আপাতদৃষ্টিতে জঙ্গিবাদকে ইসলাম থেকে সৃষ্ট মনে হলেও আমরা যদি এর গোড়াতে যাই তাহলে দেখতে পাবো জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম দায়ী নয়। আজকে পৃথিবীময় যে জঙ্গিবাদ তার উত্থানের জন্য প্রধানত দায়ী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। আশির দশকে আফগানিস্তানের মাটিতে এই জঙ্গিবাদের বীজ বপন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরবীয় মিত্ররা। পৃথিবী রাজনৈতিকভাবে তখন দুইটি ব্লকে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে একদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্লক; অন্যদিকে আমেরিকা-ব্রিটেনের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্লক। এই দুইটি পরাশক্তির মধ্যে বহু বছর ধরে একটি ‘শীতল যুদ্ধ’ চলতে থাকে। ভিয়েতনামে আমেরিকা চরমভাবে মার খাওয়ার পর যখন প্রতিশোধের সুযোগ খোঁজায় ব্যস্ত, তখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন সেনা পাঠাল আফগানিস্তানে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইল আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদেরকে মোকাবেলা করার জন্য আফগানদের ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবল তারা। কেননা আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যেখানকার প্রায় শতভাগ মানুষ মুসলমান। আর অন্য যে কোনো দেশের চাইতে আফগানিস্তানের মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাও অত্যন্ত প্রবল। আমেরিকা দেখল এই ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে খুব সহজেই জিহাদের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। তাতে সমর্থন দিল মধ্যপ্রাচ্যের কিছু আরব দেশও। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরবীয় মিত্রদের প্রচারণায় অল্পদিনের মধ্যেই আফগানিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলন মুসলিম দেশগুলোতে পরিচিতি লাভ করল নাস্তিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের ‘জিহাদ’ ও ‘কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ’ হিসেবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা মুসলিমপ্রধান দেশে দেশে এমন কিছু ধর্মব্যবসায়ী ভাড়া করল যাদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম তরুণদেরকে জিহাদের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করে আফগানিস্তানের যুদ্ধভূমিতে যেতে উৎসাহিত করা। তারা ওয়াজে-নসিহতে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ধর্মবিশ্বাসী মানুষদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগল এই বলে যে, ‘আফগানিস্তানে নাস্তিক্যবাদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে মুসলিমদের জিহাদ চলছে, এই জিহাদে সবার অংশগ্রহণ করা ঈমানী কর্তব্য এবং যারা এই জিহাদে মারা যাবে তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে শহীদ হিসেবে গণ্য হবে।’ তাদের এসব কথায় উৎসাহিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ আফগানিস্তানে ছুটে গেল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য। আর পর্দার আড়াল থেকে তাদের অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদী সরবরাহ করতে লাগল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’। যারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান তারা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা – আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আমরা কেবল ধারণা দেওয়ার জন্য বইটির ১২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখকৃত কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি, “(মার্কিন প্রেসিডেন্ট) কার্টারের রুশবিরোধী দল পাকিস্তান, মিশর আর সৌদি আরবের সাহায্য সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিতই ছিল। এ উপদেষ্টাদের এখন প্রয়োজন এ যুদ্ধে তিনটি উপকরণের- অর্থ, জনবল আর অস্ত্রের নিশ্চয়তা। এগুলোর সমন্বয়েই এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে। প্রাথমিকভাবে ঈওঅ এবং পরে ধনী মুসলিম দেশগুলোকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এরপরে রয়েছে জনবল। বেশিরভাগ যোদ্ধা আফগান আর পাকিস্তানের সীমান্ত থেকেই আসবে, সে সাথে অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং বিভিন্ন স্থানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সংগ্রহ করে এ যুদ্ধের জনবল যোগাড় হবে . . .মোটামুটি এই ছিল সোভিয়েতবিরোধী জেহাদের পরিকল্পনার মোটা দাগগুলো।” সেদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আফগানিস্তানে ছুটে যাওয়া তরুণরা অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে আর ভেবেছে তারা আল্লাহর রাস্তায় জীবন দিচ্ছে। এই তরুণরা কি জানত- তাদের এই আত্মত্যাগে আল্লাহ ও রসুলের কোনো উপকার হচ্ছে না, এই যুদ্ধ ইসলামের স্বার্থে হচ্ছে না, এমনকি এই যুদ্ধ মুসলিমদের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার যুদ্ধও নয়, এই যুদ্ধ আদতে এক সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরেক সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়ার স্বার্থের যুদ্ধ? তারা কি ঘুনাক্ষরেও টের পেয়েছিল যে আমেরিকা-রাশিয়ার এই স্বার্থের যুদ্ধে তাদের জিহাদী চেতনাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র? যাহোক, যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত ও বিতাড়িত হবার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় গেল তালেবানের মতো উগ্রপন্থী মুজাহিদীনরা যাদেরকে ইসলামের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। তখন তাদের আর অস্ত্রশস্ত্রের অভাব নেই, সামরিক প্রশিক্ষণও তারা যথেষ্টই পেয়েছে। সবচাইতে বড় কথা হলো তারা প্রত্যেকে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। যুদ্ধ শেষ হলেও জিহাদের এই চেতনা কিন্তু শেষ হলো না বরং আরও ধারালো হলো। তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর ইসলামের যে ফর্মটি তারা মেনে চলে স্বভাবতই তা সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠল। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যারা আফগানিস্তানে জিহাদের জন্য গিয়েছিল তারা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে ছোট ছোট দল গঠন করল নিজেদের দেশে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে। তারাও স্বপ্ন দেখতে লাগল নিজেদের দেশে তালেবান সরকারের আদলে কথিত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করার। সে সময় আমাদের বাংলাদেশেও রাজপথে স্লোগান দেওয়া হতো- ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এদিকে ফিলিস্তিন, জিনজিয়াং, কাশ্মীরসহ পৃথিবীর যেখানে যেখানে মুসলিমরা দুর্দশার মধ্যে রয়েছে সেখানেও আফগানফেরত ঐ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণরা জিহাদী চেতনায় ছুটে যেতে লাগল, হামলা-পাল্টা হামলা চালাতে থাকল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, যে আল কায়েদাকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের জন্য সেই আল কায়েদাই এবার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চরম শত্রুতে পরিণত হলো। একইভাবে যে তালেবানকে তৈরি করল আমেরিকা, সেই তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুৎ করার জন্যই আমেরিকা আফগানিস্তানে আরেক দফা যুদ্ধের আয়োজন করল। শুরু হলো একদিকে জঙ্গিবাদী তাণ্ডব, অন্যদিকে জঙ্গি দমনের নামে দেশ দখলের মহোৎসব। টুইন টাওয়ারে হামলা হলো, আফগানিস্তানের পর ইরাক দখল করে নেওয়া হলো। লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্ত ঝরল মার্কিন সেনার হাতে। এসব অন্যায়-অবিচার দেখে আরও হাজার হাজার তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে লাগল। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো তাদের স্বার্থ হাসিল করতে আফগানের মাটিতে যে অগ্নিকুণ্ডের জন্ম দিয়েছিল তা অল্পদিনের মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশে।
অতএব, প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, জঙ্গিবাদ ইসলাম থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সত্য হচ্ছে, জঙ্গিবাদের জন্মদাতা পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো; ইসলামকে তারা সুবিধা বুঝে ব্যবহার করেছে মাত্র।