ধরুন আপনি একটি গ্রামের চেয়ারম্যান। গ্রামের প্রতিটি লোক আপনাকে মান্য করে এবং আপনাকে তাদের নেতা, ত্রাণকর্তা মনে করে। এর ফলে গ্রামের যে কোন ঘটনাতেই আপনার মতামতকে এককভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। আপনাকে সেই গ্রামের জনগণ মেনে নিয়েছেন বলেই আপনি গ্রামে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারছেন এবং সেই অনুযায়ী গ্রামের উন্নয়ন করতে পারছেন। অর্থাৎ একক নেতৃত্ব অর্জন করেছেন। এখন যদি সেই গ্রামেই আপনার একজন বিরোধী দাঁড়ায় এবং আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভেস্তে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে তখন কী আপনি সেই গ্রামের উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন? হবেন না। ঠিক এই বিষয়টি বর্তমানে আমাদের সমাজব্যবস্থায় চর্চা করা হচ্ছে এবং এর ফলে আমরা উন্নতি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। জাতির মধ্যকার অখণ্ডতা না থাকার ফলে ধীরে ধীরে আমাদের ঘারে সংকটের বোঝা বাড়ছে এবং এর ফলে অচিরেই আমাদের পথে বসতে হবে।
ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের পাকিস্তানের থেকেও স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৭ বছরেও আমরা অনুন্নত দেশের তালিকায় পড়ে আছি। আমাদের সামনেই অনেক দেশের উদাহারণ রয়েছে যারা আমাদের পরও স্বাধীনতা লাভ করেও আমাদের থেকে অনেক বেশি উন্নত। কিন্তু আমরা সে তুলনায় অনেকে বেশি পিছিয়ে রয়েছি। এর ফলে সৃষ্ট সংকটগুলো এখন ধীরে ধীরে একটি বিরাট সংকটের জন্ম দিয়েছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, ফসলী জমির অভাব, জিডিপি কমে যাওয়া, বিশাল আকারের ঋণ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সংকটে আজ আমরা নিমজ্জিত। জনসংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু ভূমি তো বাড়ছে না। বরং বর্ধিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, শিক্ষা, চাকরি-বাকরি ইত্যাদি প্রয়োজনে অবকাঠামো নির্মাণের দরুন ফসলী জমি কমে যাওয়ার ফলে আমাদের আমদানি নির্ভর হতে হচ্ছে যা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতে মোট আমদানির থেকে রপ্তানি কম হয়েছে ২০৯.৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৬৬০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি হ্রাস পেয়েছে। প্রতিটি খাদ্যের বাজারমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে। তা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ তা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আমরা শুধু পিছিয়েই যাচ্ছি এবং যদি এ ধারা অব্যহত থাকে তবে খুব শীঘ্রই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিধ্বস্ত হয়ে পরবে।
এখন যদি আমরা উন্নতি করতে চাই তবে আমাদের করণীয় কী হবে? কোন জাতি যদি উন্নতি করতে চায় তখন সেই জাতিটির অখণ্ডতা অত্যাবশ্যক। কারণ সমগ্র জাতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যতদিন এক ও অভিন্ন না হবে ততদিন সে জাতির সমাগ্রিক উন্নতি সম্ভব হবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চর্চা করতে গিয়ে আমরা এ বিষয়টিই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক এই কারণেই পরস্পরের সাথে কামড়া-কামড়িতে লিপ্ত। এক দল ক্ষমতায় যায় তো অপর দল তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাদের সমালোচনা, তাদের কাজে বাধা প্রদান, তাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকে। এর ফলে ক্ষমতায় থাকা দলটি বিরোধী দলকে ঠেকাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যেন ক্ষমতায় এসেছেই বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য; দেশের উন্নতিতে তারা আর উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। এই ব্যবস্থায় এতটাই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় যে দেশ নিয়ে তারা আসলে চিন্তাই করে না। তারা মনে করে তাদের সময়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে না নিলে বিরোধী দল এসে তাদের নিঃশেষ করে দিবে। তারা দেশের উন্নয়ন বাদ দিয়ে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যতিব্যস্ত হয় এবং সংকটে পতিত হতে হয় দেশের সাধারণ জনগণকে। নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তারা জ্বালাও-পোড়াও করে এবং এতে দেশের সম্পদ, মানুষের সম্পদ ধ্বংস হয়। আবার একদল ক্ষমতায় এসে যদি কোন উন্নয়নমূলক কাজে হাত দেয় এবং যদি সেই কাজটি তার ক্ষমতায় থাকাকালীন শেষ করতে না পারে তবে সেই কাজ অপর দল ক্ষমতায় আসলে শেষ করে না কারণ তারা একে দেশের উন্নয়ন না বরং অপর দলের করা কাজ হিসেবে গণ্য করে। ফলে দেশের মানুষের ক্ষতি হয়, দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
তাহলে এখন আমাদের সর্বপ্রথম এক ও অখণ্ড জাতিতে পরিণত হতে হবে। অখণ্ডতা ছাড়া উন্নতি কিছুতেই সম্ভব নয়। ইতিহাস সাক্ষী প্রতিটি জাতি উন্নতি করেছে এই অখণ্ডতা ও একক নেতৃত্বের উপর ভিত্তি করে। পূর্বেও বলে এসেছি পাশ্চাত্যের থেকে ধার করা রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমাদের মধ্যে অখণ্ডতা বজায় থাকছে না। সমাজতন্ত্রও আমরা গ্রহণ করতে পারি না কারণ সে ব্যবস্থার ফল আমরা ইতিহাসে দেখেছি। তাহলে আমরা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি যে ব্যবস্থা আমাদের একক নেতৃত্ব ও অখণ্ডতা সুনিশ্চিত করবে যার মাধ্যমে আমরা উন্নতির পরম শিখরে আরোহণ করতে পারব? সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম যা আল্লাহর রসুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহর রসুল, সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী মোহাম্মদ (সা.) মদিনায় এ কাজটিই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সবাইকে প্রথমে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না এ কথার উপর ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাঁর সেই ঐক্যবদ্ধ জাতি পরবর্তীতে যে সফলতা লাভ করেছে তা ইতিহাস থেকেই স্পষ্ট জানা যায়। এখন যদি সেই ঐক্যবদ্ধ জাতির নেতা রসুল না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন হতো তবে কী তারা উঠতে পারতেন? অবশ্যই না। কাজেই এখনো আমাদের সর্বপ্রথম এমন একজন নেতার পিছনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যিনি ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবো না’ এ কথার উপর সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। মানুষের সৃষ্টি করা তন্ত্র-মন্ত্র আমরা প্রয়োগ করে দেখেছি যেগুলো আমাদেরকে আরো বেশি সংকট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে নি। তাই আমাদের এখন স্রষ্টা প্রদত্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেখা উচিত। কারণ রসুলের সময় যেই অখণ্ডতা ও একক নেতৃত্বের ফলে মুসলিম জাতি সকল দিক থেকে উন্নতির পরম শিখরে আরোহণ করেছিল সেই একই আদর্শ পুনরায় যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি তবে অবশ্যই ফল একই হবে। একটি গাছে দুুটি ফল কখনোই জন্মায় না, একটি গাছের ফল একটিই।
অতএব আমাদের মধ্যে এ চেতনা জাগ্রত হতে হবে যে আমরা একটি জাতি, আমাদের নেতা হবে একজন, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে একটি। আমরা ব্যক্তিগতভাবে যে যেই ধর্ম, যেই মতেরই অনুসাারী হই না কেন জাতিগত পর্যায়ে আমাদের চিন্তা ও চেতনা হবে এক। আমাদের একটাই লক্ষ্য হবে, ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির উন্নতি সাধন। জাতি রক্ষা পেলেই আমরা রক্ষা পাবো, জাতি ধ্বংস হলে আমাদের ধ্বংসও সুনিশ্চিত।