মোহাম্মদ আসাদ আলী:
“আমরা কেউই আসলে ভাবতে পারিনি এ সংকট আমাদের আজকের পরিস্থিতিতে নিয়ে আসবে। শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনে সরকারের কঠোর পদক্ষেপই একে সহিংস লড়াইয়ে পরিণত করে। এর পরিণতি আজ ভয়ংকর হয়ে দেখা দিয়েছে। এখান থেকে উত্তরণে কোনো আশার আলো আর নেই।” সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের ৫ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশটির ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে এভাবেই অভিমত ব্যক্ত করেন সিরীয় শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক মারওয়ান কাবালান। দেশটির ভয়াবহতার চিত্র এককথায় হৃদয়বিদারক। প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই সেখানে। একেকটি দিন পার হওয়া মানেই একেকটি নতুন জীবন। সেখানে জীবন মানেই যুদ্ধ। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইয়ের যুদ্ধ। ৪ বছর অতিক্রম হওয়া সত্ত্বেও সংকট সমাধানের ক্ষীণ আশাও দেখছেন না গৃহযুদ্ধ পীড়িত দেশটির জনগণ।
জাতিসংঘের হিসাবমতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরও অন্তত ৭০ লাখ। বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। শিক্ষাহীনভাবে বেড়ে উঠছে শিশুরা। দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে তাদের জীবন। বিশ্ব দাতা সংস্থাগুলো বলছে, সংকট নিরসনে জাতিসংঘ পুরোপুরি ব্যর্থ। খুবই স্বাভাবিক। একটি জাতি যখন নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়, একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার প্রতিজ্ঞা করে তখন সে জাতিকে নিশ্চিত ধ্বংসের পথ থেকে ফেরানোর সাধ্য কারও থাকে না।
সিরিয়ার এই ধ্বংসলীলা কীভাবে শুরু হয়েছিল? মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা কথিত আরব বসন্ত আন্দোলনের রেশ ধরে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করে পশ্চিমা মদদপ্রাপ্ত বিরোধী পক্ষ। বিরোধীরা ক্রমেই উগ্রপন্থার দিকে অগ্রসর হলে সরকারও ক্রমশ কঠোরতা প্রদর্শন করতে থাকে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের উপর অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হয় সরকার। দমননীতি গ্রহণের স্বাভাবিক পরিণতিই হচ্ছে সহিংসতা বৃদ্ধি। মুহূর্তের মধ্যে গণজাগরণমূলক আন্দোলনটির সঙ্গে সরকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সুযোগ পেয়ে বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা দিতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলি এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলো। শুরু হয় ধ্বংসের পথে হতভাগা সিরীয়দের রক্তাক্ত যাত্রা।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী দেশ ইরাক। সাম্রাজ্যবাদের নির্মম আঘাতের দগদগে ঘা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল দেশটি। কিন্তু অনৈক্য, শিয়া-সুন্নি সংঘাত এবং সাম্রাজ্যবাদের কূটচাল ধ্বংসপ্রাপ্ত সিরিয়ার পাশে দাঁড় করাল ইরাককেও। আবারও পশ্চিমাদের পদতলে দলিত হবার পথে এগোচ্ছে দেশটি। এদিকে লিবিয়ার অবস্থাও ভয়াবহ। আরব বসন্তের রেশ ধরে সেখানেও সরকারবিরোধী গোষ্ঠী গাদ্দাফী সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিলে সরকার অস্ত্রের ভাষায় তার জবাব দেয়। আর সেই সুযোগে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র উঠিয়ে দেয় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গাদ্দাফী সরকার উৎখাত হয়, কিন্তু যুদ্ধ থেমে থাকে না। বর্তমানে লিবিয়ায় কোনো প্রতিষ্ঠিত সরকার নেই। একেক অঞ্চল শাসন করছে একেক গোষ্ঠী। সারাক্ষণ গুম, খুন, বোমা হামলা, অপহরণের আশঙ্কায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে দেশটির সাধারণ জনগণকে। লিবিয়ার মানুষের জন্য পশ্চিমাদের উতলে পড়া দরদ আজ উবে গেছে। তারা এখন ভুলেও লিবিয়ার কথা মুখে আনে না। বস্তুত দীর্ঘদিনের জমে থাকা জাতীয় অনৈক্য, মানুষের তীব্র সরকারবিরোধী মনোভাব এবং ঐক্য গঠনের পরিবর্তে সরকারি দমন-পীড়নই লিবিয়ার এ দুর্দশার জন্য দায়ী।
জাতীয় অনৈক্যের পরিণতিতে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই এবং পশ্চিমাদের স্বার্থ উদ্ধারের এই স্রোতে সর্বশেষ গা ভাসিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী দেশ ইয়েমেন। দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী মতাদর্শীদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের সূচনা করেছে। পশ্চিমা জোট দেশটির ভাগ্য নিয়ে নতুন খেলা আরম্ভ করেছে। আর সে খেলায় ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে সৌদি আরবসহ পশ্চিমা কৃপাভাজন আরব রাষ্ট্রগুলো। সব মিলিয়ে ইয়েমেন পরিণত হতে যাচ্ছে নতুন সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক বা আফগানিস্তানে। বিশ্লেষকরা এই সব কিছুর জন্য দেশটির বহু বছর ধরে লালিত জাতীয় অনৈক্য, ঐক্যপ্রচেষ্টায় উদাসীনতা, এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে দমন-পীড়ন-নির্যাতন এবং পশ্চিমা ষড়যন্ত্রকে দায়ী করছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের এই ঘটনাপূঞ্জি থেকে আমাদেরকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশেও আজকে কথিত গণতন্ত্রের দাবিতেই সরকারবিরোধীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের আন্দোলনও বিভিন্ন সময় নাশকতায় রূপ নিচ্ছে। হতাহত হচ্ছে শত-সহস্র নিরীহ-নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সহিংস সরকারবিরোধী আন্দোলনে শুধু আগুনে পুড়েই নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে একশ’রও বেশি মানুষ। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে অনেকেই। আর সরকার যথারীতি সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কঠোরহস্তে বিরোধীদের দমনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। গণপিটুনি ও ক্রসফায়ারের নামে চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। কেউ উগ্রতা দেখায় গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, কেউ দেখায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। উভয়ই চলে জনতার নামে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে বিরোধীপক্ষটি সহিংস কর্মসূচি থেকে বিরত রয়েছে, কিন্তু তার মানেই এই নয় যে, সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশের এই সহিংসতা সংঘটনকারী দলগুলোকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো।
সিরিয়া, ইরাক বা ইয়েমেনের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য হচ্ছে আমাদের এখানে সহিংসতার পটভূমি রচিত হয়েছে রাজনীতিকে ঘিরে, ধর্মীয় বিষয় এখানে মুখ্য নয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ইস্যুকে ধর্মীয় ইস্যুতে কনভার্ট করতেও খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ, আস্তিক-নাস্তিক বিরোধ এবং ক্রমাগত নাস্তিক ব্লগার হত্যার মতো ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন রাজনীতিক ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশে ধর্মীয় ইস্যুও সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল আছে, যা যে কোনো সময় যে কোনো দিকে প্রবাহিত হতে পারে।
আজ আমাদের রাজনীতিকরা এক অশুভ দানবের ইশারায় ক্রীড়নক হয়ে খেলছেন মাত্র। জাতির ভবিষ্যতকে তারা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন সে দিকে কোনো খেয়াল নেই তাদের। আজ যদি এই রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণ নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এতটাই অপরিণামদর্শী থেকে যান, দেশের স্বার্থ চিন্তা না করে কেবলই নগদ স্বার্থের হিসাব করেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদেরও কেউ একজন সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে মারওয়ান কাবালানের ন্যায় বলবেন, “আমরা কেউই আসলে ভাবতে পারিনি এ সংকট আমাদের আজকের এই মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিয়ে আসবে। আজ এখান থেকে উত্তরণের কোনো আশার আলোই আর নেই।”