রাকীব আল হাসান:
মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে ন্যূনতম জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেকবোধ, যুক্তিবোধ দিয়েছেন; এটা ব্যবহার করেই আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর করি, সঠিক-ভুল বিবেচনা করে পথ চলি। এই বুদ্ধিটুকু ব্যবহার করেই আমাদের স্বার্থ আমরা বুঝে নিই, লাভ-লোকসানের হিসাব মিলিয়ে নিই। দোকানে কিছু কিনতে গেলে ভালো জিনিসটি বাছাই করে নিয়ে আসি, যা-তা দিয়ে দিলেই আমরা নিয়ে চলে আসি না। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে আমরা আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা তেমন খাটাই না, মসজিদের ইমাম সাহেব, পীর সাহেব, দলের আমীর সাহেব, এলাকার মোল্লা বা ওয়াজের বক্তা আমাদেরকে যা বলেন আমরা তাই ইসলাম হিসাবে গ্রহণ করে নেই, একবারও যুক্তি দিয়ে বিচার করি না, কোর’আন-হাদিসের সাথে মিলিয়ে দেখি না যে সেই বক্তা সঠিক বললেন নাকি ভুল বললেন। এজন্য প্রথমেই অনুরোধ করব, মহান আল্লাহ আপনাকে যে বুদ্ধিটুকু দিয়েছেন, যুক্তিবোধটুকু দিয়েছেন সেটা দিয়ে আমার কথা যাচাই করে নিবেন এবং আমার দেওয়া রেফারেন্সগুলো কোর’আনের সাথে মিলিয়ে নিবেন।
ছোটবেলা থেকে আমরা ওয়াজ-মাহফিল, জুম’আর খুতবা ইত্যাদিতে শুনে আসছি যে, এটা করলে এত নেকি, ওটা করলে এত নেকি ইত্যাদি। ওয়াজ শুনে আমরা আমল শুরু করে দেই, অনেক নেকি কামাই করি, কিন্তু একবারও কি এই প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগে না যে, কত নেকি কামাই করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে? হয়ত আপনি দশটা পর্বতের সমান নেকি কামাই করেছেন কিন্তু সেটা কি আপনাকে জান্নাতে নিতে পারবে? যদি জান্নাতেই যেতে না পারেন তাহলে নেকি দিয়ে আপনি কী করবেন? চলুন জেনে নেই কে জান্নাতে যাবে।
মহান আল্লাহ বলেছেন, “তিনিই (আল্লাহ) তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের এবং কেউ মো’মেন। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।” (সুরা তাগাবুন- ২)। অর্থাৎ মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ দুই প্রকার। মো’মেন ও কাফের। সমগ্র কোর’আনে যত নির্দেশ, যত প্রতিশ্রুতি, যত সুসংবাদ আল্লাহ দিয়েছেন সব দিয়েছেন কেবল মো’মেনদের জন্য, কাফেরদের জন্য কোনো দির্দেশ নেই, কাফেরদের জন্য রয়েছে কেবল সাবধানবাণী, জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আযাবের দুঃসংবাদ। আল্লাহ রোজা ফরজ করেছেন মো’মেনদের জন্য (সুরা বাকারা- ১৮৩), নামাজ কায়েম করতে বলেছেন মো’মেনদেরকে (সুরা বাকারা- ১৫৩; সমগ্র কোর’আনে বহু জায়গাতেই আছে, এখানে শুধু একটা উল্লেখ করেছি), যাকাত আদায় করতে বলেছেন মো’মেনদেরকে (সুরা বাকারা- ২৫৪, ২৬৭; সমগ্র কোর’আনে বহু জায়গাতেই আছে), আল্লাহ গোনাহ ক্ষমা করবেন এবং জান্নাতে দাখিল করবেন মো’মেনদেরকে (সুরা তাহরীম- ৮; মো’মেনদের আল্লাহ জান্নাত দিবেন এটা সমগ্র কো’আনে বহু আয়াতেই আছে)।
তাহলে এটা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, জান্নাতে যাওয়ার জন্য নেকি কামানোর দরকার নেই বরং প্রয়োজন হলো মো’মেন হওয়া। এখন আমাদেরকে দেখতে হবে আমরা মো’মেন আছি কি না, যদি মো’মেন না থাকি তাহলে যত আমলই করি না কেন আমাদের জন্য জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। চলুন দেখি এবার, কোর’আনের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা মো’মেন আছি কি না।
আল্লাহ সুরা নূরের ৫৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আল্লাহর ওয়াদা (ওয়াদাল্লাহ) হচ্ছে যারা ঈমান আনবে এবং আমলে সালেহ করবে তাদেরকে আল্লাহ পৃথিবীর কর্তৃত্ব (খেলাফত, Authority, Power) প্রদান করবেন, যেমনটি তিনি দিয়েছিলেন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি তোমাদের দীনকে প্রতিষ্ঠা করবেন যেটা তিনি তোমাদের জন্য পছন্দ করেছেন। তোমাদের ভয়-ভীতি দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করবেন। সেখানে তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা (এ বিশাল নেয়ামতকে) অস্বীকার করবে, তারাই ফাসেক ও অবাধ্য।”
তিনি আরো বলেছেন, “আল্লাহ মো’মেনদের ওয়ালি (অভিভাবক, বন্ধু, রক্ষক, Protector) (সুরা ইমরান ৬৮)”। বলেছেন, “তোমরা হতাশ হয়ো না, নিরাশ হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে- যদি তোমরা মো’মেন হও (সুরা ইমরান ১৩৯)। বলেছেন, “মো’মেনকে সাহায্য করা আমার হক, কর্তব্য (সুরা রুম ৪৭)”।
আমরা যদি মো’মেন হই তাহলে কোর’আনের ভাষ্য অনুযায়ী আমাদের হাতে পৃথিবীর কর্তৃত্ব থাকার কথা (তিনি কর্তৃত্ব দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন যেমন দিয়েছিলেন আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে)। আমরা যদি মো’মেন হই তাহলে আল্লাহ আমাদের অভিভাবক হবার কথা, আল্লাহ আমাদের অভিভাবক হলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা লাঞ্ছিত, অপমানিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত হবার কথা নয়। আল্লাহ আমাদেরকে বিজয় দিবেন এবং সর্বদা সাহায্য করবেন বলেও ওয়াদা করেছেন। কিন্তু এ পৃথিবী জোড়া মুসলিম জাতির করুণ দুর্দশা দেখলে যে কারো মনেই আল্লাহর এ সকল ওয়াদা সম্পর্কে প্রশ্ন আশা স্বাভাবিক, আমরা যারা নিজেদেরকে মো’মেন মুসলিম বলে দাবি করি, পরকালে আমরাই জান্নাতে যাব বলে বিশ্বাস করি এবং আমরাই আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমরাই তাহলে পৃথিবীর সর্বত্র সকল জাতির হাতে গত কয়েক শতাব্দী থেকে মার খাচ্ছি কেন? একে একে আমাদের আবাসভ‚মিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সর্বহারা উদ্বাস্তু হচ্ছি আমরা মুসলমানরা। ধর্ষিতা হচ্ছে মুসলিম নারীরা। পানিতে ভেসে যাচ্ছে মুসলিম শিশুরা। তবে কি আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন? কিংবা আল্লাহ কি ভুলে গেছেন তাঁর কৃত প্রতিশ্রুতির কথা? নাকি তিনি মুসলিমদের উদ্ধার করতে অক্ষম? (নাউযুবিল্লাহ)।
না, সেটা অসম্ভব। তিনিই বলেছেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তাঁর চেয়ে সত্যবাদী আর কে আছে (সুরা তওবা- ১১১)। তিনি কখনও অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না, পূর্ববর্তী মোমেনদের ইতিহাস তার প্রমাণ। তিনি সব দেখেন, সব শোনেন, সব খবর রাখেন, তিনি প্রতাপশালী সূ² হিসাবদর্শী। এজন্য তাঁর নাম সামিউম বাসীর, আলিমুল গায়েব, আজিজুল জাব্বার, জাল্লে জালাল, লতিফুল খাবীর, তিনি শাইয়্যিন কাদির। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাহলে প্রকৃত ব্যাপারটা কী?
যুক্তিশীল মানুষের কাছে প্রশ্ন করলে এর একটাই উত্তর পাওয়া যাবে, তা হলো- আমরা আসলে মো’মেন নেই, আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতিগুলো আমাদের জন্য নয়। আমরা মো’মেন নেই মানেই হলো জাতিগতভাবে আমরা কার্যত কাফের-মোশরেক হয়ে আছি আর আমাদের দুনিয়া যেমন লাঞ্ছনাদায়ক তেমনি সকল আমলসহ আমাদেরকে পুড়তে হবে জাহান্নামে। তাহলে জানা দরকার কেন আমরা মো’মেন নেই, কী আমাদের গলদ?
যারা ইতিহাস জানেন তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরব সমাজের মানুষগুলোও আল্লাহতে বিশ্বাস করত (নিজেদের নাম রাখত আব্দুল্লাহ তথা আল্লাহর বান্দা), নামাজ পড়ত, রোজা রাখত, খাৎনা করত, হজ্ব করত, নিজেদেরকে আল্লাহর নবী ইব্রাহিম (আ.) এর উম্মত বলে দাবি করত তবু আল্লাহর ভাষায় তারা কাফের-মোশরেক ছিল। তারা যে আমাদের মতোই আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- “তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ)” (সুরা যুখরুফ- ৯)। অন্যত্র বলেছেন- “তুমি যদি তাদের প্রশ্ন করো আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন এবং কে সূর্য ও চন্দ্রকে তাদের (কর্তব্য কাজে) নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে- আল্লাহ” (সুরা আনকাবুত- ৬১)। এমন আরও অনেকগুলি আয়াত এবং ইতিহাস থেকে দেখা যায় সেই মোশরেকদের আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের ওপর ঈমান ছিল। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) এসে তাদেরকে কাফের-মোশরেক বলে সম্বোধন করলেন এবং তওহীদের দিকে আহ্বান করলেন। অর্থাৎ তারা তওহীদের উপর ছিল না বলেই তারা কাফের-মোশরেক ছিল। রসুলাল্লাহ (সা.) তাদেরকে বললেন, “কুল- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” অর্থাৎ “বলো- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই।” এটিই হলো তওহীদ। যারা মেনে নিল যে, তারা আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম মানবে না তাদের জন্য একটা একটা করে আল্লাহ হুকুম পাঠাতে লাগলেন। তাদের উপরে প্রথম কর্তব্য এসে পড়ল এই তওহীদকে জীবন-সম্পদ দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। যখন তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠর অধ্যবসায়, নিরন্তর সংগ্রাম, জান-মালের কোরবানির বিনিময়ে সমাজে এই তওহীদ তথা আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত হলো তখন সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, যুলুম, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি সব দূর হয়ে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। যারা এই কাজটি করলেন তারা হলেন মো’মেন, মুসলিম, মোজাহেদ, উম্মতে মোহাম্মদী। রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় সমস্ত আরব উপদ্বীপে সংগ্রামের মাধ্যমে এই সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর এই দীনকে জান-মাল দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব এসে পড়ল সেই মো’মেন জাতির উপর। এ জন্য আল্লাহ পাক মো’মেন হবার শর্তই দিয়েছেন ঈমান আনার পর জীবন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করা। অর্থাৎ যারা আল্লাহকে হুকুমদাতা (ইলাহ) হিসাবে এবং মোহাম্মদ (সা.) কে রসুল হিসাবে স্বীকৃতি দিবে এবং কোনো সন্দেহ রাখবে না, জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করবে এই সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য তারাই মো’মেন (সুরা হুজরাত- ১৫)।
আমাদের গলদটা এখানেই- আমরা আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবেও মানছি না আর সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা তো অনেক দূরের কথা। কাজেই আমরা কীভাবে নিজেদেরকে মো’মেন বলে দাবি করতে পারি? যখন থেকে আমরা ব্রিটিশদের অধীন হয়েছি তখন থেকেই আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি পাশ্চাত্য খ্রিষ্টানদের তৈরি করা হুকুম, বিধান, সুদভিত্তিক অর্থনীতি, স্বার্থবাদী হানাহানির রাজনীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যবস্থা, বস্তুবাদী-ভোগবাদী শিক্ষাব্যবস্থা এক কথায় সার্বিক জীবনব্যবস্থা, তন্ত্র-মন্ত্র। তখন থেকেই মো’মেনের খাতা থেকে আমাদের নামটা কাটা পড়েছে। এখন যত আমলই করি না কেন, যত নেকিই কামাই করি না কেন যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে স্বীকৃতি না দেব এবং তওহীদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ না করব ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মো’মেন হতে পারব না। হেযবুত তওহীদ মানুষকে সেই তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানাচ্ছে।