আলী হোসেন
আমাদের দেশে মাঝে-মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিদলগুলো। পত্র-পত্রিকায় পাতার পর পাতা লেখা হয় তাদের নিয়ে জঙ্গি-কাহিনী। বিদেশী দূতদের ঘন ঘন সভা-সেমিনার হয়। রাজনীতিবিদগণও তাদের সাথে ভোজসভায় মিলিত হন। এমন কি বিচারকগণও আগ্রহ সহকারে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনে থাকেন। বাতাসে গুঞ্জন আছে- এর পেছনে অন্য কোন খেলা কাজ করে। প্রভুদের কথা আমাদের কাছে বেদবাক্যের মতো। আর হবেই বা না কেন? আমরা যে গরীব! তাদের টাকায়, দান-খয়রাতে আমাদের অর্থনীতি চলে। মোড়ল রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক সেই খাতক-মহাজনের মতো যে খাতক বৃদ্ধ মহাজনের মন রাখতে নিজ নাবালিকা কন্যাকে মহাজনের কাছে তুলে দেয়।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “সন্ত্রাসবাদ যদি মুদ্রার একপিঠ হয়, তাহোলে এর অন্য পিঠেই আছে অর্থ। অর্থই সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক, অর্থই সন্ত্রাসবাদকে সম্ভব করে, অর্থই সন্ত্রাসবাদের অক্সিজেন।” তিলকে তাল বানিয়ে শত্র“কে ধ্বংস করার সা¤্রাজ্যবাদী নীতি আমাদের অজানা নয়। স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েট ইউনিয়নের অধঃপতন হয় মূলত ১৯৭৯ সালে আফগান দখলকে কেন্দ্র করে। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য আফগানিদের পক্ষ হয়ে অর্থ, অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ, মোজাহেদীনদের রিক্রুট, প্রচার-প্রচারনার কাজগুলো করে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে তখন একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদের অতীত কার্যকলাপের ফল কিছুটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরই অর্থ ও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেহাদীরা হয়ে উঠে তাদের প্রধান শত্র“। দুঃখের বিষয় এই যে তারা ছিল ইসলাম ধর্মের দাবিদার। দুঃখের বিষয় বললাম এই জন্য যে তারা যদি ইসলাম না হয়ে খ্রিস্টধর্মের বা অন্য কোন ধর্মের হতো, তবে হয়তো তাদের কপালে জঙ্গি খেতাবটা জুটতো না।
‘জঙ্গ’ শব্দটা ফারসি, এর অর্থ হলো যুদ্ধ (War)। আর জঙ্গি শব্দের অর্থ যে বা যারা যুদ্ধ করে, অর্থাৎ যোদ্ধা, ইংরেজিতে Warrior, Fighter. অর্থগত হিসেবে বিবেচনা করলে জঙ্গি শব্দের অর্থ হলো যোদ্ধা। এই হিসেবে গত একশত বছরে শুধু আমেরিকা, ব্রিটেন, ইসরাইল এই সম্মিলিত শক্তি সারা দুনিয়া জুড়ে কতটি যুদ্ধ করেছে, কত দেশ ধ্বংস করেছে, কত জায়গায় তাদের সামরিক ঘাঁটি গঠন করে কী পরিমাণ সামরিক অস্ত্রের মজুদ এবং সৈন্য মোতায়েন করেছে সেই পরিসংখ্যান দাঁড় করালে পৃথিবীর সবচাইতে বড় জঙ্গি দেশ যে তারাই তা অস্বীকার করা হবে সত্যের অপলাপ।
যাই হোক, কথিত এই নতুন জঙ্গিদের ধ্বংস করার জন্য চালু করা হলো নতুন যুদ্ধ। এই উগ্রবাদীদের নতুন ‘ট্যাগ’ দেওয়া হলো ‘জঙ্গি’। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হলেন তাদেরই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ওসামা বিন লাদেন। এই জঙ্গিদের কিন্তু কোন অস্ত্রের কারখানা ছিল না। তাদের হাতের বেশিরভাগ অস্ত্রই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রেরই দেওয়া এবং কিছুটা ছিলো রাশিয়ার হাত থেকে হস্তগত করা। অন্যদিকে ‘জঙ্গিবাদের অক্সিজেন’ অর্থ-বিত্তের নিয়ন্ত্রক ও মালিক তো একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই। ইরাক, আফগান এবং পাকিস্তানে পরিচালিত যুদ্ধের পেছনে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ৩.২ ট্রিলিয়ন থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ডলারের পরিমাণ যে কী পরিমাণ তা আমাদের দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। এই টাকা কোথা থেকে আসে? এ অর্থ লুটের মাল। সেই তারাই যখন অর্থকে জঙ্গিবাদের যোগানদাতা বলে অভিহিত করেন, তখন আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা মাথা ঝুঁকিয়ে এ কথার সায় দেন, কেউ প্রতিবাদ করেন না। কারণ আমরা গরীব। দুঃখের বিষয় আমরা প্রভুদের প্রবর্তিত ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ (Divide and Rule) নীতির শিকার হয়ে বহুধা বিভক্ত হয়ে আছি। আমাদের নেতা-নেত্রীদের কোমরে নেই জোর। তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত, তাই অন্যের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশের ছেলে নাফিসকে তারা কথিত স্ট্রিং অপারেশনের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে আটক কোরল, বিচার কোরল, ৩০বছর কারাদণ্ড দিলো। আর তাদের ছেলে নরওয়ের ব্রেইভিক ৯২ জনকে গুলি করে হত্যা কোরল, বোমা ফাটাল, তাকে নামে মাত্র শাস্তি দিলো মাত্র ২১ বছর। এখন তাকে আবার বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোরিয়ে সভ্য করানো হচ্ছে। সকলের ভালই জানা আছে নাফিস যে অপরাধ করেছে তার পেছনে ‘অক্সিজেন’ যোগানোর কাজটি কিন্তু করেছে তাদেরই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, তাদের মিথ্যাবাদীতা, প্রতারণামূলক চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদেরকে জ্ঞান দিতে পারেন কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধ নই, আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থে দলাদলি এবং কোন্দলে ডুবে আছি। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করাতে পারলেই আমরা খুশি। কিন্তু এর ফল শেষতক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি আমাদের নেতা-নেত্রীরা ভেবে দেখেছেন? তারা কি ভাবেন জঙ্গিদের অস্ত্রের যোগান কোত্থেকে আসে? মনে রাখতে হবে এসব তারাই বিলি করছে যারা অদূর ভবিষ্যতে এসবের অজুহাতে আমাদের উপর আক্রমণ করে আমাদের ধ্বংস করবে- অন্তত নিকট অতীত আমাদের তাই জানাচ্ছে। তখন আমাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন বেরিয়ে আসবে হামিদ কারজাই, একজন নুরে আল-মালেকী।
আসল কথা হচ্ছে, কোমরে জোর থাকলে অন্যদের ডেকে না এনে আমরাই জঙ্গিপনা নির্মূল করতে পারতাম। তখন আমাদেরকে বাধ্য শ্রোতার মতো তাদের মুখ থেকে এইসব নীতি কথা শুনতে হতো না। আমাদের নেতা-নেত্রীরা সজাগ হবেন কি? না কি একজন কারজাই, একজন নুরে আল-মালেকী হতেই তারা বেশি আগ্রহী?