেখা যায় গেমস আসক্তির ফলে তাদের মাথা ব্যথা এবং কম বয়সেই চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এমনকি গেমিংয়ের শিকার হচ্ছে ৩-৪ বছরের শিশুরাও। তাদের হাতে মোবাইল না দিলে হিংসাত্মক হয়ে উঠছে তাদের স্বভাব।
অনলাইন গেমস যেসব সমস্যা ডেকে এনেছে
১. অনলাইন গেমসে আসক্তির ফলে বাবা মায়ের সাথে শিশু কিশোরদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
২. শিশু কিশোররা বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গেমস খেলছে। মিথ্যা বলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খাবার গ্রহণ অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু কিশোররা।
৪. রাত জেগে মোবাইলের স্ক্রিনে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে এবং সেটার খারাপ প্রভাব পড়ছে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর।
৫. পড়ালেখায় মনোযোগ আসছে না।
৬. স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গল্প, কবিতা, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন ইত্যাদি পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না ছাত্র-ছাত্রীদের।
৭. বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে অনেকে।
৮. পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ বিভিন্ন অনলাইন গেমস শিশু কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসী ও হিংস্র মনোভাব সৃষ্টি করে দিচ্ছে।
৯. গেমের মাধ্যমে শিশু-কিশোররা নিজের অজান্তেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধের কায়দা-কৌশল শিখছে।
১০. সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হচ্ছে তাহলো- শিশু কিশোররা শৈশবের দুরন্তপনা, খেলাধূলা, ছোটাছুটি ইত্যাদি স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অপ্রাকৃতিক ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে
পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর অনলাইন গেমস বন্ধের তাগিদ অনুভব করে রাষ্ট্রীয়ভাবেও বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে।
গত ২৪ জুন দেশীয় সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকটক, বিগোলাইভ, লাইকি, পাবজি এবং ফ্রি ফায়ারের মত গেমস ও অ্যাপসগুলো বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ুন কবির পল্লব ও মোহাম্মদ কাউছার। এরপর গত ১৬ই আগস্ট বাংলাদেশে সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর সব অনলাইন গেমস আগামী তিন মাসের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি দেশে অনলাইন গেমস পাবজি ও ফ্রি ফায়ার বন্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এখনও শিশু কিশোররা আগের মতই পাবজি ও ফ্রি ফায়ার খেলতে পারছে এমনটা জানা গেছে। অনেকে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে গেমগুলো খেলতে পারছে, আবার অনেকে ভিপিএন ছাড়াই আগের মতই গেমগুলো খেলতে পারছে, এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তাহলে সমাধান কী?
ক্ষতিকর অনলাইন গেমস ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তরুণদের জড়িত হওয়ার হার বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয়ে খুব জোর দিচ্ছেন। তারা বলছেন-
১. ডিভাইসের আসক্তি থেকে বের করার জন্য শিশু কিশোরদেরকে বাস্তব জীবনে খেলাধূলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। খেলাধূলাকে ঐচ্ছিক বা অপ্রয়োজনীয় বিষয় মনে করা চলবে না। খেলাধূলাকেও লেখাপড়ার মতই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে দেখতে হবে। একটা সময় ছিল যখন তরুণরা কাবাডি, ফুটবল, ক্রিকেট, মোরগ লড়াই ইত্যাদি খেলায় মেতে থাকত। মেয়েদের বৌচি, কানামাছি, পুতুল বৌ, ফুল টোক্কা, বরফ পানি, এক্কা দোক্কা, রুমাল চুরি, রস কস, চার গুটি, চেয়ার খেরা সহ আরো কত খেলাধুলার নাম পাওয়া যায় যেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করলে শারীরিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবে ও সামাজিকভাবেও শিশু কিশোররা প্রভূত উপকার পেতে পারে। যেমন- একদল ছেলে মেয়ে যখন একসাথে খেলবে তখন সেখানে একে অপরের সাথে চেনা-পরিচয় তৈরি হবে, সামাজিক মেলামেশার জন্য যেসব গুণ দরকার হয় সেগুলো তাদের চরিত্রে তৈরি হবে, বন্ধুত্ব তৈরি হবে, একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হবে, সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপনের শিক্ষা তারা অবচেতন মনেই পেয়ে যাবে। তাছাড়া সরাসরি খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করলে সাহস বৃদ্ধি পায়, কথা বলারও যোগ্যতা তৈরি হয়। সবার সাথে মেলামেশা করার দক্ষতা এভাবেই একটি শিশুর মধ্যে কোমল বয়সেই তৈরি হয়ে যায়।
২. দ্বিতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে সরকারকে। যদি সত্যিই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বখে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হয় তাহলে এখনই শিশু কিশোরদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য খেলাধূলাকে শিক্ষার মতই গুরুত্ব দিতে হবে। খেলার মাঠগুলো দখলমুক্ত করতে হবে সবার আগে। নতুন নতুন খেলার মাঠ তৈরি করে দিতে হবে ছেলে মেয়েদের জন্য। আর শিক্ষাব্যবস্থাকেও এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলার জন্য সময় দিতে পারে। এই যে ছেলে মেয়েরা পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে অনলাইন ও অফলাইনের বিভিন্ন ক্ষতিকর বিষয়ে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, এটাকে কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়। এতে বোঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিশু কিশোরদের সামনে বড় কোনো লক্ষ্য হাজির করতে পারছে না। মহৎ কোনো উদ্দেশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করতে পারছে না, যে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ছেলে মেয়েরা এদিক ওদিক মনোযোগ না দিয়ে একনিষ্ঠভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে।
৩. তবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা অভিভাবকদেরকে পালন করতে হবে। সন্তানের প্রতি অভিভাবকের দায়িত্ব অনেক। ইদানীং দেখা যায় ছেলে মেয়েদেরকে পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখাকেই অভিভাবকরা একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন। ভালো ফলাফল বা ভালো কলেজ-ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য সবসময় একটা বাড়তি চাপের মধ্যে ছেলে মেয়েদেরকে ফেলে রাখা হয়, অথচ সবার আগে বিবেচনা করা দরকার শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি যাতে ঠিকমত হয়। তার জন্য সর্বপ্রথম শিশু-কিশোরদেরকে আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তাদেরকে খেলাধূলা, ভ্রমণ, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেলামেশা, গান-কবিতা-অভিনয়-লেখালেখি-অঙ্কন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে শিশু-কিশোররা হলো অনুকরণ-প্রবণ। অনেক বাবা-মা সারাদিন বাসার বাইরে থেকে বা অফিস থেকে বাসায় ফিরেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, বা টিভিতে সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটা সন্তানদের একাকীত্ব বাড়িয়ে তোলে এবং এক পর্যায়ে সে তার নিঃসঙ্গতা ঘোঁচানোর জন্য ডিভাইসকেই বন্ধু বানিয়ে ফেলে, যা পরবর্তীতে আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়।