কোর’আনে বর্ণিত বনি ইসরাইলদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে আমার এই লেখাটি শুরু করতে চাই। ঘটনাটি হল- আল্লাহ বনী ইসরাইলদের একটি গরু কোরবান করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই যদি তারা একটি ভালো গরু কোরবানি করে দিত তাহলেই সব কাজ শেষ হয়ে যেত। কারণ কোরবানির গরুটা কেমন হবে আল্লাহ তার কোনো শর্ত উল্লেখ করেন নি। কিন্তু আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন- বনী ইসরাইল তা করেনি। তারা মুুসা (আ:) এর মাধ্যমে আল্লাহকে প্রশ্ন করতে লাগলো- গরুটার বয়স কত হবে, গায়ের রং কি হবে, সেটা জমি চাষের জন্য শিক্ষিত কিনা, ওটার গায়ে কোনো খুঁত থাকতে পারবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা প্রশ্ন করে যেতে লাগলো আর আল্লাহ একটার পর একটা উত্তর দিয়ে যেতে থাকলেন। তারপর যখন প্রশ্ন করার মতো আর কিছুই রইলো না তখন স্বভাবতঃই ঠিক অমন একটি গরু পাওয়া দূরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। একটা সহজ-সরল আদেশ “একটা গরু কোরবানি করো” এটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এমন কঠিন করে ফেলা হলো যে, ঐ আদেশ পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের ক্ষেত্রেও। বনী ইসরাইল আর আমাদের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। হ্যাঁ আছে, একটি ব্যাপারে আছে, আর তা হলো বনী ইসরাইল ৭২ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল, আর এই মুসলিম নামধারী জাতিটি তাদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে (রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী)।
আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষনবী (দ:) পর্যন্ত আল্লাহ যে জীবন-বিধান মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন, স্থান, কাল ভেদে সেগুলোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে প্রভেদ থাকলেও সর্বক্ষণ ভিত্তি থেকেছে একটি মাত্র। সেটা হচ্ছে একেশ্বরবাদ (Monothism), তওহীদ, একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধাতা (বিধানদাতা) আল্লাহ। যার আদেশ, নির্দেশ, আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারো আদেশ, নির্দেশ, আইন-কানুন কিছুই না মানা। একেই আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন, দীনুল কাইয়্যেমা। আল্লাহ মানুষের কাছে এইটুকুই মাত্র চান। কারণ তিনি জানেন যে, মানুষ যদি সমষ্টিগতভাবে তিনি ছাড়া অন্য কারো তৈরী আইন-কানুন না মানে, শুধু তারই আইন-কানুন মানে তবে শয়তান তার ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানুষকে দিয়ে অশান্তি, অন্যায় আর রক্তপাত অর্জনে ব্যর্থ হবে এবং মানুষ সুবিচারে, শান্তিতে (ইসলামে) পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে- অর্থাৎ আল্লাহ যা চান। কত সহজ। ‘কাইয়্যেমা’ শব্দটা এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ চিরন্তন, শাশ্বত, সনাতন। আল্লাহ এই দীনুল কাইয়্যেমার কথা বলেছেন- এর বেশি তো আমি আদেশ করি নি (সুরা বাইয়্যিনাহ- ৫)। ‘এর বেশি তো আমি আদেশ করি নি’ তিনি বলেছেন এই জন্য যে, তিনি জানেন যে, ঐটুকু করলেই অর্থাৎ তার বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধান মানুষ না মানলেই মানব জাতির মধ্যে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সামান্য দাবীটুকুই তিনি মানুষের কাছে আদম থেকে আজ পর্যন্ত করে এসেছেন। পূর্ববর্তী বিকৃত জীবন-ব্যবস্থাগুলিতেও আল্লাহর দাবী ছিল ঐ সহজ সরল দাবী- দীনুল কাইয়্যেমা, তওহীদ। ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদের তারা কোন ধর্মে বিশ্বাসী জিজ্ঞাসা করলে তার জবাব দেবেন সনাতন ধর্ম। সনাতন এবং কাইয়্যেমা একার্থবোধক- যা চিরদিন প্রবহমান, চিরন্তন ও শাশ্বত, এবং তা ঐ তওহীদ। এর গুরুত্ব এত বেশি যে একে আল্লাহ আমাদের জন্য শুধু প্রতি সালাতে নয় প্রতি রাকাতে অবশ্য করে দিয়েছেন সুরা ফাতেহার মধ্যে। “আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমে চালাও” মুস্তাকিম অর্থ সহজ, সরল ও শাশ্বত।
একটি জাতির মধ্যে চালাক, বোকা, শিক্ষিত মেধাবী ইত্যাদি সব রকম লোকই থাকবে। তাই আল্লাহ ও তার রসুল যে জাতি সৃষ্টি করলেন তার ভিত্তি করলেন অতি সহজ ও সরল তওহীদ, একমাত্র প্রভু হিসাবে তাকেই স্বীকার করে নেওয়া। এরই নাম সিরাতুল মুস্তাকিম। আর সহজ বলেই বিশ্ব নবীর সৃষ্ট অত্যন্ত অশিক্ষিত জাতিটি, যার মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা যেত তারাও ভিত্তি ও লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা থেকে চ্যুত হন নি। এতে করে তাদের মধ্যে যে সীসাঢালা প্রাচীরের মত একতা সৃষ্টি হয়েছিল তার সামনে অর্ধ পৃথিবী মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে চলেছে ৬০/৭০ বছর যে কথা আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তার উম্মাহর আয়ু। বাস্তবিকই ৬০/৭০ বছর পর থেকেই শুরু হলো এই জাতির মৃত্যুর পর্ব, ধ্বংসের পর্ব। এই জাতির মধ্যেও সৃষ্টি হলো পুরোহিত, আলেম মাওলানা, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, পীর-মাশায়েখ ইত্যাদি শত শত ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির। অতি বিশ্লেষণের বিষময় ফলে ঐ দীনুল কাইয়্যেমা, সিরাতুল মুস্তাকিম হয়ে গেল অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য এক জীবন-বিধান, যেটা সম্পূর্ণ শিক্ষা করাই মানুষের এক জীবনের মধ্যে সম্ভব নয়, সেটাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো বহু দূরের কথা। ফকিহ-মুফাসসিরদের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে জাতির মধ্যে ভয়াবহ বিভেদ সৃষ্টি হয়ে, বিভিন্ন মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টি হয়ে যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো তার ফলে পুনরায় একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেল।
সিরাতুল মুস্তাকিমের সহজতার, সরলতার মহাগুরুত্ব উপলব্ধি করে রসুলাল্লাহ (দ:) এক হাদীসে বললেন; দীন সহজ, সরল (সিরাতুল মুস্তাকিম) একে নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করবে তারা পরাজিত হবে। অন্য হাদীসে বললেন, জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে [আবু হোরায়রা (রা.) থেকে হাদীস- মুসলিম]। এই সাবধান বাণীতেও আশ্বস্ত না হতে পেরে বিশ্বনবী (দ:) আরও ভয়ংকর শাস্তির কথা শোনালেন। বললেন; কোর’আনের কোনো আয়াতের অর্থ নিয়ে বিতর্ক কুফর। এবং কোনো অর্থ নিয়ে মতান্তর উপস্থিত হলে আমাদেরকে কি করতে হবে তারও নির্দেশ তিনি আমাদের দিচ্ছেন। বলেছেন, কোনো মতান্তর উপস্থিত হলে তা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে যখনই মতান্তর উদ্ভব হবে তখনই চুপ হয়ে যাবে, কোনো তর্ক-বিতর্ক করবে না। অর্থাৎ বিতর্কে যেয়ে কুফরি করবে না এবং যে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই সেই সিরাতুল মুস্তাকিমে, দীনুল কাইয়্যেমাকে আঁকড়ে ধরে থাক, এখানে লক্ষ্য করার একটা বিষয় আছে, দীনের ব্যাপার নিয়ে বিতর্ককে আল্লাহর রসুল (দ:) কোন পর্যায়ের গুনাহ, পাপ বোলে আখ্যায়িত করছেন। চুরি নয়, হত্যা নয়, ব্যভিচার নয়, বলেছেন- কুফর। যার চেয়ে বড় আর গোনাহ নেই, শুধু তাই নয় যা একজনকে এই দীন থেকেই বহিষ্কৃত করে দেয়। এতবড় শাস্তি কেন? শেষ নবীর (দ:) হাদীস থেকেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। তিনি বলেছেন; তোমরা কি জানো, ইসলামকে কিসে ধ্বংস করবে? এই প্রশ্ন করে তিনি নিজেই জবাব দিচ্ছেন- শিক্ষিতদের ভুল, মুনাফিকদের বিতর্ক এবং নেতাদের ভুল ফতোয়া (হাদিস- মেশকাত)। যে কাজ ইসলামকেই ধ্বংস করে দেয়, সে কাজের চেয়ে বড় গোনাহ আর কি হতে পারে! তাই বিশ্বনবী (দ:) এই কাজকে কুফরি বলেছেন।
এই জাতির মহাদুর্ভাগ্য আল্লাহ ও তার রসুলের (দ:) এতসব কঠোর সতর্কবাণী এই উম্মাহর পণ্ডিতদের কিছুই মনে নেই। তারা সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কোর’আন-হাদীসের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে বিরাট বিরাট ফিকাহ শাস্ত্র গড়ে তুলতে থাকলেন। এদের মণীষার, প্রতিভার, অধ্যবসায়ের কথা চিন্তা করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, কিন্তু তাদের ঐ কাজের ফলে এই উম্মাহ ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে ধ্বংস হয়ে গেল, শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে গেল। কাজেই বর্তমানের এই যে মুসলিমরা বিভিন্ন দলে উপদলে, ফেরকা-মাযহাবে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা শত মুখী সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে, হানাহানি-মারামারি, বোমাবাজি করছে তার পেছনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে কে? তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিতরাই নয় কি?