রিয়াদুল হাসান:
আল্লাহর রসুলের বিদায়ের ৬০/৭০ বছর পর ঘটল এক বিরাট দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। মুসলিম জাতির শাসকরা আর খলিফা থাকলেন না। যে খলিফারা গাছের নিচে ঘুমাতেন, যে খলিফাদের কোনো প্রহরী ছিল না, যে খলিফারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন তাদের সম্যসা সমাধান করার জন্য, সেই খলিফারাই পরবর্তীতে উমাইয়া আব্বাসী ফাতিমী শাসনের যুগে হয়ে গেলেন রাজা, মালিক, সুলতান, বাদশাহ। তারা হয়ে গেলেন ভোগবিলাসী, দুনিয়ালোভী।
দ্বিতীয়ত জাতির মধ্যে জন্ম নিল আলেম শ্রেণি যারা দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে বসলেন, সহজ সরল ইসলামটিকে জটিল দুর্বোধ্য করে ফেললেন। ফলে জাতির মানুষগুলোও আলেমদের অনুসরণে বিবিধ ফেরকায় মাজহাবে মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেল।
তৃতীয়ত, এই উম্মাহর মধ্যে প্রধানত পারস্য থেকে ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফিবাদের অনুপ্রবেশ ঘটল। আল্লাহ রসুল কি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্তে অবস্থান করছিলেন না? সেই আধ্যাত্মিকতা কী? আল্লাহর রসুল জাতিকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পরিচালনা পদ্ধতি শিক্ষা দেন। আবু উবায়দা (রা.) কে বলা হতো দরবেশ। কিন্তু তিনি তো শুধুই দরবেশ ছিলেন না, সুফি চরিত্রের লোক ছিলেন না, তিনি সেই সঙ্গে ছিলেন দুর্ধষ যোদ্ধা। দুনিয়ার সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে ইরান থেকে বিকৃত সুফিবাদ ঢুকল জাতির মধ্যে। ঢুকে জাতির সংগ্রামী চরিত্রটাকে বন্ধ করে দিল। আর ঐ সুফিদের মধ্যে আবার বহু প্রকার তরিকা সৃষ্টি করল। সেই তরিকাগুলো অনুসরণ করে উম্মাহ ভাগ হয়ে গেল। এবার সাধারণ জনগণ উপদল, মাযহাব, ফেরকায়, তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল। সমগ্র জাতির লক্ষ্য হারিয়ে গেল। রাজা বাদশাহরা সুলতানরা ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে গেলেন। যে মসজিদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনি সে মসজিদ হয়ে গেল রাজপ্রাসাদের মত। ইমাম সাহেব যেখানে বসবেন সেই চেয়ার সোনার তৈরি, গম্বুজও সোনার তৈরি। সম্পত্তির পাহাড় জমল। কিন্তু তারা তাদের উপর আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব বেমালুম ভুলে গেল।
এরা ছিল কোর’আনের উত্তরাধিকার, এদের কাছে আল্লাহর রসুল এসেছেন। তিনি নিজ জীবন-সম্পদকে কোরবানি দিয়ে একটি মহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। আল্লাহ বললেন, যদি তোমরা সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বহির্গত না হও তাহলে আমি তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দেব, অন্য জাতিকে তোমাদের উপর চাপিয়ে দেব (সুরা তওবা ৩৯)। তারা এটা ভুলে গেল। বাকি অর্ধেক দুনিয়ায় তখনও মানুষ দুঃখ, দুর্দশা, অনাচার, অবিচারের মধ্যে বসবাস করছিল। কিন্তু মুসলিমরা আর তাদেরকে সেই অন্যায়ের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সেখানে গেল না। এই অন্তর্মুখীতা, স্থবিরতার পরিণামে আল্লাহর শাস্তি সঠিক সময়ে এসে গেল। হালাকু খান, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লঙ এসে তাদেরকে কচুকাটা করল। মুসলমানের মাথা জড়ো করে পিরামিড বানালো। তারা বস্তায় ভরে লাথি মেরে মেরে বাগদাদের খলিফা মুতাসিম বিল্লাহকে হত্যা করল। তবুও তাদের হুঁশ হলো না। তারা দীনের সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, নবী মাটির তৈরি না নূরের তৈরি, দোয়াল্লিন হবে না যোয়াল্লিন হবে, আল্লাহর আকার আছে নাকি তিনি নিরাকার ইত্যাদি নিয়ে তারা মারামারি কাটাকাটি খুনাখুনি করতে লাগল। যে রসুল সাহাবিরা রক্ত দিয়ে হানাহানিতে লিপ্ত আরব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন, তারা কোর’আন পেয়ে, রসুলের মত একজন আদর্শ পেয়ে, একটি পাঁচদফা কর্মসূচি পেয়েও তারা আবার সেই জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে গেল।
আল্লাহর রসুল যায়েদকে (রা.) পুত্র বলে ঘোষণা দিয়ে, ওসামা বিন যায়েদকে (রা.) সেনাপতি বানিয়ে প্রাচীন দাস ব্যবস্থাকে কবর দিলেন। সাহাবিরা চল্লিশ হাজার দাসকে মুক্ত করেছেন। পরে সেই আরবরাই আবার দাসত্ব ব্যবস্থাকে কবর থেকে তুলে এনে কায়েম করে দিল। তারা আবার জাহেলিয়াতের দিকেই ফেরত গেল। এরই মধ্যে প্রায় এক হাজার বছর চলে গেল। আল্লাহর চূড়ান্ত শাস্তি এসে গেল। ইউরোপ থেকে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ, ডাচ, পর্তুগিজ খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের ভূ-খণ্ডগুলো দখল করে নিল। মুসলিম জাতির জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় এটি। যখন আমরা তাদের পায়ের নিচের গোলাম হলাম তখন তারা আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে তাদের দেশে প্রচলিত হুকুম বিধান আমাদের উপর চাপিয়ে দিল।
আমরা যখন আল্লাহর হুকুম বাদ দিলাম তখন আমরা কি আর মো’মেন মুসলমান থাকি? তাদের অর্থনীতি, তাদের সমাজনীতি, তাদের শিক্ষানীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দিল। আমরা তখন তাদের গোলাম হয়ে গেলাম। আমাদের লক্ষ লক্ষ পীর সাহেব, তাদের কোটি কোটি মুরিদান, লক্ষ লক্ষ হাফেজে কোর’আন, আল্লামা, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির সুদ্ধ সবাই পৃথিবীর গোলাম। আমরা আর আল্লাহর গোলাম নেই। আল্লাহর যারা গোলাম তারা তো ব্রিটিশদের তৈরি করা জীবনপদ্ধতি মানতে পারে না। ব্রিটিশরা আমাদের দেশ দখল করে একটা গভীর চক্রান্ত করল। তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুটো ভাগে ভাগ করল। একটা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, আরেকটা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। মাদ্রাসাগুলোয় তারা শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিজেরা গবেষণা করে একটি বিকৃত ইসলাম তৈরি করল। ২৬ জন খ্রিষ্টান পদ্ধতি অধ্যক্ষ পদে থেকে ১৪৬ বছর ধরে সেই বিকৃত ইসলামটি এই মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিয়ে তাদের মনে মগজে গেড়ে দিল। এটাই উপমহাদেশের আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস। বাকি মুসলিম দুনিয়াতেও একইভাবে বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হলো। সেসব মাদ্রাসাগুলোতে থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ আলেম বের হয়ে আসতে লাগল। তারা কিন্তু আল্লাহ রসুলের ইসলাম শিক্ষা করেন নি। এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষাজীবন শেষ করে তারা কী উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবেন? তারা ঐ ধর্মটাকে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিক্রি করে খেতে লাগলেন।
আর সাধারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন অফিস আদালত ইত্যাদি চালানোর জন্য লোক লাগবে। তখন কেরানী শিক্ষার জন্য একটা মানহীন শিক্ষা তারা দিল। সেখানেও ধর্মের শিক্ষাগুলো দেওয়া হলো না, বরং ধর্মের বিষয়ে একটি অবজ্ঞা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হলো। ঐ শিক্ষা থেকে যারা বেরিয়ে এসেছেন তাদের মনোভাব হলো ঐ সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের সন্ধান দাতা, উৎস দাতা হলো পশ্চিমারা। সভ্যতার অগ্রগতিতে ইসলামের কোনো অবদান নাই। এরই নাম হলো ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, সাম্প্রদায়িকতা। ইসলামের ব্যাপারে খারাপ খারাপ মন্তব্য করতে তারা গর্ববোধ করেন। কোর’আনের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক আইডিয়া তাদেরকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।
গত ১০০ বছরে মুসলমানদের এই দুর্গতি দূর করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের উৎপত্তি হলো। বিভিন্ন দার্শনিক, ইসলামি চিন্তাবিদ বই লিখলেন। তারা ইসলামকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন করলেন। কিন্তু তাদেরকে বুঝতে হবে ওনাদের ঐ তরিকা ভুল ছিল। তারা যে ইসলামটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাণ দিলেন, ফাঁসিতে গেলেন, জীবন দিলেন, রক্ত ঝরালেন সেই ইসলামটা বহু আগেই বিকৃত হয়ে গেছে। ওটা তখন আর আল্লাহ রসুলের ইসলাম নেই। দ্বিতীয়ত, তারা যে প্রক্রিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন ওটা হলো ভুল পথ। ওটা আল্লাহ রসুলের প্রক্রিয়া নয়, আল্লাহ রসুলের তরিকা নয়। এই দুটি সর্বনাশ হলো। তবুও কিন্তু চেষ্টা করলেন। চেষ্টা করতে তো অসুবিধা নেই, কিন্তু ফল হলো না। আজকে এমন সংগঠনের লোকেরা আমাদের কথা শুনে দ্বিমত করেন, আমাদেরকে মারতে আসেন। আমরা বলি ভাই রাগ করবেন না, উত্তেজিত হবেন না। আল্লাহর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহর সাহায্য লাগবেই। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেহ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আল্লাহ সাহায্য করবেন কাকে? মো’মেনকে। যতই চেষ্টা করেন, সংখ্যার অহংকার, টাকার অহংকার যতই থাকুক, আল্লাহর সাহায্য না পেলে আপনারা ইসলামকে বিজয়ী করতে পারবেন না। সাময়িক একটা জাতির মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারবে, গায়ের জোর দেখাতে পারবেন, ছল চাতুরি করে হয়তো ক্ষমতায় ভাগও বসাতে পারবেন। কিন্তু সেটা কিছুদিন, মানুষ কিন্তু ইসলামের স্বাদ পাবে না। কাজেই আল্লাহর ইসলাম ছাড়া আল্লাহ সাহায্য করবেন না। এটা হলো পলিটিক্যাল ইসলামের ব্যর্থতার মূল কারণ।
পলিটিক্যাল ইসলামের এই ব্যর্থতার পর মরিয়া হয়ে অনেকে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এবং ইসলামের নামে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ভ্রান্ত পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। এর উৎপত্তি আফগানিস্তান থেকে। কিন্তু আমরা বলি তোমাদের এই প্রচেষ্টা তোমরা করতে পারো, জীবন দিতে পারো, ঐটা আল্লাহ রসুলের প্রক্রিয়া না। আল্লাহ রসুলের তরিকা নয়। তোমাদের ঐ পথ ভুল। (চলবে)