হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জাতীয় চরিত্রের উন্নয়ন ঘটাতে শিক্ষাব্যবস্থা কেন ব্যর্থ

মোসলেম উদ্দিন:
যদি কোনো রাষ্ট্র বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের প্রধান খাতগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সমাজে অন্যায় ও অবিচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, নাগরিকদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের বদলে বিভেদ আর হানাহানি বৃদ্ধি পায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রতারণা ও ছলচাতুরিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তবে অবশ্যই সে রাষ্ট্রের শিক্ষিত সমাজের উপর এ দায় বর্তায়। এতে স্পষ্ট হয় যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই কোনো না কোনো ত্রুটি রয়েছে।

বর্তমানে এই বাস্তবতা প্রায় সর্বমহলে স্বীকৃত। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে, এ কথা শুধু সাধারণ শিক্ষা নয়, মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। যারা এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন, তাদের সাথে তর্কে না গিয়ে কেবল অনুরোধ করব, আমাদের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে। প্রতিবছর এই ব্যবস্থা থেকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকারের সৃষ্টি হচ্ছে। যারা চাকরিতে প্রবেশ করছে, তাদের অধিকাংশই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ঊর্ধ্বতনের আদেশে ভয়াবহ অন্যায় অবলীলায় করে যাচ্ছেন শিক্ষিতরা। কেউ প্রশ্ন করলে বেহায়ার মত উত্তর দেন- কী করব ভাই, চাকরি করি। জাল সার্টিফিকেট দিচ্ছে শিক্ষিতরা। ফলে ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া ব্যারিস্টার, ভুয়া প্রফেসর ধরা পড়ছে ভুরি ভুরি। এমনকি এম ফিল, পিএইচডি’র থিসিস পর্যন্ত চুরি করছেন শিক্ষিতরা। একটা সামান্য পদোন্নতির জন্য জঘন্য নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এজন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও শিক্ষাবিদেরা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এই শিক্ষিত শ্রেণি ব্যবসা করতে গিয়ে ট্যাক্স, ভ্যাট ফাঁকি, ব্যাংক ঋণ খেলাপি, প্রতারণা, শেয়ার মার্কেট জালিয়াতি, অর্থপাচারসহ নানাবিধ আর্থিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, এমনকি খুন পর্যন্ত করেন। উচ্চশিক্ষিত ব্যাংকার সমগ্র ব্যাংক লুটেপুটে খেয়েছেন। ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বড় বড় আমলারা ভয়ানক দুর্নীতি করে ধরা পড়েছেন। উচ্চশিক্ষিত বহু ডিগ্রিধারী রাজনৈতিক নেতারা সুযোগ পেয়ে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে সমগ্র দেশটাকে দেউলিয়া করে ছেড়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, শিক্ষিতরা কি সত্যিই দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী, কিংবা নতুন উদ্ভাবনের পথিকৃৎ হচ্ছেন? না হলে কেন হচ্ছেন না? উত্তর সহজ- শিক্ষাব্যবস্থার গলদ।

অন্যদিকে মাদ্রাসাকে নৈতিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দাবি করা হলেও বাস্তবে সেখান থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র বা সমাজের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। ‘তওহীদী জনতা’র নামে গণহিংস্রতা বা মব সৃষ্টির মাধ্যমে জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাটের মতো কর্মকাণ্ডেও তারা যুক্ত হচ্ছে ও নেতৃত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের অনেকে নৈতিক স্খলনের শিকার হয়ে দুর্নীতি, প্রতারণা, ঘুষ, মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি নারী ও শিশু ধর্ষণ, বলাৎকারের মতো ভয়াবহ অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। ইদানীং মাদ্রাসা শিক্ষিতদের কেউ কেউ নাস্তিক ও ইসলাম-বিদ্বেষী পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ কী? নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিই এর জন্য দায়ী।

বস্তুত, একটি রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফরাসিদের জন্য সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন, যেখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যশীল করে গড়ে তোলা। কারণ তিনি তার জাতিকে বিশ্বজয়ের পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্য কী, অথবা আদৌ কি রাষ্ট্রের কোনো সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে? যদি লক্ষ্য নির্ধারণ করা না হয়, তবে সেটি সবার আগে ঠিক করতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে কী ধরনের নাগরিক প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করেই উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত।

এটি ঐতিহাসিক সত্য যে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে এবং এর পেছনে ছিল একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ শাসকদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের শাসনব্যবস্থার সহায়ক একটি কেরানি শ্রেণি তৈরি করা। পাশাপাশি বিকৃত ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে মুসলমানদের চিরস্থায়ীভাবে গোলামে পরিণত করাও ছিল তাদের মাদ্রাসা স্থাপনের উদ্দেশ্য। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা সেই ব্রিটিশ যুগের ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থাই তার ভিত্তিসহ বহন করে চলেছি। এর নেতিবাচক পরিণতি আজকের শিক্ষিত সমাজে স্পষ্টতই দেখা যায়; সেটা হল তাদের অসততা, নৈতিক অবক্ষয়, দেশপ্রেমহীনতা, স্বার্থপরতা, অপরাধপ্রবণতা; সেই সাথে রয়েছে তাদের সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের অভাব যে কথা শুরুতেই বলেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার একেবারে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ বর্তমান সমস্যাগুলোর মূল কারণ শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ায় নিহিত। এটি কেবল আংশিক সংস্কারে সমাধান হবে না; বরং শিক্ষার ভিত্তি, লক্ষ্য এবং কাঠামো নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।

ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে যখন সামরিকভাবে পদানত করল তারা এই জনগোষ্ঠীকে চিরস্থায়ীভাবে তাদের দাসে পরিণত করার জন্য পাশাপাশি দুটো ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল। একটি হল মাদ্রাসা শিক্ষা, আরেকটি হল সাধারণ শিক্ষা। ১৭৮১ সালে কলকাতায় লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার সিলেবাস কারিকুলাম খ্রিষ্টান পণ্ডিতরাই (Orientalist) তৈরি করে দেন। টানা ১৪৬ বছর ধরে ২৭ জন খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ এই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদে থেকে মুসলমানদেরকে ‘ইসলাম’ শিক্ষা দিয়েছেন। এটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না যে, তারা যেটা শিখিয়েছেন সেটা আল্লাহ রসুলের প্রকৃত ইসলাম ছিল না। সেটা কী ধরনের ‘ইসলাম’ ছিল তা নিয়ে আমাদের একটি ভিন্ন বই রয়েছে যার নাম- ‘ঔপনিবেশিক যুগের ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থা’। সবচেয়ে বড় যে বিকৃতি সেখানে ছিল সেটা হচ্ছে, এই মাদ্রাসায় জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো প্রকার কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া হল না। শুধু মাসলা-মাসায়েল দিয়ে তো সংসার চলে না। ফলে ঐ মাদ্রাসা থেকে শিক্ষিতরা ধর্মকেই তাদের জীবন জীবিকার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে বাধ্য হল। আজও সেই ব্যবস্থা চালু আছে। মাদ্রাসা থেকে যারা পড়াশোনা করে বেরিয়ে আসছেন তাদের কর্মসংস্থানের জন্য আজও তেমন কোনো কার্যকর বন্দোবস্ত হয়নি। সেক্যুলার সরকারগুলো নানা সময়ে রাজনৈতিক স্বার্থে তাদেরকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিলেও মসজিদ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো উপায় সৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রধান চার ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে- কওমি, আলিয়া, ফোরকানিয়া/নুরানি ও হাফিজিয়া। এর বাইরেও বিভিন্ন মাজহাব ফেরকা বা তরিকার নিজস্ব মাদ্রাসা রয়েছে যেমন সালাফি মাদ্রাসা, আহলে হাদিস মাদ্রাসা, ছারছিনা মাদ্রাসা ইত্যাদি। এই মাদ্রাসাগুলির আমল, আকিদা, চিন্তা চেতনা, শিক্ষা পদ্ধতি একেক রকম।

একইভাবে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও মাদ্রাসার মতো বহুরকম বিভক্তি রয়েছে। যেমন- ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, পাবলিক ইউনিভার্সিটি। ইংলিশ মিডিয়ামের সিলেবাস কারিকুলাম তৈরি করা হয় ইউরোপের স্কুলগুলোর অনুকরণে। এই সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াও সেই ঔপনিবেশিক যুগে। তখন প্রশাসনিক দপ্তরগুলোতে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের ফাইফরমাস খাটার জন্য, তাদের কেরানি ও দোভাষীর কাজ করার জন্য একদল দেশীয় লোককে ইংরেজি ভাষাসহ ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়গুলো শেখাতে তারা এই সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখানে যে সর্বনাশটা তারা করেছে তা হল, এই শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে ধর্মকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। কেবল তা-ই নয়, এখানে ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ, অবজ্ঞা, হীনম্মন্যতা ও বিদ্বেষের ভাব ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর পাশ্চাত্যের সবকিছুই শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম এমন একটি ধারণা প্রদান করা হয়েছে। সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের তারাই আবিষ্কারকর্তা -এমন ইতিহাস শেখানো হয়েছে। তারা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায় তখন এই শিক্ষিত শ্রেণিটির হাতে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা তুলে দিয়ে যায়, যে শিক্ষিত গোষ্ঠীটি চামড়ার রঙে ভারতীয় হলেও মনে মগজে, চিন্তা ভাবনায় খাঁটি ইংরেজ। ফল দাঁড়িয়েছে এটাই- আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা ‘ব্রিটিশদের তৈরি ইসলামে’ শিক্ষিত। আর আমাদের জাতীয় জীবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার সৃষ্টি বিভিন্ন তন্ত্র ও মতবাদের পূজারী। এভাবে আমরা এখনও প্রত্যক্ষভাবে ঔপনিবেশিক প্রভুদেরই দাসত্ব করে যাচ্ছি।

এইভাবে আমাদের বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার ফলে শিক্ষিত সমাজ তাদের জীবনের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য খুঁজে পাচ্ছে না। তারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বহুধাবিভক্ত এবং তাদের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা মনে করছে মাদ্রাসা শিক্ষিতরা কট্টরপন্থী, কূপমণ্ডূক। আর মাদ্রাসাশিক্ষিতরা মনে করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল অনৈসলামিক ক্রিয়াকলাপের আখড়া। এদিকে মাদ্রাসায় দীনের প্রকৃত মর্মবাণী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে মতবিরোধপূর্ণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়। আর সাধারণ শিক্ষার মধ্যে আল্লাহ-রসুল, পরকাল, নৈতিকতা বা তাকওয়া তথা ধর্মের কোনো শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে না। এখানে দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ বস্তুবাদী পশ্চিমাদের ধ্যান-ধারণার শিক্ষা। ফলে এখান থেকে বের হচ্ছে সম্পূর্ণ দুনিয়ামুখী বস্তুবাদী একদল লোক। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচার, অপরাজনীতি ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত যা পূর্বেই বলেছি। অন্যদিকে মাদ্রাসা থেকে যে জনগোষ্ঠীটি বের হচ্ছে তারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ভূগোল, গবেষণা, কারিগরি শিক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। জীবন ধারণের জন্য তারা ধর্মকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করছেন।

আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, এই বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা হবে ইহকাল ও পরকালের ভারসাম্যপূর্ণ। যেখানে নীতি-নৈতিকতা সংবলিত দীনের জ্ঞানের পাশাপাশি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটবে। শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হবে- একদিকে নাগরিকদের চরিত্র নির্মাণ অন্যদিকে তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে নানা কাজে দক্ষ করে গড়ে তোলা। প্রথমত এই শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষিত লোক একদিকে যেমন মো’মেন হবে, অন্যদিকে দেশপ্রেমিক ও মানবতার কল্যাণকামী হবে। সে হবে সৎ, আমানতদার, সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, সুশৃঙ্খল, স্রষ্টার প্রতি অগাধ আস্থাশীল ও স্রষ্টার হুকুমের প্রতি অনুগত। দেশের আইন মান্য করার ব্যাপারে সে হবে যত্নশীল, রাষ্ট্রের প্রতি ও রাষ্ট্র প্রধানের প্রতি হবে অনুগত। শিক্ষিত নাগরিকদের মাঝে গড়ে উঠবে ঐক্যচেতনা, ভ্রাতৃত্ববোধ। একদিকে সে অত্যন্ত সাহসী হবে আর একদিকে সে মানবদরদী হবে। জীবন গেলেও, না খেয়ে থাকলেও সে ঘুষ খাবে না, মৃত্যুর হুমকি আসলেও অর্থপাচার করবে না, দেশের বা মানুষের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না। অন্তত শিক্ষিত লোকেরা গুজব ও হুজুগপ্রবণ হবে না, মব সৃষ্টি করে অন্যের বাড়িঘরে আক্রমণ করে জ্বালাও পোড়াও করবে না।

অন্যদিকে এই শিক্ষাব্যবস্থা হবে কর্মমুখী। শিক্ষাজীবনেই শিক্ষার্থিবৃন্দ নানা ধরনের বাস্তবমুখী কর্মের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে যার ফলে শিক্ষাজীবন শেষ করে বেকার থাকার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। আবার শিক্ষাজীবন শেষ করে যেন তারা উদ্যোক্তা হতে পারে, নানা ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে সেই উপাদানও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থাকবে। উচ্চতর শিক্ষায় ব্যাপকভাবে গবেষণার সুযোগ থাকবে যেন এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, লেখকসহ সৃজনশীল কার্যের ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়। এভাবে আমাদের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় এদেশের মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, চাহিদা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নীতি-নৈতিকতা সংবলিত একটি কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব আমরা করছি। সংক্ষেপে আমাদের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো হচ্ছে:

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা: শিক্ষাব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং একমুখী করা হবে, যাতে দেহ ও আত্মা, ইহকাল ও পরকালের মধ্যে সঠিক সমন্বয় হয়। নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে চরিত্রবান ও সুশৃঙ্খল নাগরিক তৈরি করা হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ, ঐক্যচেতনা, দেশপ্রেম এবং নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য গড়ে তোলা হবে, এবং ন্যায় ও অন্যায় সম্পর্কিত স্পষ্ট মানসিকতা তৈরি করা হবে।

শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ করা: শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হতে দেওয়া হবে না এবং সবার জন্য সমান শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হবে। শিক্ষাকে সাশ্রয়ী করতে সরকার বাজেট বরাদ্দ করবে এবং সমাজের বিত্তবান শ্রেণিকে শিক্ষাখাতে দান করতে উদ্বুদ্ধ করা হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে, যাতে তারা মুনাফার চেয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে।

কর্মমুখী শিক্ষা: শিক্ষার্থীদেরকে বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা জাতির বোঝা না হয়। এজন্য আইসিটি, কারিগরি শিক্ষা, কৃষি ও পশুপালন বিষয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে, যা তাদের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দিবে।
দ্বাদশবর্ষ শিক্ষা পরিকল্পনা: সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে যা প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত চলবে। এতে শিক্ষার্থীরা আধ্যাত্মিক ও জাগতিক জ্ঞান লাভ করবে, এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তাদের প্রবণতা অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করতে পারবে।

জাতীয় নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ: শিক্ষার্থীদের জাতীয় নিরাপত্তা ও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করা হবে। সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ (ক্যাডেট) প্রদান করা হবে, যাতে তারা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উন্নতির মাধ্যমে দেশের প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকে।

সবার জন্য শিক্ষা: শিক্ষার কোনো বয়সসীমা থাকবে না, এবং শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সক্ষমতাসম্পন্ন যে কেউ শিক্ষার সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে তারা তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ লাভ করবে।

গবেষণা ও উদ্ভাবন: উচ্চশিক্ষায় গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা হবে। গবেষণার জন্য যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ করা হবে এবং দেশের মেধাবী মানুষদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হবে, যাতে মেধা পাচার রোধ হয়।

উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত ইতিহাস বর্জন: শিক্ষার্থীদের সঠিক ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হবে, যাতে ঔপনিবেশিক যুগে তৈরি মানসিক দাসত্ব ও ইংরেজদের প্রতি অন্ধ মুগ্ধতা দূর করা যায়। ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে পুনর্লিখন করা হবে এবং দেশ ও জাতির সংগ্রাম ও শ্রেষ্ঠত্বের গল্প শিক্ষার্থীদের শিখানো হবে।

পারিবারিক বন্ধনের শিক্ষা: শিক্ষার্থীদেরকে পারিবারিক সম্পর্কের গুরুত্ব শেখানো হবে। তারা বাবা-মা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্বশীল হবে, যাতে পরিবারে আন্তরিক দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।

জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষণ: শিক্ষার্থীদের পুষ্টি, প্রাথমিক চিকিৎসা, রান্না, কাপড় পরিষ্কার রাখা, ঘর গুছানো, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সাধারণ মেরামত এবং পরিবেশ সচেতনতা শেখানো হবে। এই দক্ষতাগুলো তাদের জীবনে আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করবে।

ভাষাগত দক্ষতা: শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্তত দুটি আন্তর্জাতিক ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর ফলে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেদের স্থান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
বিশেষ শিশুদের শিক্ষা: শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। তাদের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি তৈরি করা হবে, যাতে তারা দক্ষতা অর্জন করে সমাজে নিজেকে মূল্যবান মানবসম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
ইমেইল: heybuttawheed.official@gmail.com
যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...