কাজী নজরুল ইসলাম
আগুন যেমন ধাতুকে পুড়িয়ে খাঁটি করে; দুঃখও তেমনি আত্মাকে একেবারে আয়নার মত সাফ করে দেয়। কিন্তু তাই বলে’ মনের সব কষ্টই দুঃখ নামে অভিহিত হতে পারে না। মোটামুটি দেখতে গেলে দুঃখ দু’রকমের। একটি হচ্ছে নিজের কষ্টের জন্য দুঃখ পাওয়া, অন্যটি হচ্ছে অন্যের কষ্টে দুঃখ অনুভব করা। এই দুই দুঃখই কষ্ট দেয়; কিন্তু তারা এক রকমের নয়।
আমি হয় তো আমার প্রিয়তম জিনিসটাকে হারিয়েছি, কিংবা আমি যা চাই তা পাই না, এই রকম সবের জন্যে যে কষ্ট পাওয়া, সেই হচ্ছে নিজের জন্যে দুঃখ। এর ফল, আত্মাভিমান এবং আত্মসুখের বৃদ্ধি। অন্যের দুঃখ দেখে নিজের দুঃখ মনে পড়া আর তার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়া, ক্রমে নিজের কষ্টকে তুচ্ছ করে এই পরের কষ্টটাকে বড় করে দেখা, এই সব সহৎ অনুভবের ফল হচ্ছে আত্মার, প্রাণের প্রসারতা লাভ। একদিন এক বিধবা তার মরা ছেলেকে বুকে নিয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছে কেঁদে পড়ল যে, তার ঐ একমাত্র মৃতপুত্রকে বাঁচিয়ে দিতে হবে। বুদ্ধদেব বললেন, “দুঃখ নেই শোক নেই এমন কোন ঘর হতে কয়েকটি বিল্বপত্র যদি এনে দিতে পার, তা হলে তোমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দেব।” বিধবা অনেক খুঁজেও দুঃখ শোকের ছোঁয়া লাগেনি এমন কোন ঘর দেখতে পেলো না। তাই তিন দিন পরে যখন এই পুত্রহারা জননী ফিরে এল, তখন সে বিশ্বের দুঃখ কষ্টের মাঝে নিজের দুঃখের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে, আর তার ঐ সসীম বুকেই অসীমের বীণের গুমরে ওঠা বেদনার নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে। সে তখন আর নিজের সন্তানের জন্য দুঃখ করছে না; তার মাতৃস্নেহে সারা বিশ্বে তখন ছড়িয়ে পড়েছে!
অন্যের দুঃখে বেদনা অনুভব করাই হচ্ছে মহত্তর ব্যথার অনুভব। কেননা ব্যথার ব্যথীর এ ব্যথায় কোন উদ্দেশ্য বা স্বার্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। তার কারণ, এ হচ্ছে সেই ব্যথা, যার অনুভব হয় নিজের বুকের বেদনা মনে পড়ে। আত্মার ধর্ম এমনি বিস্ময়কর যে, এই পরের ব্যথায় ব্যথিত হওয়াতেও সে এমন একটি নিবিড় আনন্দের আভাস পায়, যেন রক্তমর্মর বুকে ঝর্ণাধারার একটি স্নিগ্ধ দীঘল রেখা!
এই সেই দুঃখ যা পয়গান্বরগণ (prophets)) বিশ্বমানবের অন্তরে অন্তর মিশিয়ে অনুভব করেছিলেন। এর বেদনা এর আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই। এই হচ্ছে সেই সাধনা যা মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে। এই বেদনায় গভীর আন্তরিকতাতেই ত্যাগের নির্বিকার প্রশান্তি, এই চির-ব্যথার বনেই আনন্দ-স্পর্শমণি খুঁজে পাওয়া যায়!
সকলেই এ অমৃতময় দুঃখ অনুভব করতে পারে না। মহত্তর আত্মা যাঁদের, ভুক্তভোগী যাঁরা, শুধু তাঁরাই এ হেঁয়ালীর মর্ম বোঝেন। এ চায় কল্পনা আর মানব-মনের বিস্ময়কর বোধশক্তি। তাই এ-পথের ভাগ্যবান পথিক তাঁরাই যাদের হাতে গভীর জ্ঞান আর উঁচু প্রাণের পাথেয় আছে।
অনেক রকমের দুঃখ-কষ্ট আমাদের বুকের বেদন দিয়ে সারা বিশ্বের ব্যথা নিজের করে নিতে পারি, কেবল তখনই আমাদের আত্মা উন্নত প্রসারিত হয়। তখনই আমরা সত্যকে চিনি, সুন্দরকে উপলব্ধি আর তাই তখন আমাদের আনন্দ ত্যাগে, পরের জন্যে কেঁদে, বিশ্বের ব্যথিতের জন্য জান্ কোরবান করে’!