মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে সম্পাদিত:
শেষ নবীর উপর আল্লাহ দায়িত্ব দিলেন সমস্ত পৃথিবীর প্রচলিত জীবন-ব্যবস্থাসমূহকে অকার্যকর কোরে একমাত্র আল্লাহর দেওয়া শেষ জীবনব্যবস্থা পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠা করার (সুরা আল ফাতাহ-২৮, সফ-৯, তওবা-৩৩)। এটা এই কারণে যে, সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া এই শেষ জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হোলে পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ-রক্তপাত, হানাহানি, মারামারি এককথায় অশান্তি নির্মূল হোয়ে যাবে; মানবজাতি শান্তিতে বসবাস কোরতে পারবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হোল- এবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল যে, সে মানবজাতিকে ফাসাদ (অন্যায়-অবিচার) ও সাফাকুদ্দিমাতে (রক্তপাত) পতিত কোরবে সে চ্যালেঞ্জে আল্লাহ জয়ী হবেন। তাই এই মহান কাজ করার জন্য রসুল তাঁর নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে উম্মতে মোহাম্মদী নামক একটি জাতি গঠন কোরলেন। অতঃপর সে জাতির জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী শিক্ষা দিলেন। জানিয়ে দিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে জাতির কাজ কী, কীভাবে সেটা বাস্তবায়ন কোরতে হবে। এভাবেই উম্মতের প্রতি দায়িত্ব নির্দিষ্ট কোরে দিয়ে তিনি তাঁর প্রভুর কাছে চোলে গেলেন। তার পরের ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাস।
উম্মতে মোহাম্মদী ডাইনে-বায়ে না চেয়ে (হানিফ) একাগ্র লক্ষ্যে তাদের কর্তব্য চালিয়ে গেলো প্রায় ৬০/৭০ বছর। এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে তদানীন্তন পৃথিবীর এক উল্লেখযোগ্য অংশে এই শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠা কোরল। তারপর দুর্ভাগ্যক্রমে আরম্ভ হোল উদ্দেশ্যচ্যুতি, আকিদার বিচ্যুতি। যে কোন কিছুরই যখন উদ্দেশ্যচ্যুতি ঘটে তখন তার আর কোনো দাম থাকে না, হোক সেটা জাতি, দল, সমিতি, প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি- যাই হোক। যে মুহূর্ত থেকে উদ্দেশ্য বিলুপ্ত হোয়ে যায় সেই মুহূর্ত থেকে যে কোনো জিনিস অর্থহীন হোয়ে যায়। রসুলাল্লাহকে (দ:) মে’রাজে নিয়ে আল্লাহ তাঁকে স্থান ও কালের বি¯তৃতি থেকে মুক্ত কোরেছিলেন। তাই অতীত ও ভবিষ্যতের যতটুকু তাঁকে জানিয়েছিলেন তাতেই তাঁর উম্মাহর ভবিষ্যতের অনেক কিছুই তিনি জানতে পেরেছিলেন। তাঁর ওফাতের ত্রিশ বছর পর খেলাফত পরিত্যক্ত হোয়ে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে পরিণত হবে তা তিনি জানতেন, বোলেও গেছেন এবং তা যে সত্য হোয়েছে তা ইতিহাস- ঠিক ত্রিশ বছর পরে একজনের ছেলে বাপের পর খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হোল। তিনি এও বোলে গিয়েছিলেন যে, আমার উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর (হাদিস- আবু হোরায়রা (রা:) থেকে তিরমিজি ইবনে, মাজাহ।)। বর্তমানের বিকৃত ইসলামের ধর্মীয় নেতাদের দৃষ্টিতে তাদের অর্থাৎ যেটাকে তারা উম্মতে মোহাম্মদী বোলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন সেটাকে মানুষের ব্যক্তিগত আয়ুর কথা বোঝেন। তাদের এই ভুল বোঝার কারণ হোল, অতি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ও আকিদার বিকৃতি। রসুলাল্লাহ (দ:) তাঁর উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর বোলতে তিনি যে তাঁর উম্মাহর লোকজনের ব্যক্তিগত আয়ু বোঝান নি তার প্রধান দু’টো কারণ আছে। প্রথমতঃ ৬০ থেকে ৭০ বছর আয়ু হবার মধ্যে এমনকি বিশেষত্ব আছে যা একজন নবী তাঁর উম্মাহ সম্বন্ধে বোলবেন? তার আগের লোকজনের বা পরের লোকজনের আয়ুর থেকে তার কি তফাৎ? আমাদের মধ্যেই যে অন্যান্য ধর্মের লোকজন বাস করে তাদের আয়ুর সঙ্গে আমাদের আয়ুর কি তফাৎ? কিছু না। তবে ওকথা তাঁর উম্মাহর কোন বৈশিষ্ট্য হিসাবে বলার কোন অর্থ হয় না। তিনি (দ:) যদি বোলতেন আমার উম্মাহর লোকজনের দু’টো কোরে চোখ থাকবে তবে তার কী অর্থ হোত? কিছুই না। দ্বিতীয়তঃ আমার উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর এ কথা বোলে দেবার অর্থ ৬০ বছর বয়সের আগে মারা যাবে এবং ৭০ বছর বয়সের পর যারা মারা যাবে তারা উম্মতে মোহাম্মদী নয়। এ হোতে পারে? অবশ্যই নয়। মনে রাখবেন, একথা সাধারণ মানুষের যা মনে চায় বোলে ফেলা নয়- এ আল্লাহর রসুলের (দ:) বাণী- যার প্রতি কথা, প্রতি শব্দের ব্যবহার ওজন করা, ভেবে চিন্তে বলা।
এই হাদিসের প্রকৃত অর্থ – উম্মতে মোহাম্মদী হোল সেই জাতি যে জাতি তার নবীর অর্থাৎ মোহাম্মদের (দ:) উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ কোরতে সংগ্রাম কোরে যায়- যে কথা পেছনে বোলে এসেছি। এখানে ঐ দায়িত্ব হোল সমস্ত পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠা করা। ঐ সংগ্রাম পরিত্যাগ কোরলেই সে জাতি আর উম্মতে মোহাম্মদী থাকে না। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য কোরুন, দেখবেন ঐ জাতি মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছে। এই সময় পর্যন্ত এই জাতি সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে গেছে একটিমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে এবং সেটা হোল বিশ্বনবীর (দ:) সুন্নাহ পালন। যে সুন্নাহর কথা তিনি বোলেছেন- যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ কোরবে সে আমাদের কেউ নয়। সেই প্রকৃত সুন্নাহ হোল সমস্ত পৃথিবীতে এই শেষ ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ আকিদা বদলে গেলো ৬০/৭০ বছর পর। এই উম্মাহ তার উদ্দেশ্য ভুলে গেলো। ইসলাম প্রতিষ্ঠার বদলে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হোয়ে গেল রাজ্য বিস্তার, সম্পদ আহরণ। জাতির উদ্দেশ্য বদলে গেলো। উদ্দেশ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় আর কিছুই হোতে পারে না, বাকী সব কম প্রয়োজনীয়। সেই মহাপ্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যই যদি বদলে যায় তবে যে কোন জিনিসেরই আর কিছু থাকে না। যে উদ্দেশ্যে শ্রেষ্ঠ ও শেষনবী (দ:) প্রেরিত হোয়েছিলেন, যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর সৃষ্ট জাতি জীবনের সব কিছু কোরবান কোরে আরব থেকে বের হোয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেই উদ্দেশ্য তাদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হোয়ে পরিণত হোল রাজ্যজয়ের যুদ্ধে।
দু’টি ঘটনার মধ্যে এই বিরাট তফাৎটা প্রকট হোয়ে ফুটে উঠেছে। একটি খলিফা ওমরের (রা:) সময়ে অন্যটা একজন উমাইয়া খলিফার সময়ে। ওমরের (রা:) সময়ে মিশরের শাসনকর্তা হাইয়ান ইবনে শারিহ খলিফাকে লিখলেন- আমীরুল মো’মেনীন! অমোসলেমরা স্বেচ্ছায় এত সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণ কোরছে যে, জিজিয়া আদায় অনেক কমে গেছে। এখন কি করা? ওমর (রা:) রাগান্বিত হোয়ে জবাব দিলেন- জিজিয়া আদায় কমে যাচ্ছে বোলে অভিযোগ কোরতে তোমার একজন মোসলেম হিসাবে লজ্জা কোরল না? তোমার মনে রাখা উচিৎ যে, রসুলাল্লাহ (দ:) কর আদায় করার জন্য প্রেরিত হন নি (সয়ুতি, ইদ্রীস আহমদ এবং decisive moments in the History of Islam- Inan ) । ঠিক এমনি অভিযোগ এসেছিল একজন গভর্নরের কাছ থেকে এক উমাইয়া খলিফার কাছে। অমোসলেমরা মোসলেম হোয়ে যাচ্ছে, জিজিয়া দেয়া বন্ধ হোয়ে যাচ্ছে বোলে রাজকোষে সম্পদ কমে গেছে। ঐ খলিফা আদেশ দিলেন অমোসলেমদের ইসলাম গ্রহণ বন্ধ কোরে দাও। একই অভিযোগের দু’টি বিপরীতমুখী উত্তর। অভিযোগ শুনে ওমর (রা:) খুশী হোয়ে ছিলেন, যদি জিজিয়া আদায় একেবারে বন্ধ হোয়ে যেতো তাহলে তিনি সবচেয়ে বেশী খুশী হোতেন, কারণ তার মানে ঐ অঞ্চলের সমস্ত অমোসলেম মোসলেম হোয়ে গেছে, মোসলেম উম্মাহ উদ্দেশ্য পূরণে তাদের প্রিয় নবীর (দ:) আরদ্ধ কাজে আরও একটু অগ্রসর হোয়েছে। আর ঐ উমাইয়া খলিফার সম্মুখে তখন আর সে উদ্দেশ্য নেই। তার জাতিরও সে উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য বদলে গিয়ে হোয়ে গেছে রাজত্ব ও আনুষঙ্গিক শান-শওকত। কাজেই তখন আর ঐ জাতি উম্মতে মোহাম্মদী নেই। কারণ উম্মতে মোহাম্মদীর উদ্দেশ্য ও তার পরের ঐ জাতির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ইতিহাস দেখুন, পরিষ্কার দেখতে পাবেন যে, ঐ উদ্দেশ্যচ্যুতি বা পরিবর্তন ঘটেছে ভবিষ্যতদ্রষ্টা বিশ্বনবীর (দ:) ৬০ থেকে ৭০ বছর পর। লক্ষ্য কোরলে আরও একটি ব্যাপার দেখতে পাবেন। সেটা হোল রসুলাল্লাহর (দ:) কাছ থেকে যারা সরাসরি ইসলাম শিক্ষা কোরেছিলেন অর্থাৎ আসহাব, তারা কখনই ঐ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হন নি। বিচ্যুতি এলো তারা সবাই পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর। যেহেতু উদ্দেশ্যের পরিবর্তন বা চ্যুতি হোল কাজেই ঐ জাতি আর উম্মতে মোহাম্মদী রোইল না এবং আজ পর্যন্তও উম্মতে মোহাম্মদী নয়। তবে একথা মনের রাখতে হবে যে, আমি জাতি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদী বোলছি। ৬০/৭০ বছর পর থেকে এই উম্মাহ জাতি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদী রোইল না কিন্তু ব্যক্তি ও দলগতভাবে অনেক লোকই রোইলেন যারা ইসলামের সর্বপ্রধান লক্ষ্য ও রসুলাল্লাহর (দ:) সুন্নাহ ভুলে গেলেন না। সাধারণ মুজাহিদ ও কিছু কিছু সেনাপতির আকিদা ঠিকই ছিলো যারা উর্ধতন নেতৃত্বের আকিদা বিকৃতি সত্ত্বেও নিজেদের আকিদা ঠিক রেখে জেহাদ চালিয়ে গেলেন, যার ফলে ঐ বিকৃত আকিদার খলিফাদের সময়েও ইসলাম আরো বি¯তৃত হোয়েছে।
কিন্তু ঐ উদ্দেশ্যচ্যুতির ফল ক্রমশঃ আরও ভয়াবহ হোতে আরম্ভ কোরল। আমি আগেও বোলে এসেছি, উদ্দেশ্যের, আকিদার চেয়ে বড় আর কিছুই নাই, উদ্দেশ্য না থাকলে আর সব কিছুই অর্থহীন। একদল লোক যদি একত্র হোয়ে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য রওনা হয় তবে যতোক্ষণ তারা গন্তব্যস্থলের কথা মনে রাখবে ততোক্ষণ তারা একত্রই থাকবে। যদি কোনো কারণে তারা তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল কী তা ভুলে যায় তবে কী হবে? নিশ্চিত বলা যায় যে, তারা আর একত্রিত থাকবে না। এক এক জন এক একদিকে চোলতে শুরু কোরবে, কেউ চোলবেই না, বোসে পড়বে, কেই একদম অন্য কোনো কাজ কোরতে শুরু কোরবে। এই জাতির ঠিক সেই অবস্থা হোল তাদের উদ্দেশ্য ভুলে যাবার ফলে, আকিদা নষ্ট হবার ফলে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হোল এই যে, এই সময় থেকে এই জাতির মধ্যে যে বিকৃতি আসতে শুরু হোল সেই সব বিকৃতি পূর্বতন প্রত্যেক নবীর (আ:) জাতির মধ্যে আবির্ভূত হোয়েছে এবং সেই জাতিগুলিকে ধ্বংস কোরে ফেলেছে। আল্লাহ তাঁর কোর’আনে আর রসুল (দ:) তাঁর হাদিসে বারবার ঐ বিকৃতিগুলি থেকে বাঁচার জন্য সাবধান কোরে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই জাতি ঠিক ঐ ভুলগুলিই কোরতে আরম্ভ কোরল আর তার ফলে ধ্বংস হোয়ে গেলো। (চোলবে এনশা’ল্লাহ)