রিয়াদুল হাসান:
হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী কবি নজরুলের চেয়ে বয়সে ২৬ বছরের ছোট ছিলেন। এমামুযযামান গান ভালোবাসতেন, তরুণ বয়সে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে নিয়মিত গান শিখতেনও। একই ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলেন কবি নজরুলও। এমামুযযামান এক সময় ধ্রুপদি সঙ্গীতের শিল্পী হোতে চেয়েছিলেন, এগিয়েছিলেনও বেশ কিছুদূর কিন্তু সঙ্গীতের জগতে তিনি বিলীন হোয়ে যান নি। কারণ তাঁকে নিয়ে আল্লাহর ছিল অনেক বড় একটি পরিকল্পনা।
জীবন পথের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য বিষ্ময়কর অভিজ্ঞতা এমামুযযামানের জীবনকে ঋদ্ধ কোরেছে। কবি নজরুলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও ভক্তি এমামুযযামানের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিচারণে আমরা লক্ষ্য কোরেছি, কবিকেও চিনতে পেরেছি নতুন আলোকে।
এমামুযযামান কবে প্রথম কবির সাক্ষাৎ তা আমার জানা নেই। ১৯৭২ সনের ২৪ মে কবিকে যখন ঢাকায় নিয়ে আসা হয়, তখন তার চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্য ছিলেন ছয়জন চিকিৎসক। এদের মধ্যে মাননীয় এমামুযযামানও ছিলেন একমাত্র হোমিওপ্যাথ। ইতোপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য থাকার সুবাদে রাজনৈতিক অঙ্গনে চিকিৎসক হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু এমামুযযামানকে বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করেন। কবি তখন ঢাকার পিজি হাসপাতালে। অনেক লোক কবিকে দেখতে আসতেন। চোখের দেখা। কবি তখন কাউকে চিনতে পারতেন না, কথাও বোলতে পারতেন না। এর উপরে ঘুমের ওষুধের ক্রিয়ায় তিনি প্রায় সময়ই অচেতন হোয়ে ঘুমাতেন। এমামুযযামান বোর্ডের অন্য চিকিৎসকদেরকে বলেন ঘুমের ওষুধ না দিতে। কারণ জোর কোরে স্নায়ুকে অচেতন কোরে ঘুম পাড়িয়ে লাভ নেই, সুস্থতার জন্য দরকার স্বাভাবিক নিদ্রা। এজন্য তিনি বেশ কয়েকদিন নিজের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী চিকিৎসা করেন। কবির ঘুম স্বাভাবিকও হোয়ে আসে। কিন্তু দর্শনার্থী এত বেশী আসতে থাকে যে তিনি ঘুমাতে পারতেন না। এজন্য এমামুযযামান হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের প্রতি কড়া হুকুম দেন যেন কোন দর্শনার্থীকেই অনুমতি না দেওয়া হয়। কিন্তু যারা সেখানকার কর্তৃপক্ষ তারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবের কাছে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের লোভ সামলাতে না পেরে প্রচুর দর্শনার্থীকে কবি-দর্শনের সুযোগ প্রদান কোরতে থাকেন। এই আবেগের আতিশায্যের কারণে কবির চিকিৎসার বিরাট ত্রুটি হোয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় এ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকরা আবার বাধ্য হন কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে কবিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে।
এমামুযযামানের চিকিৎসাকালীন সময়ে আল্লাহর ইচ্ছায় কবির শরীর বেশ খানিকটা সুস্থ হোয়ে উঠেছিল। এমামুযযামান প্রায়ই গর্ব কোরে বোলতেন, ‘তোমরা কি জানো–আমি বোধ হয় বর্তমানে একমাত্র ব্যক্তি যে নজরুলের হাতে চড় খেয়েছি।’ কবির হাতের চড় খাওয়ার স্মৃতিচারণ কোরতে গিয়ে এমামুযযামান খুব হাসতেন। ঘটনাটি হোচ্ছে- চিকিৎসা চলাকালে একদিন কবিকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েছিলেন এমামুযযামান। কবি কিছুতেই ওষুধ খেতে চান না। এমামুযযামান দু’একবার চেষ্টা কোরতেই কবি এমামুযযামানের গালে একটি জোরে চড় বসিয়ে দেন। ওষুধ আর খাওয়ানো হয় না। তাঁকে নজরুল ইসলাম চড় দেওয়ার পরও তিনি মোটেই ক্ষুব্ধ হোলেন না, বরং যখনই তিনি নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গে বোলতেন এই স্মৃতি তাঁকে পুনর্বার গভীরভাবে পুলকিত কোরত। একেই বলে ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং অহঙ্কারহীনতা। এমামুযযামান বোলতেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা কোরে গেছেন বোলে তাঁর সঙ্গীতের সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ চর্চা করার একটি সুবন্দোবস্ত হোয়েছিল। কিন্তু নজরুল এমন কোন প্রতিষ্ঠান করার সুযোগ পান নি, তাই তাঁর বহু গান এখন হারিয়ে গেছে। যেগুলি আছে সেগুলিও বিকৃত হোয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টি উপলব্ধি কোরে তিনি এবং আরও বেশ কয়েকজন ঢাকায় কবি তালিম হোসেনের বাসা থেকে নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের আজীবন সদস্য ছিলেন।
বিভিন্ন কথাপ্রসঙ্গে এমামুযযামান নজরুলের কবিতা ও গানের মধ্য থেকে কিছু কিছু লাইন উদ্ধৃত্ত কোরতেন। যেমন এমামুযযামান তাঁর ‘বাঘ-বন-বন্দুক’ নামক শিকার কাহিনীর বইতে। কোলকাতা চিড়িয়াখানায় একটি বাঘ হঠাৎ খুব হাঁক ডাক আরম্ভ করে। তার এমন আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গি দেখে দর্শনার্থিরা খুব আতঙ্কিত হোয়ে যায়। কিন্তু এমামুযযামান ছোটবেলা থেকেই চিতাবাঘ পুষতেন। তাই বাঘের ভাষা, আচরণ সম্পর্কে তাঁর ছিল খুব জানাশোনা ছিল। মানুষজনের আতঙ্ক দেখে খাচাটির কাছে গেলেন। তিনি লিখেছেন, “খুব আস্তে ওকে ডাকলাম। চম্কে ফিরে চাইল। বিষ্ফোরিত দৃষ্টি। আমাদের কাউকে কাম্স্কাটকায় দু’বছর বাস করবার পর হঠাৎ যদি রাস্তায় কেউ বাংলা ভাষায় তাকে ডাকে তবে যে রকম মুখের ভাব হবে তেমনি। কবির ভাষায় “আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী।” ঠায় বসে তাকিয়েই রইল। পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর চোখের পানে তাকিয়ে আবার ডাকলাম, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সোজা চলে এল এপাশে। তারপরে বের হয়ে আমার কাছে আসার কি চেষ্টা। একবার এদিকে যায়, একবার ওদিকে যায়।”
এরপরে এমামুযযামান খাচার জালের ছোট ছোট ফাঁকের মধ্য দিয়ে আঙ্গুল গলিয়ে যতটুকু পারা যায় ওর ঘাড় চুলকে দিতে লাগলাম। লোকজন আশ্বস্ত হোয়ে চোলে গেল।
এমামুযযামানের খুব প্রিয় একটি গান ছিল, ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান।’ গানটি (সম্ভবত) প্রথম রেকর্ড আব্বাস উদ্দিনের। পরে আরও অনেকেই গেয়েছেন। তিনি বোলেছিলেন, এই গানের যতগুলি রেকর্ড পাওয়া যায় সংগ্রহ কোরতে। সেই হিসাবে আমরা ৫/৬টি রেকর্ড সংগ্রহ কোরেছিলাম। এর মধ্যে থেকে তিনি আব্বাস উদ্দিন ও খালেদ হোসেনের গাওয়া রেকর্ড দু’টি আমাদের সবাইকে শুনতে বলেন। তিনি আরও একটি গান আমাদেরকে সংগ্রহ কোরতে বলেন, ‘শহীদি ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারি, হবে সারা দুনিয়ায় এসলামী ফরমান জারি’। এ গানটির কথা সংগ্রহ করা গেলেও রেকর্ড সংগ্রহ কোরতে পারি নি এখনও।