রিয়াদুল হাসান:
মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাই তাকে চলতে হয় সমাজবদ্ধভাবে। একটি সমাজের সব মানুষ এক রকম নয়, তাদের শারীরিক যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতার ক্ষেত্র, পছন্দ-অপছন্দ, রুচি, মন-মানসিকতায় প্রচুর বিভিন্নতা রয়েছে। এটি মহান আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টি নৈপুণ্যের স্বাক্ষর। এটা যদি না থাকত তাহলে, ভালো এবং মন্দের কোনো পার্থক্য থাকত না, ন্যায় অন্যায়ের কোনো পার্থক্য থাকত না সর্বোপরি সমাজে কোনো ভারসাম্য থাকত না। আল্লাহ বলেন, দুনিয়ার জীবনে এদের মধ্যে জীবন-যাপনের উপায়-উপকরণ আমি বণ্টন করেছি এবং এদের মধ্য থেকে কিছু লোককে অপর কিছু সংখ্যক লোকের ওপর অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছি, যাতে এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে পারে (সুরা যুখরুফ ৩২)। সুতরাং আল্লাহর অভিপ্রায় এমন এক সমাজব্যবস্থায় মানুষ বাস করুক যা গড়ে উঠবে পারস্পরিক আন্তরিক সেবা-বিনিময়ের উপর ভিত্তি করে।
এই সেবা দেয়া বা নেয়া প্রধানত দুই ভাবে হতে পারে। একটা হলো স্বেচ্ছায় বা স্বপ্রণোদিতভাবে, আরেকটি হলো অনিচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে। সেবা প্রদানের পেছনে বস্তুগত যে কারণ থাকে তা হলো কর্মসংস্থান, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকা। দরিদ্র মানুষগুলি অবস্থাসম্পন্ন মানুষদের আনুগত্যে সমর্পিত হয় মূলত এ কারণেই, কিন্তু যখন এই আনুগত্য ও কাজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মার সংযোগ ঘটে, তখন এই সাহায্য সহযোগিতাগুলিই কর্তব্যবোধ, মানবতাবোধ, ভালোবাসা থেকে উৎসারিত হয়ে ইবাদতে পর্যবসিত হয়। অনাদিকাল থেকে মানুষ প্রধানত দু’টি কারণে অন্যের সেবা করে আসছে – প্রথমত তার প্রয়োজনে এবং দ্বিতীয়টি স্রষ্টার সন্তুষ্টির আশায় এবং দায়িত্ববোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ, কর্তব্যবোধ অর্থাৎ আত্মার তাগিদ থেকে। প্রথম প্রকারের সেবা ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না। আর দ্বিতীয় প্রকারের সেবা সে করে এসেছে দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। যেমন সন্তানকে বাবা-মায়ের তিলে তিলে বড় করে তোলা এবং বার্ধক্যে উপনীত বাবা-মাকে সন্তানদের সেবা। মানুষ কেবল যে তার বাবা-মায়ের কাছেই ঋণী তা নয়, সে তার জীবনে বহু বিষয়ের জন্য বহুজনের কাছে ঋণের জালে আবদ্ধ থাকে। যেমন শিক্ষাগুরু, যার কাছে মানুষ আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক শিক্ষা নিয়ে থাকে তাকে সেবা করা মানবসমাজের একটি চিরন্তন বিষয় ছিল যা এখন প্রায় বিলীয়মান। আত্মিক দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা থেকে মানুষ মানুষকে এমন সেবা করেছে যা মহত্ত্ব ও উচ্চতায় কখনও কখনও আকাশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জাগতিক প্রয়োজন ও আত্মিক প্রেরণা – এ দু’টির ভারসাম্য বজায় রেখে মানবসমাজে সেবার আদান-প্রদানই ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার শিক্ষা। কিন্তু মানুষ যুগে যুগে আল্লাহর দেওয়া শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে এই ভারসাম্যকে নষ্ট করেছে। ইবলিসের প্ররোচনায় সমাজের একটি শ্রেণি রাজশক্তি, ক্ষমতা, পেশীশক্তি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হয়ে; দরিদ্র, কমজোর মানুষকে জোর করে বাধ্য করতে আরম্ভ করেছে তাদের সেবা করার জন্য। জোর করে কাজ করানোর প্রক্রিয়া যখন আরম্ভ হলো ঠিক তখনই ভারসাম্য হারিয়ে গেল, সেবক হয়ে গেল দাস বা গোলাম (Slave), আর সেবা (Service) হয়ে গেল দাসত্ব (Slavery)। এই চরম ভারসাম্যহীনতা কখনও কখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে ঐ দাসদেরকে আর মানুষ বলেই মনে করা হতো না। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো রকম মূল্যই ছিল না, তাদেরকে পণ্যের মত হাটে-বাজারে কেনা বেচা করা হতো, তাদেরকে দিয়ে কাজ আদায়ের জন্য নির্মমভাবে নির্যাতন করা হতো এমনকি তাদেরকে হত্যা করাও কোনো অপরাধ হিসাবে গণ্য হতো না।
আরবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের নবযুগ সূচনা:
দাস হিসেবে মানুষ বেচা-কেনা মানবসমাজের একটি প্রাচীনতম ব্যবসা। আল্লাহর শেষ রসুল যখন আবির্ভূত হলেন তখনও আরবের একটি বড় ব্যবসা ছিল দাস ব্যবসা। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে জাহাজ ভর্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে বিক্রি করা হতো। এই দাসদের দুঃখ-দুর্দশা যে কী অবর্ণনীয় তা বর্ণনা করে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। বস্তুত যে সমাজে সেবাকে দাসত্বে রূপান্তরিত করা হয় সেই সমাজ একটা জাহান্নাম, আর যে সমাজে মানুষ মানুষকে ভালোবেসে সেবা করে যায়, অন্যকে সাহায্য করে, দান করে, খাইয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলামের সমাজ।
প্রমাণ: আম্মা খাদিজা (রা.) জাহেলি যুগে আরবের বাজার থেকে যায়েদ ইবনে হারিসাকে ক্রয় করেছিলেন। হুজুর পাক (দ.) এর সাথে বিয়ের পর তিনি যায়েদকে (রা.) স্বামীর সেবায় নিয়োগ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে রসুলাল্লাহ (দ.) যায়েদকে আযাদ করে দিলেন। কিন্তু যায়েদ (রা.) রসুলাল্লাহর সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। যায়েদের (রা.) চাচা-বাবারা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে মহানবীর (দ.) কাছে আসলেন। মহানবী (দ.) বললেন, ‘সে তো এখন মুক্ত, আপনারা তাকে নিয়ে যেতে পারেন।’ কিন্তু যায়েদ (রা.) ফিরতে রাজি হলেন না। কারণ তিনি মহানবীর (দ.) আচরণে ও ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবীর (সা.) সাথে ছায়ার মতো অনুবর্তী ছিলেন।
আনাস (রা.) যখন বালক ছিলেন তখন তাঁর মা ছেলেকে এই বলে রসুলাল্লাহর (দ.) কাছে তুলে দিলেন যে, ‘ইয়া রসুলাল্লাহ! ও আপনার কাছে থাকবে এবং আপনার সেবা করবে।’ এমন কথা কি কেউ কোনোদিন শুনেছে যে, একজন মা তার সন্তানকে এনে কারও দাসত্বে নিযুক্ত করেছে? ইতিহাস কখনো বলে না যে আনাস (রা.) রসুলাল্লাহর (দ.) দাস ছিলেন, বলা হয় খাদেম অর্থাৎ সেবক। আনাস (রা.) জীবনের একটা পর্যায়ে এসে ধনে, জনে, জ্ঞানে এতো সমৃদ্ধ হলেন মানুষ দূর দূরান্ত থেকে তাঁর কাছ থেকে রসুলাল্লাহর (দ.) জীবন সম্পর্কে, ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসত। তিনি রসুলাল্লাহর (দ.) জুতাগুলো পর্যন্ত পরম শ্রদ্ধায় পরিষ্কার করে দিতেন যা ছিল প্রকৃত সেবা, দাসত্ব নয়। এরপরে আছে ওমর (রা.) এর উদাহরণ। মদিনা থেকে যেরুজালেম প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার মরুপথে ওমরের (রা.) সঙ্গী ছিলেন একজন ব্যক্তি যাকে ইতিহাসে দাস বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ কেমন দাস যাকে মনিব উটের পিঠে উঠিয়ে উটের রশি ধরে উত্তপ্ত মরুর বালুকারাশির উপর দিয়ে পথ চলেন? আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, ‘তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের ভাই’। তাই দাস শব্দটি ইসলামের ক্ষেত্রে মোটেই প্রযোজ্য নয়। ইসলামে দাস- দাসীর কোনো ব্যবস্থা নেই। ইসলামের আইন হলো, জোরপূর্বক কাউকে কোনো কাজে বাধ্য করা যাবে না, বাধ্য করলে সে দণ্ডিত হবে। আল্লাহ হচ্ছেন মালিকুল মুলক, রাজ্য-সাম্রাজ্যের মালিক, মালিকিন্নাস (মানুষের প্রভু), মা’বুদ (যার দাসত্ব করতে হয়), একমাত্র রাব্বুল আলামীন (সৃষ্টি জাহানের একচ্ছত্র প্রভু)। সুতরাং কোনো মানুষ প্রকৃত অর্থে যেমন কখনও কারও প্রভু বা মালিক (Master, Lord) হতে পারে না, তেমনি কেউ কারও দাস বা গোলামও (Slave, Servant) হতে পারে না। কেবল সেবক, অনুচর, সাহায্যকারী, কর্মচারী (Attendant, Helper, Employee) হতে পারে। এবং সেই সেবক বা অনুচরদের সম্পর্কেই রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা খাও তাদেরকে তাই খাওয়াবে, তোমরা যা পরো তাদেরকে তাই পরাবে, অসুস্থ হলে তাদেরকে সেবা করবে।’ হুজুরের এই কথাগুলি নিছক উপদেশ ছিল না, এগুলি ছিল উম্মাহর প্রতি তাঁর হুকুম। এবং সকল আসহাবগণ রসুলের এই হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন। রসুলাল্লাহর শিক্ষাপ্রাপ্ত উম্মতে মোহাম্মদীর কেউ কোনো সেবককে নির্যাতন করেছেন এমন একটি দৃষ্টান্তও ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। কোনো সেবক তার মালিকের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে শাসকের কাছে নালিশ জানালে ন্যায়বিচার পেত। ইসলামে সেবকদের ধর্মীয় স্বাধীনতাও ছিল অবারিত।
অপরদিকে পৃথিবীতে যখনই বৈষয়িক উদ্দেশ্য ও মানবিকতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে তখনই মানুষ নিজেকে মালিক, প্রভু আর অধীনস্থদের দাস মনে করেছে। যখন মানুষ ভেবেছে যে, আমি সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে, বিধানের ঊর্ধ্বে, তখন সে চরম স্পর্ধায় নিজেই প্রভু হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনই সে তার অধীনস্থদের গলায় শিকল লাগিয়ে, চামড়া পুড়িয়ে মার্কা দিয়ে, কথায় কথায় চাবুক পেটা করে, নাক কেটে, বস্ত্রহীন রেখে, দিনের পর দিন অনাহারে রেখে, পশুর খোয়াড়ে বাস করতে বাধ্য করেছে।