প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আপনাদের সবাইকে স্বাগতম, আন্তরিক মোবারকবাদ, শুভেচ্ছা ও সালাম। আল্লাহ পাক মানব জাতির শান্তির জন্য, মুক্তির জন্য যুগে যুগে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আখেরি নবী, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা:) কে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। তাঁর শেষ রসুলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য তিনি কোর’আনের তিনটি আয়াতে সুস্পষ্টভাষায় বর্ণনা কোরেছেন। আল্লাহ তাঁর রসুলকে সঠিক দিক-নির্দেশনা ও সত্য জীবনব্যবস্থা দিয়ে প্রেরণ কোরেছেন এই জন্য যে, রসুল যেন পৃথিবীতে প্রচলিত অন্য সকল জীবনব্যবস্থার উপরে একে বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করার ফলে মানুষ অফুরন্ত সুখ, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, প্রগতি এক কথায় শান্তিতে বসবাস কোরতে পারবে। এই জন্য এই দীনের নাম আল্লাহ দিয়েছেন ইসলাম, ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি।
আল্লাহ শেষ নবীকে এই বিশাল দায়িত্ব দিলেন এবং ঐ দায়িত্বের সঙ্গে ঐ কাজ করার নীতি ও প্রক্রিয়া অর্থাৎ তরিকাও বোলে দিলেন। সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন প্রতিষ্ঠার নীতি হিসাবে আল্লাহ তাঁর রসুলকে দিলেন জেহাদ অর্থাৎ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম; এবং ঐ নীতির ওপর ভিত্তি কোরে একটি পাঁচদফার কর্মসূচি। ঐ পাঁচ দফা হোল- ১) ঐক্য, ২) শৃঙ্খলা, ৩) আনুগত্য, ৪) হেজরত, ৫) জেহাদ।
আল্লাহর রসুল ঐ নীতি ও কর্মসূচির অনুসরণ কোরে গড়ে তুললেন এক দুর্দম, দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় জাতি যার নাম হোল উম্মতে মোহাম্মদী। তিনি নিজে তাঁর জাতিকে সঙ্গে নিয়ে কর্মসূচি মোতাবেক কঠিন সংগ্রাম কোরে আরব ভূখণ্ডে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা কোরলেন। ফলে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হোল চূড়ান্ত শান্তি ও নিরাপত্তা। এরপর বাকি পৃথিবীর দায়িত্ব তিনি তাঁর জাতিটির উপর অর্পণ কোরে আল্লাহর কাছে গেলেন। তাঁর জাতি সংগ্রাম কোরে, সর্বস্ব ত্যাগ কোরে ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধ দুনিয়াতে সেই দীনকে প্রতিষ্ঠা কোরল। এই দীনটি প্রতিষ্ঠার ফলে অর্ধপৃথিবীতে মানুষের জীবন এবং সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হোল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তীতে আকিদা ভুলে যাওয়ার কারণে এই জাতি তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোল, তারা সেই পাঁচ দফা কর্মসূচি এবং সংগ্রাম দুটোই ত্যাগ কোরল।
এভাবে আমরা প্রকৃত ইসলাম থেকে বঞ্চিত ছিলাম দীর্ঘ তেরশ’ বছর। আল্লাহর অশেষ দয়া যে তিনি আবার তাঁর প্রকৃত ইসলাম এবং তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহর রসুলের দিয়ে যাওয়া সেই পাঁচ দফা কর্মসূচিও তাঁরই এক প্রিয় বান্দা এ যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মাধ্যমে আবার আমাদেরকে দান কোরেছেন। তিনি সেই সত্য ইসলামের ভিত্তিতে তিনি মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান কোরেছেন। তিনি বার বার বোলেছেন, ‘আমি কোন নবী না, রসুল না। আল্লাহর শেষ নবী মোহাম্মদ (দ:)। তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না। কিন্তু নবীর যে শিক্ষা ও আদর্শ হারিয়ে গিয়েছিল, মহান আল্লাহ সেই শিক্ষা আমাকে বোঝার তওফীক দিয়েছেন। সেটাই আমি তোমাদের সামনে তুলে ধোরেছি। আল্লাহর রসুল তাঁর জাতি উম্মতে মোহাম্মদীর উপরে যে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, আমি আখেরী নবীর একজন উম্মত হিসাবে তোমাদেরকে শুধু সেই দায়িত্বের কথাই স্মরণ কোরিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহর রসুল যে পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, এই জাতি তার বিপরীত দিকে চোলছে। আমি মানবজাতিকে আবার সেই মুক্তির প্রকৃত পথের দিকে আহ্বান কোরছি।’
সেই পাঁচ দফা কর্মসূচির প্রথমটি হোচ্ছে ঐক্য। তাই এই উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির এখন প্রথম কাজই হোচ্ছে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে। হুজুর পাক (স:) আরবের তৎকালীন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পরস্পর দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত ঐক্যহীন, ভ্রাতৃত্বহীন একটি জাতিকে আল্লাহর সত্যদীনের আওতায় এনে এমন একটি জাতিতে রূপান্তরিত কোরলেন যাদেরকে আল্লাহ কোর’আনে সীসাঢালা প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা কোরেছেন। রসুলাল্লাহ (দ:) বিদায় হজ্বের ভাষণে পরিষ্কার কোরে বোলে দিলেন, যারা জাতির ঐক্য নষ্ট কোরবে তারা কুফর কোরবে। আজ এই জাতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, জ্বালাও পোড়াও চোলছে তার পেছনে মূলত দায়ী আমাদের চরম অনৈক্য। ধর্মকে নিয়ে যারা ব্যবসা কোরছে, ধর্মকে যারা রুটি রুজির বাহন বানিয়ে নিয়েছে তারাই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন রকম তরিকা, ফেরকা, মাজহাব, মত-পথ সৃষ্টি কোরে জাতিকে হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত কোরে রেখেছে, উম্মতে মোহাম্মদীর নামক জাতির ঐক্যকে ধ্বংস কোরে দিয়েছে। আর পশ্চিমা পরাশক্তিগুলি আমাদেরকে শোষণ ও শাসন করার উদ্দেশ্যে তাদের তৈরি করা কিছু রাজনৈতিক মতবাদ আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের চাপিয়ে দেওয়া সেই তন্ত্র, মন্ত্র, বাদ মতবাদের উপর ভিত্তি কোরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে, উপদলে আমরা বিভক্ত হোয়ে আছি। অনৈক্যের পরিণাম হোচ্ছে পরাজয়। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে হোলে এখন আমাদের সামনে একটাই পথ, আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হোই, তাহোলে পৃথিবীর বুকে আমরা হবো একটি পরাশক্তি। সমস্ত বিশ্বকে আমরা নেতৃত্ব দেবো এনশা’আল্লাহ।
আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচির দ্বিতীয় দফা শৃঙ্খলা। আরবীতে এই দ্বিতীয় দফাটি হোচ্ছে ‘সামেয়ু’ বা শোনা। এর দ্বারা সতর্কতার সাথে কোন বিষয়ে সদা, সর্বদা সচেতন হোয়ে থাকা বোঝায়। যখন কিছু মানুষ কোন বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবে তখন সর্বপ্রথম যেটা প্রয়োজন- তাদের মধ্য যিনি নেতা থাকবেন তার কথা প্রত্যেকে শুনবে। এই শৃঙ্খলা ছাড়া ঐ ঐক্য এক মুহূর্তও টিকবে না। বর্তমানে আমাদের এই চরম বিশৃঙ্খল সমাজ ও জীবন থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে আল্লাহর দেওয়া নিয়ম শৃঙ্খলাগুলি মেনে চলার মানসিকতা তৈরি কোরতে হবে।
কর্মসূচির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোচ্ছে আনুগত্য। এই দীনে আনুগত্য হোল, আদেশ শোনামাত্র বিন্দুমাত্র ইতঃস্তত না কোরে সঙ্গে সঙ্গে সে আদেশ পালন করা। আনুগত্য হোচ্ছে একটি পরিবার, গোষ্ঠী বা জাতির মেরুদণ্ড, এটা যেখানে দুর্বল সেখানেই অক্ষমতা এবং ব্যর্থতা। এ নির্দেশ শুধু রসুলেরই নয়, এ নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহর। তিনি তাঁর কোর’আনে মো’মেনদের, উম্মতে মোহাম্মদীকে আদেশ কোরেছেনÑ আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্য থেকে আদেশকারীর (নেতার) আনুগত্য করো (সুরা নেসা ৫৯)। নির্দেশ পালন না করা হোলে ঐক্য ও শৃঙ্খলা যতোই নিখুঁত হোক সেটা অর্থহীন। আজকের পৃথিবীতে প্রায়শই দেখা যায়, কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখনই তার জাতিকে কোন আদেশ বা বিধান দেন, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এর বিরুদ্ধাচারণ ও সমালোচনা। কথিত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই বিরোধিতা অপ্রত্যাশিত বা অবৈধ কিছু নয় বরং এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈধ। কিন্তু নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে রসুলাল্লাহ বলেন, ‘কোন ক্ষুদ্রবুদ্ধি, কান কাটা, নিগ্রো, ক্রীতদাসও যদি তোমাদের নেতা নিয়োজিত হয়, তবে তার কথা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় শুনতে ও মানতে হবে।’ কারণ ঐ ব্যক্তি আল্লাহ এবং রসুলের প্রতিনিধি। তার আদেশ প্রকারান্তরে আল্লাহরই আদেশ।
কর্মসূচির চতুর্থ দফা হোচ্ছে হেজরত। হেজরত শব্দের অর্থ শুধু দেশ ত্যাগ করা নয়। হেজরত শব্দের অর্থঃ- “সম্পর্কচ্ছেদ করা, দল বর্জন করা, স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া ভিন্নদেশে গমন করা” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫৬০-৬১, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)। আল্লাহয় বিশ্বাসী অথচ মোশরেক আরবদের মধ্যে আবির্ভূত হোয়ে বিশ্বনবী যখন প্রকৃত তওহীদের ডাক দিলেন তখন যারা তাঁর সাথে যোগ দিলেন তারা আরবদের ঐ শেরক ও কুফর থেকে হেজরত কোরলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টিকারী বিভিন্ন দল, মত ও তন্ত্র-মন্ত্র থেকে আমাদের হেযরত কোরতে হবে। আল্লাহর নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজের একটি শ্রেণি ধর্মকে রুটি রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। আরেকটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধর্মকে নিজেদের ইচ্ছামত রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার কোরছে, এই সমস্ত ধর্মব্যবসায়ীদের থেকেও আমাদের হেযরত কোরতে হবে।
আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচির পঞ্চম দফা হোচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা। কর্মসূচির প্রথম চারটি দায়িত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই হোল জেহাদ করা। জেহাদ শব্দের অর্থ হোচ্ছে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। আমাদেরকে মানবজাতির জীবনে শান্তি আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
আজকের এই পবিত্র জুম’আর দিনে আমরা এই এলাকার মানুষ একটি কথার উপরে শপথ নেবো, আল্লাহর রসুলের রেখে যাওয়া পাঁচ দফা কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা ঐক্যবদ্ধ হবো। আমরা কেউ কারও ক্ষতি কোরব না, আমরা অন্যের সম্পত্তি নষ্ট কোরব না। অন্যায়ভাবে কারও সম্পত্তি গ্রাস কোরব না। আমরা ধর্মকে কারও স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হোতে দেব না। আমরা কারও প্ররোচণায় কোনরূপ জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও সহিংসতা কোরব না। আমরা কোন রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, রেললাইন নষ্ট কোরব না। মনে রাখতে হবে, এগুলি আমাদের জাতির সম্পদ। আমরা আমাদের জীবনে, কাজে কর্মে চিন্তায় ব্যবহারে হবো সুশৃঙ্খল। আমরা আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য কোরব। আমরা সকল প্রকার মিথ্যা, অন্যায় মতবাদের অপ-রাজনীতি পরিত্যাগ কোরব। আমরা মৃত্যু পর্যন্ত সকল অন্যায় অবিচার ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কোরে যাবো এনশা’আল্লাহ।