হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ছিদামহাট যেন বাংলার বুকে এক টুকরো গাজা: ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় ভুক্তভোগীরা

রংপুরের পীরগাছার ছিদামহাট যেন বাংলাদেশের বুকে এক টুকরো গাজা। দখলদার ইসরায়েলিদের হামলার মুখে গাজার মতো ধ্বংসপুরী যেন পীরগাছার হেযবুত তওহীদের বসতভিটা। গাজাবাসীর মতো ঈদ আসেনি পীরগাছায় উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হেযবুত তওহীদের পরিবাগুলোর মাঝেও। তারা উগ্রবাদীদের আস্ফালনে আজও বাড়িঘর ছাড়া। ঈদের আনন্দ যেন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে তাদের জন্য।

ঘটনার একমাস পেরিয়ে গেলেও এখনো গ্রেফতার হয়নি আসামিদের একজনও। দোর্দণ্ড প্রতাপে এলাকায় বিরাজ করছে তারা। তাদের হুমকি-ধামকির মুখে এলাকায় যেতে পারছে না ভুক্তভোগীরা। ঘর-বাড়ি হারা পরিবারগুলোর লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছে। মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া ঘরবাড়িগুলো গাজার ধ্বংসলীলা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঈদের দিনেও তারা পথে পথে ঘুরে ফিরছেন। কেউ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘটনার দিন এক পোশাকে বাড়ি ছেড়েছেন সবাই। নিজেদের জন্য নতুন পোশাক কেনা তো দূরের কথা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে উদ্বাস্তুর ন্যায় জীবন কাটছে তাদের। অসহায় পরিবারগুলো সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

জানা যায়, ঘটনার দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় হেযবুত তওহীদের বিভাগীয় সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস শামীমের বাড়ির সামনে স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি নুর আলমের নেতৃত্বে আচমকা জড়ো হয় একদল ধর্মীয় উগ্রবাদী উত্তেজিত জনতা। মুহূর্তেই শুরু হয় তাণ্ডব। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সামনেই হামলাকারীরা আগুন লাগিয়ে দেয় ছয়টি পরিবারের বসতঘরে। মুহূর্তেই লুটপাট করে গবাদিপশুসহ বসতবাড়ি ও চারটি দোকানের মূল্যবান সামগ্রী। এসময় বসতবাড়িতে অবস্থানরত প্রায় ১৫ জন গুরুতর জখম হয়ে আহত হন। যাদের মধ্যে এখনও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪ জন ও ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ৩ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। সেসময় বাকি অসহায় পরিবারগুলো প্রাণভয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছিলো।

ঘটনার পর সংগঠনটির প্রায় ৫০ জন ভুক্তভোগী সদস্য গৃহহীন হয়ে পড়ে। তারা এখন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও আশ্রয়হীন অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। পরিবারগুলোর ছোট ছোট শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরাও কাজ হারিয়ে হয়েছেন দিশেহারা।

হামলার পর ভুক্তভোগী আব্দুল কুদ্দুস শামীম থানায় ২৭ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০০-৫০০ জন অজ্ঞাত দেখিয়ে পীরগাছা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যেখানে প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি দেখানো হয়েছে। পরে ভুক্তভোগী আরও চারটি পরিবার আদালতের দ্বারস্থ হয়ে মামলা দাখিল করেন। কিন্তু ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও তাণ্ডবকারীদের কাউকে এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। বরং দোর্দণ্ড প্রতাপে এলাকায় আধিপত্য বজায় রেখেছে আসামিরা। তারা ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে। আতঙ্কে বাড়ি-ঘরে ফিরতে পারছে না হেযবুত তওহীদের সদস্যরা।

উগ্রবাদীদের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো হল, মন্তাজুর রহমান জিল্লাল, হাসানুর রহমান সাদ্দাম, লিটন মিয়া, সাব্বির হোসেন, তছলিম উদ্দিন, মোসলেম উদ্দিন ও আব্দুল কুদ্দুস শামীম। এছাড়াও পাশ্ববর্তী চাঁন মিয়া ও তার তিন ছেলের পরিবার, শাহ আলম, আবুল কালাম এবং সোলায়ন হোসেন ভুট্টু।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য মন্তাজুর রহমান জিল্লাল বলেন, ‘আমাদের যৌথ পরিবার। দীর্ঘ একযুগ ধরে অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের সাথে জড়িত আমরা। ধর্মীয় উগ্রবাদ, সন্ত্রাস ও ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলায় স্থানীয় কিছু কুচক্রী মহল দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে আসছিল আমাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি আমার ছোট ভাই আব্দুল কুদ্দুস শামীমকে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভাগীয় দায়িত্বশীল করা হয়। এ উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে একটি প্রীতিভোজের আয়োজন করি। সেই আয়োজন এর একদিন আগেই গভীর ষড়যন্ত্র করে তৌহিদী জনতার নামে আমাদের বসতবাড়ি ও দোকানপাটগুলো লুটপাট ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে ভষ্মীভূত করে দেয়। এখন আমরা বাড়ি-ঘর ছাড়া। আমরা আইনের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো আসামিকে গ্রেফতার করা হয়নি।’ দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তারসহ ন্যায় বিচারের দাবি জানান তিনি।

ভুক্তভোগী আরেক সদস্য শাহ আলম বলেন, ‘আমরা এখনো আমাদের ঘরে ফিরতে পারছি না। হামলাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় এখনো তারা এলাকায় আস্ফালন চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি আমরা।’

তিনি বলেন, আমরা কি ফিলিস্তিনে বসবাস করছি? উগ্রবাদীদের বেপরোয়া ভঙ্গি যেন ইসরায়েলিদেরও হার মানায়। কোনো স্বাধীন দেশে এভাবে আগ্রাসন চলতে পারে না। আমরা আমাদের বাড়ি-ঘরে ফিরে যেতে চাই। আমরা নিরাপত্তা চাই। উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের বিচার চাই -বলেন শাহ আলম।

এবিষয়ে হেযবুত তওহীদের রংপুর বিভাগীয় সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস শামীম জানান, ‘সেদিন স্থানীয় জামায়াতের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আমার বাড়িতে কি বর্বোরচিত ঘটনা ঘটেছিল তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরো পৃথিবীবাসী দেখেছে। তারা তৌহিদী জনতার নাম করে মসজিদের মাইক দখল করে জনগণকে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কে উসকে দিয়ে এমন তাণ্ডব চালিয়েছে। এমন ঘটনার পূর্বে অনুমান করতে পেরে আমরা একদিন আগে উপজেলা জামায়াতের নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তারা এমন কিছু হবে না বলে আশ্বস্ত করলেও পরবর্তীতে তাদের নারকীয় তাণ্ডব থেকে আমরা রেহাই পাইনি। হামলাকারীরা এতটাই উগ্র ছিল যে, পুলিশ সেনাবাহিনী তাদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে আমরা প্রায় ১৫ জন গুরুতর আহত হয়েছি। আমারসহ ছয়টি বসতবাড়িতে লুটপাট করে আগুন দিয়ে সব মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এঘটনায় আমি বাদী হয়ে পীরগাছা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছি এবং অপর ভুক্তভোগী আরও চারটি পরিবার আদালতে মামলা করেছেন। দুঃখের বিষয় হল একমাস পেরিয়ে গেলেও এখনো আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে। আমরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে এবং আদালতের কাছে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেছি। দ্রুত ন্যায়বিচারসহ ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের দাবি করেন তিনি।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বার বার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে এখনো তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এ ঘটনায় উভয়ের পক্ষ থেকে থানায় মামলা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকতার সাথে তারা কাজ করছেন বলে জানান পীরগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ নুরে আলম সিদ্দিকী।

এই পরিবারগুলো কি কখনো তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে? নাকি বিচারের অভাবে অন্যায় থেকে যাবে দৃষ্টান্তহীন? প্রশ্নগুলো থেকেই যায়।

উল্লেখ্য, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় রংপুরে পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের ছিদাম বাজার সংলগ্ন হেযবুত তওহীদের রংপুর বিভাগীয় সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস শামীমের বাড়িতে একটি প্রীতিভোজের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তৌহিদী জনতার ব্যানারে মিছিল নিয়ে এসে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে সংগঠনের ১৫ সদস্য গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে থানায় একটি ও কোর্টে চারটিসহ মোট পাঁচটি মামলা দায়ের হয়েছে। অপরদিকে হামলাকারীদের পক্ষ থেকে মিজানুর রহমান বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
বর্তমানে স্থানীয় জামায়াতের নেতা নুর আলমের অনুসারীদের হুমকি-ধামকি ও মামলায় জড়িয়ে দেয়ার আতঙ্কে এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...